নাজুক জীবনে মহামারির হানা

কোভিড-১৯ একটি সাম্যবাদী রোগ—এ রকম কথা গত কিছুদিনে অনেকের মুখেই শুনেছি। কথাটা সত্য, তবে আংশিক। সত্য এই কারণে যে করোনাভাইরাসের আক্রমণ দেশ, অঞ্চল, শ্রেণি, লিঙ্গ, জাতি, বয়স কোনো কিছুকেই ছাড় দিচ্ছে না; সবাই নির্বিচার এর আক্রমণের শিকার হচ্ছে। এর আগে আর কোনো ঘটনা বিশ্বের সব প্রান্তের সব মানুষকে এভাবে আতঙ্কিত ও অস্থির করেনি। আর কোনো ঘটনা এভাবে বিশ্বের সব প্রান্তের অর্থনীতি স্থবির করে দেয়নি; পুরো বিশ্বকে এভাবে থামিয়ে দিতে পারেনি। এমন কোনো মানুষ নেই, যিনি ক্ষমতা বা বিত্তের জোরে বলবেন যে এতে তাঁর কোনো ভয় নেই। এই ভাইরাস তাই মৃত্যুর মতোই সাম্যবাদী।

তবে মৃত্যুর ক্ষেত্রেও ‘সাম্যবাদী’ কথাটা আংশিক সত্য। মৃত্যু অনিবার্য, সবার জন্যই। ক্ষমতা, বিত্ত, গায়ের রং, ভাষা, লিঙ্গ, অঞ্চল, পেশা, বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী, পাপী-পুণ্যবান—কোনো কিছুই মৃত্যুকে ঠেকাতে পারে না। কিন্তু মৃত্যুও কি সবার কাছে একইভাবে আসে? একজন ব্যক্তির মৃত্যু স্বাভাবিক হতে গেলে জীবনও স্বাভাবিক হতে হয়। কোনো জনপদে জীবন যদি অসম্মান, নিরাপত্তাহীনতা, অধিকারহীনতা আর অনিশ্চয়তায় জর্জরিত থাকে, তাহলে সেখানে মৃত্যু কীভাবে স্বাভাবিক হবে? বাংলাদেশে প্রতিবছর তাই অসংখ্য অকালমৃত্যু, অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। সড়ক ঠিক না রাখা, পরিবহন ফিটনেস না দেখা, চালকদের যথাযথ জীবন নিশ্চিত না করার ফলে প্রতিদিন সড়কে মানুষ মরে, বছরে তা পাঁচ থেকে সাত হাজারে পৌঁছায়। সীমান্তে হত্যা, ক্রসফায়ার, হেফাজতে নির্যাতনে মানুষ মরছে নিয়মিত। পানিদূষণ, বায়ুদূষণের ফলে ফুসফুস, কিডনির রোগসহ নানা জটিল অসুখ হচ্ছে, অকালে অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে। সন্তানধারণসহ নানা জটিলতা ছাড়াও নির্যাতনে, ধর্ষণে নারীর মৃত্যু প্রায় প্রতিদিনের খবর। আর্থিক কারণে চিকিৎসা না পেয়ে বা ভুল চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে, এমন খবরও প্রায়ই পাওয়া যায়। কারখানা-বস্তিতে আগুন, কর্মস্থলে, পথেঘাটে নির্যাতন ইত্যাদিতে বহুজনের মৃত্যু ঘটতে থাকে। বহুতল ভবনে ঝুলে ঝুলে কাজ করতে গিয়ে বহু মানুষ দুর্ঘটনায় মারা যায়।

অর্থাৎ মৃত্যু অনিবার্য হলেও তার রূপ, সময়, অনিশ্চয়তা সবার জন্য এক রকম নয়। সবাই শান্তি ও সম্মান নিয়ে জীবন শেষ করতে পারে না। বাংলাদেশে তাই মৃত্যুভয় একটা বিলাসিতা এখন। এত অজস্রভাবে এ দেশে অকালমৃত্যুর পথ তৈরি আছে যে আলাদা করে কোনো মৃত্যুভয়ে ভোগার সুযোগও থাকে না।

