সবাই তাকিয়ে আছি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দিকে

>সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা মূলত দুটি নীতিমালা দ্বারা পরিচালিত হয়। রাজস্ব নীতি বা ফিস্ক্যাল পলিসি এবং মুদ্রানীতি বা মনিটারি পলিসি। প্রথম পর্বে ছিল নতুন সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনার মৌল নীতি। আজ দ্বিতীয় পর্বে থাকছে মুদ্রানীতি। আর শেষ পর্বে সংকট মোকাবিলায় নতুন রাজস্ব নীতিনীতি।

বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রচলিত অর্থব্যবস্থা থেকে সরে এসে নতুন আর্থিক এবং রাজস্ব নীতির সমন্বয়ে নতুন ব্যবস্থা প্রণয়নের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য মুদ্রানীতিকে স্থিতিশীল ও উন্নয়নমুখী—দুটো দায়িত্বই পালন করতে হবে। একদিকে আয় ও ব্যয়ের সামঞ্জস্য বিধান করা দরকার; পাশাপাশি, বাজারে নগদ অর্থ প্রবাহের নিশ্চয়তা দেওয়ার মাধ্যমে অর্থনীতির সংকোচন রোধ করে বেকারত্বকে দূর করতে হবে এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে।


বাংলাদেশে বেশ কয়েক ধাপে প্রণোদনা পাকেজসমূহ ঘোষিত হয়েছে। অধিকাংশ প্যাকেজই ঋণপ্রবাহ নির্ভর। সরকারের দায় সামান্য পরিমাণ। এগুলো সংকট মোকাবিলায় যথেষ্ট নয়। এখানে কিছু প্রস্তাব উপস্থাপন করা হলো।

নতুন টাকা ছাপাতে হবে
প্রথমে একটি বিষয় পরিষ্কার করা যাক। বলা হয়, নগদ অর্থপ্রবাহ বাড়ালে মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে। বর্তমান মন্দায় ভোক্তা কর্তৃক ব্যয় ও উৎপাদনের যে দৈন্য, তাতে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির সম্ভাবনা নেই। মূল্যস্ফীতি তখনই ঘটে যখন চলতি ব্যয় পণ্য ও সেবা উৎপাদনের প্রকৃত ধারণক্ষমতাকে ছাড়িয়ে যায়। সুতরাং সংকুচিত অর্থনীতিতে অর্থ জোগানের বিকল্প নেই। প্রয়োজন হলে নতুন অর্থ ছাপাতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ে চিন্তা না করে চাহিদা বাড়ানোর জন্য তারল্য নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে সুদের হারও কমাতে হবে।

শুধু সংগঠিত খাতেই ঋণসুবিধা?
মনে রাখা দরকার, করোনা-পূর্বকালেই ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহ কম ছিল। এ আর্থিক বছরের প্রথমার্ধের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৬.৮ শতাংশ। অর্জন অনেক নিচে, ১৩.৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি। জানা আছে, যেকোনো সংকটের শুরুতে তারল্যপ্রবাহ কমে যায়। অতএব ব্যাংকগুলোকে সক্রিয় করতে হবে। ব্যাংকব্যবস্থার ওপর আস্থা তৈরি করতে হবে। শুধু সংগঠিত খাতেই ঋণসুবিধা দিলে অর্থনীতির বিরাট অংশই বাইরে থেকে যাবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রায় পুরোটাই অনানুষ্ঠানিক খাতের। সব খাতে তারল্যপ্রবাহ বৃদ্ধি করতে জোরালো পদক্ষেপ ও নিয়মিত তত্ত্বাবধানের প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, ব্যাংক বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের সমপরিমাণ সুদহারে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানে ঋণ দিতে উৎসাহিত হবে না। ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানে ঋণ দিতে প্রশাসনিক ব্যয় বেশি। ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণদানে উৎসাহিত করতে হলে সরকারি তহবিল থেকে ব্যাংকসমূহকে অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ দেওয়া যেতে পারে।

শুধু ঋণ দিয়েও উপশম হবে না। ইতিমধ্যে ভঙ্গুর প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যালান্সশিটে ঋণ নতুন দায় হিসাবে যোগ হবে।

ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতাদের বোঝা কমান
লকডাউনের কারণে ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতারা আরও দায়গ্রস্ত হয়েছেন। তাঁদেরকে নতুন অর্থ সরবরাহের মাধ্যমে ব্যবসাকে সচল রাখা এবং ঋণভারমুক্ত রাখা জরুরি। ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রধানত ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতাদের দিয়ে থাকে। ‘মাইক্রোফিন্যান্স রেগুলেটরি অথোরিটি’র সঙ্গে আলোচনা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতাদের ঋণের ভার কমাতে ও ঋণপ্রবাহ চালু রাখতে একটি বিশেষ ঋণসুবিধা ব্যবস্থা বা স্কিম চালু করতে পারে।

কৃষিতে ঋণ মওকুফ ও নতুন পুঁজি
কৃষির ক্ষেত্রে একটি ঋণ প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। কৃষি দপ্তরের তালিকায় থাকা কৃষক, পোলট্রি, হ্যাচারি ও ডেইরি ফার্মের মালিকদের সুরক্ষিত করে বিজ্ঞপ্তি জারি করা দরকার। বিভিন্ন কৃষি, সমবায়, ডেইরি, হ্যাচারি, পোলট্রি, দুধ, সবজি, ফল ও বীজ উৎপাদনকারী সমিতির সদস্যদের সহজ সুদে ঋণ দেওয়া যায়। প্রথমে দরকার ঋণ মওকুফ। নতুন বছরের খেত-খামারির জন্য আরও বড় আকারের ঋণ ছাড়া সরকারি প্রণোদনা দরকার।

পুঁজির বহির্গমন নিয়ন্ত্রণ করা
করোনার ধকলে পড়েছে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য। বৃদ্ধি পাচ্ছে মন্দাদশা। দিন দিন পরিস্থিতি হচ্ছে আরও নাজুক। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রায় ২ শতাংশ বাড়লেও ২০১৯-২০ অর্থবছরের শুরু থেকেই পণ্য আমদানিতে ‘মন্থর গতি’ লক্ষ করা যাচ্ছিল। বিশেষ করে শিল্পের যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানির পরিমাণ কমে গেছে। করোনাভাইরাসের কারণে এখন আরও বড় ধাক্কা লেগেছে। শিল্পপণ্য উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসের চেয়ে গেল মার্চ মাসে পণ্য আমদানি কমেছে ৯ শতাংশ। অন্যদিকে মার্চে বিদেশে পণ্য রপ্তানি পরিস্থিতি আরও নাজুক। মার্চে রপ্তানি কমেছে ২৩ ভাগ। প্রকোপ আরও বাড়বে।

সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক রপ্তানিকারী সরকারসমূহের সঙ্গে আমদানি ব্যয় পরিশোধের জন্য সময় বৃদ্ধির ব্যাপারে আলোচনা করতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানিকারকদের অর্থ বিলম্বে পরিশোধের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার স্বল্পতা দেখা দিলে বৈদেশিক মুদ্রা আমদানি তহবিল গঠন করতে পারে। বাণিজ্য প্রবাহে বিঘ্ন এড়াতে বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা দরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রা অদলবদল বা কারেন্সি সোয়াপ অথবা বার্টার করলে পুঁজির বহির্গমন নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।

নিট বৈদেশিক সহায়তার প্রবাহ হ্রাস পেয়েছে। এ আর্থিক বছরের সাত মাসে মোট বিদেশি সহায়তা প্রাপ্তি ৩.২৮ বিলিয়ন ডলার। গত আর্থিক বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫.৫৮ শতাংশ কমেছে। বড় উদ্যোগ দরকার। একই সঙ্গে অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রার নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ বজায় রাখতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং অন্যান্য বহুপক্ষীয় ও দ্বিপক্ষীয় সংস্থার সঙ্গে ঋণ মওকুফ, অনুদান ও স্বল্প সুদে ঋণসহায়তা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ‘স্পেশাল ড্রইং রাইট’ আরও বেশি পরিমাণে ইস্যু, ঋণ পুনর্গঠনের, আইএমএফে বহুপক্ষীয় মুদ্রা অদলবদল বা কারেন্সি সোয়াপ ব্যবস্থা স্থাপন ও আইএমএফের কোটা সংস্কারের পক্ষে মত দিতে পারে।

ঋণ পুনর্গঠন সংস্থার প্রয়োজন
কিছু ব্যাংকের আমানত-ঋণ অনুপাত নির্দিষ্টকৃত পরিমাণ ছাড়িয়ে গেছে এবং নিকট ভবিষ্যতে আমানত বৃদ্ধির সম্ভাবনা খুব কম; কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমানত-ঋণ অনুপাত, বিধিবদ্ধ তারল্য অনুপাত ও নগদ রিজার্ভ অনুপাতে ছাড় দিয়েছে। প্রয়োজন অনুযায়ী স্বল্প মেয়াদে আরও ছাড় দেওয়া যেতে পারে।

আশার কথা, বিশেষ সুবিধা নিয়ে ঋণ পুনঃ তফসিলকারীদের ঘোষিত প্যাকেজের অধীনে ঋণ দেওয়া হবে না। ঋণ অবলোপন সুবিধাভোগী এবং আদালতে যাঁদের মামলা বিচারাধীন, তাঁরাও যেন এই প্যাকেজ থেকে ঋণ না পান। প্রাক্‌-সংকটকালেই খেলাপি ঋণের মাত্রাতিরিক্ততার কারণেই একটি ঋণ পুনর্গঠন সংস্থার প্রয়োজন ছিল। দ্রুততার সঙ্গে এটির বাস্তবায়ন দরকার।

তাকিয়ে আছি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দিকে
শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে বা তারল্য জোগানের মাধ্যমে এ মহাসংকট থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে না। সক্রিয় রাজস্ব নীতি লাগবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে সরকারের অর্থের জোগান দিতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও সক্রিয় হতে হবে। সনাতন প্রথাগত ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। বাক্সে বন্দী নয়, সৃজনশীলতা দেখাতে হবে। মুদ্রানীতি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। মূল লক্ষ্য হতে হবে বর্তমান সংকোচন থেকে কর্মসংস্থানমুখীন পুনরুদ্ধার। কর্মসংস্থান সৃজনমুখীন উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডের অগ্রাধিকারযুক্ত খাতগুলোয় পর্যাপ্ত অর্থায়নের বাধা দূর করতে হবে। উৎপাদন খাতে তারল্যপ্রবাহ নিশ্চিত করা দরকার। কর্মসংস্থান ধরে না রাখা গেলে এবং নতুন কর্মসংস্থান তৈরি না হলে পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে না। সবাই তাকিয়ে আছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দিকে। বাংলাদেশ ব্যাংক কি পারবে অর্থনীতির এ সংকট থেকে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার ও পুনর্গঠন করতে? কেন্দ্রীয় ব্যাংক জনগণের তথা সর্বজনের ব্যাংক হোক—এ আশা সবার।

ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর: অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং চেয়ারপারসন, উন্নয়ন অন্বেষণ।
[email protected]