নারায়ণগঞ্জ কত দূরে?

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জের দূরত্ব কত? মানচিত্রের হিসাবে ২৩ কিলোমিটার। সেই নারায়ণগঞ্জেই করোনা পরীক্ষার জন্য পূর্ণাঙ্গ পিসিআর ল্যাব নেই। এটা জানা গেল ১৬ এপ্রিল একজন চিকিৎসকের কাছে। বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ, একই দিনে নারায়ণগঞ্জে আক্রান্ত দুজনকে শনাক্ত করে আইইডিসিআর।

বাংলাদেশে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ১৮ মার্চ; নারায়ণগঞ্জে প্রথম ব্যক্তি মারা যান ৩০ মার্চ। সেই নারায়ণগঞ্জের খানপুর হাসপাতালের চিকিৎসক মো. শামসুদ্দোহা সঞ্জয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভিডিও কনফারেন্সে বললেন, সেখানে পিসিআর ল্যাব নেই। প্রধানমন্ত্রী তাতে বিস্মিত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর বিস্ময়ে কাজ হয়েছে, এখন সেখানে পিসিআর ল্যাব স্থাপন হবে বলে কোনো কোনো সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে।

নারায়ণগঞ্জ যে হট স্পট হয়ে উঠেছে, তা তো আগেই জানা গিয়েছিল। দেশের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জেলা হিসেবে নারায়ণগঞ্জকে চিহ্নিত করেছিল আইইডিসিআর। কিন্তু সেখানে কোনো পিসিআর ল্যাব নেই, সেটা কি কারও জানা ছিল না? ৩০ মার্চ নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি মাহবুবুর রহমান সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেছিলেন, সেখানে ল্যাব স্থাপন করা হোক। ৫ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি এলাকা জরুরি ভিত্তিতে লকডাউন করে কারফিউ জারি করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ জানিয়েছিলেন মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী। তখন নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘পরিস্থিতি অবশ্যই খারাপ।’ শামীম ওসমান একসময় জোর গলায় বলেছিলেন যে তাঁর ‘দৃঢ় বিশ্বাস’, বাংলাদেশের ওপরে ‘করোনার ধাক্কা আসবে না’। কারণ, কোনো দেশের ‘রাষ্ট্রনায়ক যদি আল্লাহওয়ালা হয়, তবে সেই দেশের ওপরে আল্লাহর রহমত থাকে’। সেই শামীম ওসমান ৯ এপ্রিল বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জে এখন যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, এমন অবস্থায় ঢাকায় গিয়ে করোনার টেস্ট বা নমুনা পাঠিয়ে অপেক্ষা করার সময় নেই। এ ছাড়া করোনার উপসর্গ নিয়ে কেউ মৃত্যুবরণ করলেও পরীক্ষার অভাবে তা শনাক্ত করে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না।’ তারপরও সেখানে যে একটি ল্যাব নেই, সেই খবর কেউ জানেন না! যাঁরা এই দায়িত্বে আছেন, তাঁরাও জানেন না! যাঁরা ‘সব প্রস্তুতি আছে’ বলে জনগণকে ‘আশ্বস্ত’ করেছেন, তাঁরাও জানেন না।

রাজধানীর দরজায় এই অবস্থা, তাহলে আরও দূরের অবস্থা কী, সেটা নিশ্চয় বুঝতে পারেন। কেবল যে ল্যাব থাকা না-থাকার বিষয়, তা নয়। বলা হচ্ছে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আজ পর্যন্ত ২০টি ল্যাব চালু করা হয়েছে নমুনা পরীক্ষার জন্য। কিন্তু সব কটিতে আসলেই যথাযথ সরঞ্জাম আছে, লোকবল আছে, এমন নিশ্চয়তা কেউ কি দিতে পারবেন? এই প্রশ্ন উঠছে, কেননা সরকারের হিসাব আর বাস্তবের মিল পাওয়া দুষ্কর। উদাহরণ চট্টগ্রাম।