করোনা রোগ সবাইকে ধরতে পারে ঠিকই, কিন্তু সবার জন্য সমান পরিণতি আনে না। এই মুহূর্তে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভয় করোনার চেয়েও বেশি ক্ষুধা আর কাজ হারানোর। যারা বাংলাদেশে দূষিত বায়ু আর পানির সঙ্গে দিনরাত জীবন যাপন করে, যথাযথ পুষ্টিলাভ যাদের সাধ্যের বাইরে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকা ও কাজ করা ছাড়া যাদের উপায় নেই, তাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা এমনিতেই অনেক কম; তাদের ফুসফুস, কিডনি ইত্যাদি আগে থেকেই দুর্বল; তাদের আক্রমণ করা করোনাভাইরাসের জন্য খুব আরামের বিষয়। করোনাভাইরাস ছাড়াও অন্য বহু অসুখ তাদের ধরতে ওত পেতে থাকে। কোনো অসুখেই তাদের জন্য চিকিৎসা পাওয়া সহজ নয়।

এই রোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রধান উপায় জনবিচ্ছিন্নতা। বলা হচ্ছে ঘরে থাকুন। এই শর্ত পূরণ করতে গিয়েই উদোম হলো বাংলাদেশের আসল চেহারা। এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পক্ষে এসব শর্ত পূরণ করা সম্ভব নয়। তাদের অনেকের জন্যই বাছাই করতে হচ্ছে হয় করোনা, না হয় ক্ষুধা। ঘরহীন মানুষ ঢাকা শহরেই অনেক পাওয়া যায়। রেললাইনের ধারে গাদাগাদি করে থাকে হাজার হাজার মানুষ। বস্তিগুলো বারবার আগুনে পুড়িয়ে দিলেও এখনো লাখ লাখ মানুষের আবাস। সেখানে চার-পাঁচজন কিংবা আরও বেশি মানুষকে ছোট একটা ঘরে থাকতে হয়। প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ যেভাবে বেঁচে থাকার সামগ্রী সংগ্রহ করে, তার কোনো স্থায়ী, স্থিতিশীল, নিয়মিত রূপ নেই। যখন যেমন পাওয়া যায়, দিনের কাজে দিনের চলা, টুকটাক কাজ। প্রাতিষ্ঠানিক হিসেবে যেসব মানুষের নিয়মিত মজুরি পাওয়ার কথা, সেই পোশাকশ্রমিকেরাই করোনা সংকটকালে যখন বকেয়া মজুরি, ছাঁটাই, পুলিশ-মাস্তানের আক্রমণ ইত্যাদির মুখে দিশেহারা থাকে, তখন অন্য বহু রকম ছোট কারখানা, দোকান, পরিবহনশ্রমিকদের অবস্থা যে আরও সঙিন, তা ব্যাখ্যা করার দরকার নেই। তাঁরা কোনো মনোযোগের মধ্যেও থাকেন না। করোনা-আতঙ্ক, তা প্রতিরোধে গৃহীত ব্যবস্থাগুলো এই আধমরা মানুষদের তাই আরও শুইয়ে দিচ্ছে।

করোনা থেকে বাঁচতে ঘরে আটকে থাকা একটা বড় মানসিক ও শারীরিক চাপ। কিন্তু থাকার মতো ঘর, সে অবস্থায় খাবারের সংস্থান, প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘ ছুটি সত্ত্বেও আয় নিশ্চিত থাকা যে কত বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার, তা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করে সেই সব মানুষ, যাদের এসব নেই। করোনার প্রভাব তাই সমাজের বিভিন্ন অংশের ওপর বিভিন্ন রকম। অনেক ব্যবসা বসে পড়বে, অনেক উদ্যোক্তা পুঁজি হারাবেন, আবার অনেক ব্যবসায়ী মুনাফা করবেন, অনেকে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে ক্ষতি পুষিয়ে আরও লাভ করবেন। বেকারত্ব বাড়বে, আর দিন এনে দিন খাওয়া অপ্রাতিষ্ঠানিক লোকজন, যদি বেঁচে থাকেন, আরও অপুষ্ট, অসুস্থ, ঋণগ্রস্ত হবেন। সমাজে বাড়তে থাকা বৈষম্য আরও বাড়বে।

সব দেশে, সব সমাজে, সব শ্রেণিতে করোনাভাইরাসের ফলাফল তাই এক রকম হবে না। কার ওপর এর প্রভাব কী রকম পড়বে, তা নির্ভর করে তাদের করোনা-পূর্ব অবস্থা কী ছিল, তার ওপর। তিনটি দিক বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, যেসব দেশের সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা সবল, তাদের তুলনায় যাদের নিরাপত্তাবলয় দুর্বল, তাদের অবস্থা অধিকতর খারাপ। দ্বিতীয়ত, যে দেশ তার সর্বজনের বা পাবলিক স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থা যত বেশি দক্ষভাবে দাঁড় করাতে পেরেছে, সে দেশে তত নাগরিকদের স্বাভাবিক সময়ে যেমন এ রকম সংকটকালেও তেমনই সুরক্ষা দিতে পারছে। বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫০ বছরের মাথায় এটাই স্পষ্ট করেছে যে তার নাগরিকদের কথিত ‘সামাজিক নিরাপত্তাজাল’ শতচ্ছিন্ন, খুবই দুর্বল। আর এই দেশ সর্বজন স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থা থেকে অনেক দূরে গিয়ে এটাকেও একটা ব্যবসার ক্ষেত্রে পরিণত করেছে। তৃতীয়ত, চলছে পরিবেশবিধ্বংসী ‘উন্নয়নের’ অন্ধ যাত্রা।

এই তিন কারণে বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বে সবচেয়ে অরক্ষিত জনগোষ্ঠীগুলোর অন্যতম। কিন্তু যে বৈশ্বিক ও জাতীয় উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় নদী-বন-বাতাস-প্রাণ প্রকৃতি বিনষ্ট, যাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ কিন্তু দুর্বল মানুষেরা আজ মহাবিপদে, সেই একই প্রক্রিয়ায় সচ্ছল মানুষেরা কি শেষ পর্যন্ত নিরাপদ থাকতে পারে? পারে না। কারণ, দেশের সংকটে বিদেশে চলে যাওয়া, অন্য দেশে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার কোনো পথই এখন খোলা নেই। যেকোনো অসুখ-বিসুখে ভিআইপি ক্ষমতাবানদের উদ্বেগ কম থাকে, দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার হাল নিয়ে তাঁদের কখনো বিকার হয় না। কারণ, তাঁরা সব সময়ই প্রস্তুত থাকেন যেকোনো অসুখ হলে বিদেশে যাবেন চিকিৎসার জন্য। তারও কোনো উপায় এবার নেই। পৃথিবী একটাই, সংকটও এখন বিশ্বায়িত। কাজেই পায়ের নিচের মাটি ঠিক করতেই হবে।

করোনাকালের সংকট বুঝতে হলে তাকাতে হবে করোনা-পূর্ব দেশের অবস্থার দিকে, বিশেষত খেয়াল করতে হবে প্রাণবিনাশী ‘উন্নয়ন’, জনগণের অরক্ষিত অবস্থা, ব্যবসার দাপটে স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থার বিপর্যয়। এই সময়ে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর পাশাপাশি তার পরিবর্তনই হতে হবে করোনা-উত্তরকালে বাংলাদেশসহ বহু দেশের মানুষের আরও বহু সংকট থেকে বাঁচার পথ।

আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সর্বজনকথা পত্রিকার সম্পাদক
[email protected]