খবরে বলা হচ্ছে, ‘কিট–সংকটে পড়েছে চট্টগ্রামের একমাত্র ল্যাব। ফলে ফৌজদারহাটে অবস্থিত বিশেষায়িত হাসপাতাল বিআইটিআইডিতে (বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস) নমুনা সংগৃহীত হলেও ব্যাহত হচ্ছে পরীক্ষা’ (জনকণ্ঠ, ১৭ এপ্রিল)। সংকটের মুখে ১৪ এপ্রিল যে ৯৫০টি কিট পাঠানো হয়েছিল, সেগুলোতে একটি উপাদান ছিল না (চট্টগ্রাম প্রতিদিন, ১৪ এপ্রিল)। খুলনা বিভাগে সংগৃহীত ৩০০ নমুনা ত্রুটিপূর্ণ বলে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে (প্রথম আলো, ১৬ এপ্রিল)। করোনা রোগীর চিকিৎসার জন্য যেসব হাসপাতালকে নির্দিষ্ট করা হয়েছে, সেগুলোর অবস্থাও বিবেচনার বিষয়। সেগুলোর একটি ঢাকার বাংলাদেশ রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল; কিন্তু সেখানে গিয়ে সাংবাদিকেরা যে চিত্র দেখতে পেয়েছেন, তা হচ্ছে ‘শুধু নেই আর নেই’ (প্রথম আলো, ৬ এপ্রিল)। এ ধরনের আরও উদাহরণ দেওয়া যায়।

নারায়ণগঞ্জ বিষয়ে আজ যা শোনা গেছে, তা নতুন নয়। কিন্তু কেউ আগে শুনতে চাননি, যাঁরা দাবি করছেন সবকিছু ঠিকঠাক আছে, তাঁরা এখনো শুনছেন না। দেশের সামগ্রিক অবস্থা কী হতে পারে, তা নিয়ে জাতিসংঘের ইন্টার-এজেন্সি রিপোর্টে যা বলা হয়েছিল, তা ক্ষমতাসীনেরা শুনতে চাননি, এখনো শুনছেন না। শুনতে চাইলে চিকিৎসকেরা যা বলেছিলেন তা শুনতে পেতেন, বিনা চিকিৎসায় একজন চিকিৎসকের মৃত্যু হতো না। মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, কিন্তু যে চিকিৎসকেরা এখনো সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের নিয়ে মাথাব্যথা নেই। বরগুনার একজন চিকিৎসক গত বুধবার সন্ধ্যায় ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমাকে এন-৯৫ মাস্ক দিন অথবা মৃত্যুর মাধ্যমে পালাতে দিন। লোকদেখানো বাজারের ব্যাগের কাপড় দিয়ে তৈরি গাউন দেওয়া বন্ধ করুন।’

কেবল যে শুনছেন না তা–ই নয়, বলতে চাইলে নেমে আসছে খড়্গ। ইতিমধ্যেই কথিত গুজব ছড়ানোর অভিযোগে আটকের সংখ্যা পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এমনকি ত্রাণ তৎপরতায় অনিয়মের বিরুদ্ধে ফেসবুকে মন্তব্য করার অপরাধেও মামলা হয়েছে; অথচ সারা দেশে ত্রাণসামগ্রী লুটপাটের ঘটনা ঘটেই চলেছে। এর সঙ্গে যুক্ত ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা। কিন্তু এটা নিয়ে কথা বলা এখন দুরূহ হয়ে পড়েছে।

তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘আপনারা যাঁরা আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যানদের চালচোর বলছেন, তাঁরা আসলে আওয়ামী লীগের লোক না। আওয়ামী লীগের লোক চাল চুরি করতে পারে না।’ তাহলে কারা চুরি করছেন? চারদিকে যে অব্যবস্থা, তা নিয়ে কথা না বলার জন্য পরামর্শ থেকে হুঁশিয়ারি—সবই চলছে। এমন এক ধারণা তৈরি করা হচ্ছে যে অবস্থা ভয়াবহ সেটা বিষয় নয়, এটা বলাটাই অপরাধ। মুখ বন্ধ করলে তো অবস্থার উন্নতি হবে না।

শুধু যে নমুনা পরীক্ষা বা চিকিৎসা নিয়েই কানে তুলা দেওয়া হয়েছে, তা নয়। সারা দেশের মানুষ যে রুটিরুজির সমস্যায় পড়েছেন, তা মোকাবিলায়ও সমন্বিত পদক্ষেপের অভাব স্পষ্ট। দারিদ্র্যপীড়িত মানুষ যে ক্ষুধা মোচনের জন্য, বেঁচে থাকার জন্য এখন পথে নামতে বাধ্য হচ্ছেন, তা শোনার কেউ আছেন কি না, সেটাই এখন প্রশ্ন। সরকার কারও কথা শোনার তাগিদ বোধ করছে না। এই সংকট ভয়াবহ জাতীয় সংকট, কিন্তু ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের মধ্যে এই বোধ আছে বলে মনে হয় না। সংকট কেবল প্রস্তুতির অভাব নয়, করোনাভাইরাসের বিস্তার নয়, শুনতে না চাওয়া, শুনতে না পাওয়াও এখন একটি বড় সংকট।

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো