চিকিৎসকদের উদ্দীপ্ত না রাখতে পারলে আমরা হেরে যাব

ডা. মো. রোবেদ আমিন।
ডা. মো. রোবেদ আমিন।
>

ডা. মো. রোবেদ আমিন। অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের মেডিকেল জার্নালে ৮৫টির বেশি নিবন্ধের লেখক, দেশের মেডিকেল পাঠ্যক্রম নির্ধারণের সঙ্গে যুক্ত। বাংলাদেশ সরকারের কোভিড-১৯ গাইডলাইনের অন্যতম প্রণেতা। ম্যালেরিয়া, এভিয়ান, সোয়াইন ইনফ্লুয়েঞ্জা, ডেঙ্গুসংক্রান্ত জাতীয় গাইডলাইন তৈরি ও প্রশিক্ষণ প্রদানের সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট ছিলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান

প্রথম আলো: সারা দেশ ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণায় কী ধরনের নীতিবদল দেখছেন?
রোবেদ আমিন: মার্চের শেষ থেকে আমরা যে বিপদঘণ্টা বাজিয়ে চলছিলাম, এখন তারই স্বীকৃতি এল। আমরা চতুর্থ ধাপে পৌঁছে গিয়েছি। এর অর্থ হলো অবিলম্বে কতগুলো নির্দিষ্ট কৌশল নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন, সব স্তরের স্বাস্থ্যকর্মীসহ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী সংগঠিত করা। পিপিইসহ সব উপকরণ ও সম্পদের সর্বাত্মক জোগান নিশ্চিত করা। সশস্ত্র বাহিনীকে অধিকতর যুক্ত করা। অস্থায়ী হাসপাতাল তৈরি করা।

প্রথম আলো: সিলেটে চিকিৎসকের অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ এবং কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে চিকিৎসক বরখাস্তের ঘটনাকে কীভাবে দেখছেন?
রোবেদ আমিন: চিকিৎসকের সুচিকিৎসা না পাওয়া চরম অব্যবস্থাপনার উদাহরণ। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। আর কোভিড হাসপাতাল হলেই সেখানে সার্বক্ষণিক এক চিকিৎসক থাকবেন, সেটা সম্ভব নয়। সারা বিশ্বেই পালাক্রমে ডিউটি স্বীকৃত। চিকিৎসকেরা গ্রুপ করে দায়িত্ব পালন করবেন। এক গ্রুপ ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন শেষে হয়তো এক সপ্তাহ পরিবারের সঙ্গে থেকে পুনরায় কাজে ফিরবেন। কুয়েত মৈত্রী সেভাবেই চলছিল। চিকিৎসক বরখাস্ত বিশ্বের সবচেয়ে অমানবিক কাজ। অনলাইন সাক্ষ্য দিচ্ছে, ব্রিটেন, ইতালি ও স্পেন বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসক নিতে চাইছেন। আমরা যদি প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা থেকে আমাদের চিকিৎসকদের রক্ষা করতে না পারি, তাহলে এই যুদ্ধে আমরা পুরোপুরি হেরে যাব।

প্রথম আলো: নিউমোনিয়া বা দৃশ্যত করোনার উপসর্গ আছে, এমন রোগীর সংখ্যা ও তাদের মৃত্যুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য, যা করোনায় মৃত্যুসংক্রান্ত সরকারি হিসাবের বাইরে। কীভাবে দেখছেন?
রোবেদ আমিন: উহানে অপ্রচলিত ধরনের নিউমোনিয়া রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ খুঁজতে গিয়েই করোনা উদ্‌ঘাটিত হয়েছিল। আমাদেরও একটি ইনফ্লুয়েঞ্জা সার্ভিল্যান্স টিম আছে। যখন এখানে বাড়ল, তখন তাদের তৎপরতা দেখিনি। বাংলাদেশে প্রথম করোনা চিহ্নিত (৮ মার্চ) হওয়ার সময়ের একটা কথা বলি। ঢাকা মেডিকেল কলেজে আকস্মিকভাবে একটা পরিবর্তন নজরে এল। এক দিনে (১১ মার্চ) অস্বাভাবিক নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত প্রায় ১২ জন রোগীর একটা স্লট পাই। আমি আমার কর্তৃপক্ষ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি ও সিডিসির পরিচালককে চিঠি দিলাম। তাতে বললাম, ক্লিনিসিয়ানরা একটা কিছু আশঙ্কা করছেন। সেখানে কোভিড-১৯–এর ইঙ্গিত ছিল। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক, তখন কোনো সার্ভিল্যান্স হলো না। ওই রোগীদের পরীক্ষা কিন্তু আমরা করাতে পারিনি। চিঠির উত্তর পাইনি। পরে তাঁরা কেউ মারা গেলেন, কেউ ভালো হলেন। কেসের সংজ্ঞা নির্ধারণেও বিলম্ব ঘটেছে। ওই সময়ে শুধু বিদেশপ্রত্যাগতদের পরীক্ষা চলছিল। পরে যখন বিভিন্ন হাসপাতালে অপ্রচলিত নিউমোনিয়ার সংখ্যা বাড়ার খবর পাই, আমি একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস দিই। এরপর জানলাম, তারা এ ধরনের রোগীর টেস্টে রাজি। অবশ্য এটাও বলা দরকার যে হাসপাতালগুলোয় আমরা পদ্ধতিগতভাবে নিউমোনিয়া বা শ্বাসকষ্টজনিত রোগী বা মৃত ব্যক্তিদের পরিসংখ্যানও যথারীতি রাখি না। কারণ, বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোয় কোনো অডিট ব্যবস্থা নেই। এক ছাত্রকে দিয়ে ঢাকা মেডিকেলে গবেষণার জন্য এক মাসের মৃত্যু বিষয়ে একটা কাজ করিয়েছিলাম মাত্র। জানুয়ারির পরে দেশের কোন হাসপাতালে কতজন নিউমোনিয়ার মতো লক্ষণ নিয়ে মারা গেছে, তার কোনো পরিসংখ্যান পাবেন না। কারণ কেউ এটা বলতে পারবেন না।

প্রথম আলো: আক্রান্ত কোনো ভিআইপি কুয়তে মৈত্রীর পরিবেশে থেকে একদম স্বস্তি পাবেন না, বলেন কেউ কেউ।
রোবেদ আমিন: শুনেছি সেখানে কয়েকজনক কনসালট্যান্টকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেখানে তো পুরো টিম থাকার কথা। প্রতিটি কোভিড হাসপাতাল চমৎকারভাবে উপযোগী থাকবে, সেটাই প্রত্যাশিত। রেসপিরেটরি স্পেশালিস্ট, কার্ডিওলজিস্ট, অ্যানেসথেটিস্ট দিয়ে ডিজাইন করা হলো না। ওখানে তো গাইনোলজিস্টও লাগবে। কারণ, গর্ভবতী নারীরা তো ভর্তি হবেন। পেডিট্রিশিয়ান লাগবে, কারণ নবজাতক যদি কোভিডে আক্রান্ত হয়। সাইকোলজিস্ট লাগবে। কারণ, চারদিকে এত ভয়। একজন ফিজিক্যাল মেডিসিনের লোক লাগবে। এ রকম একটা বিগ টিম সেটআপ না করলে সুচিকিৎসা কোথায় পাবেন। ভেন্টিলেটর থাকলেই হবে না, সেগুলোর ট্রায়াল দরকার। অক্সিজেন স্যাচুরেশন পরখ করাটা গুরুত্বপূর্ণ। তাই ভেন্টিলেটর লাগিয়ে রোগীর বেঁচে যাওয়া বাংলাদেশে হবে একটা বিরাট অলৌকিক ঘটনা।

প্রথম আলো: রোগী অল্প সময়ে এক লাখে পৌঁছাতে পারে?
রোবেদ আমিন: এটা লকডাউনের কার্যকরতার মাত্রার ওপর নির্ভর করছে। এখন পর্যন্ত সারা দেশে এর কার্যকরতা ভালোই বলব। ভালো সিদ্ধান্ত। তবে লকডাউনই শেষ কথা নয়। কার্যকর লকডাউনের মধ্যে বাসাবাড়িতে এর বিস্তার ঘটতে পারে। কারণ, পরিবারগুলোয় ‘সামাজিক দূরত্ব’ মানাই হচ্ছে না। তাই বাসায় বাসায় এটা ছড়াবে। সুতরাং চ্যালেঞ্জ হলো, আক্রান্ত ব্যক্তিদের একটা বৃহৎ আইসোলেশন ক্যাম্পে থাকার ব্যবস্থা তৈরি করা। যেমন একটা স্টেডিয়ামে রাখা যেতে পারে। তাহলেই এটা নিয়ন্ত্রিত থাকবে। এই মুহূর্তে এ রকম ব্যবস্থা নিশ্চিত করার চেয়ে অন্য কিছু শ্রেয় হতে পারে না। কিন্তু আমরা এ রকম পদক্ষেপে এখনো যাচ্ছি বলে মনে হচ্ছে না। তাই সংখ্যা বেশ বৃদ্ধির আশঙ্কা আমরাও করি। এটা এড়াতে চাইলে এ ধরনের পদক্ষেপ নিতেই হবে।

প্রথম আলো: গণপরিবহন বন্ধের মধ্যে গ্রামের একজন করোনা সন্দেহভাজনের পরীক্ষা কী করে কোথায় হবে? আপনিও কারিগরি কমিটির সদস্য। আপনারা গাইডলাইনে রক্ত পরীক্ষার (আরটি পিসিআর বাদে) যে উপায় বাতলেছেন, সেগুলো কীভাবে হবে?
রোবেদ আমিন: এবারের সংকটে আমাদের রাজধানী বা নগরভিত্তিক চিকিৎসা অবকাঠামোর দুর্বলতা ফুটে উঠেছে। গ্রামের মানুষ উপজেলা সদরে গিয়ে কিছু প্রাথমিক টেস্ট করাতে পারে।

প্রথম আলো: টেস্ট মানেই কেন পিসিআর? কেন কিটের দোহাই? আমাদের বিশেষজ্ঞরা কেন জোরেশোরে বলছেন না যে সিবিসি টেস্ট, এক্স-রে, সিটি স্ক্যানেই করোনা রোগী শনাক্ত সম্ভব?
রোবেদ আমিন: বুকের এক্স রে এবং সিটি স্ক্যান করে শতভাগ করোনা শনাক্ত সম্ভব। আরটি-পিসিআর দরকার পড়বে না। বিসিএল-২–এর মতো দুরূহ ল্যাব চালু নিয়ে এত যে জটিলতা, তা আমরা এড়াতে পারব। উহানে গোড়ার দিকে রিয়েল টাইম পিসিআর কিটের ঘাটতিতে পড়েছিল, তখন তারাও রক্ত পরীক্ষা, এক্স-রে ও সিটি স্ক্যান করেই চিকিৎসা দিয়েছে। সুতরাং এর কার্যকারিতা প্রমাণিত।

প্রথম আলো: তাহলে আপনারা বিশেষজ্ঞরা নীরব থাকলেন কেন? এখনো কেন সিটি স্ক্যান নিয়ে সরব নন। কেন আইইডিসিআর বলল, তারাই এটা করবে। তাদের সার্টিফিকেট লাগবে। ঢাকার বাইরে কয়টা বিএসএল-২ ল্যাব খোলা হবে, তা নিয়ে এত ধস্তাধস্তি কেন?
রোবেদ আমিন: আমরা যারা ক্লিনিসিয়ান, তারা তো মাঠে ছিলাম না। প্রথমেই তো নিউমোনিয়ার কেসগুলো দেখতে বলেছিলাম, সেটা তো শোনা হয়নি। কারা বাংলাদেশে দায়িত্বে থাকেন, সেটা তো বুঝতেই পারছেন। এ বিষয়ে মানুষকে টেলিমেডিসিন সার্ভিসে পরামর্শ দেওয়া যায়। কারণ, সিটি স্ক্যান কোভিডে ফুসফুসের সংক্রমণটা খুব প্রাথমিক পর্যায়েই শনাক্ত করতে পারে। কোনো জেলায় দুটি সিটি স্ক্যান থাকলে একটিকে কিন্তু এখনই কোভিড-১৯–এর জন্য আলাদা করে রাখতে হবে। কারণ, সিটি স্ক্যানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদেরও নিরাপত্তা দরকার। একটা রেট বাধা হোক, মানুষ যেখানেই টেস্ট করাবে, সেখানেই এক রেট। এ রকম একটা ডিজাইনে সব পরীক্ষা আনা যায়, তাহলে তা বিরাট সুফল দিতে পারে। আসলে উপজেলাগুলোয় সিটি স্ক্যান দিতে পারলে ভালো হতো, কোথাও তা নেই। এমনকি রক্তের জটিল পরীক্ষাও উপজেলায় নেই। তাই এই সংকট চিকিৎসাব্যবস্থার দুর্বলতা সবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল। পুরো ব্যবস্থার সংস্কার না করলে এবারে নয়, ভবিষ্যতের সংকট মোকাবিলা করতেও আমরা অক্ষম থাকব।

প্রথম আলো: রক্তের পাঁচটি মামুলি পরীক্ষায় করোনার ঝুঁকি শনাক্ত সম্ভব। এতে মানুষের স্বেচ্ছা অংশগ্রহণে একটা ফিল্টারিং হলো, মানুষ নিজেই আইসোলেশনে থাকল। তাই ভ্রাম্যমাণ ল্যাব গ্রামে গ্রামে পাঠানো অসম্ভব?
রোবেদ আমিন: অবশ্যই সম্ভব। এটা হতে পারে একটা চমৎকার সৃজনশীল পদক্ষেপ। ভারতের কেরালায় তো গ্রামে বুথ খোলা হয়েছে। সেখানে একবারেই পিসিআর দিয়ে টেস্ট চলছে। তা ছাড়া করোনার রোগী চার ধরনের। মাইল্ড, মডারেট, সিভিয়ার ও ক্রিটিক্যাল। মডারেট থেকে যারা সিভিয়ার পর্যায়ে থাকে, তাদের একটা সহজ রক্ত পরীক্ষা আছে। এটাকে বলে কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট (সিবিসি)। এটা প্রতিটি উপজেলায় আছে। এর মধ্যমেও উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্রেই শনাক্ত করা সম্ভব।

প্রথম আলো: মহামারি হলে টেস্ট লাগে না, লক্ষণ দেখেই চিকিৎসা—এটা একটা মত। আবার লক্ষণ না থাকা লোকও করোনা ক্যারিয়ার হতে পারে, তাই বেশি টেস্ট বেশি লাভ, দুই মতকে কীভাবে দেখেন?
রোবেদ আমিন: বেশি টেস্টের বিষয়টি সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়। আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৮০ ভাগ টেস্ট ছাড়াই উতরে যাবেন, কিন্তু বাকি যাঁরা হাসপাতালে আসবেন, এই যে ২০ ভাগ, তাঁদের সংখ্যাটা খুব বেশি হলে সামাল দেওয়া আমাদের জন্য মুখ্য চ্যালেঞ্জ হবে। কোভিড হাসপাতাল পরিচালনার চেকলিস্টসংবলিত একটি ডকুমেন্ট সরকার সবে প্রকাশ করেছে। গাইডলাইনেও নির্দেশনা আছে। এটি অনুসরণ করা হলে আমাদের কোভিড হাসপাতাল/চিকিৎসাকেন্দ্রগুলো দাঁড়াবে। না মানলে আমরা যে তিমিরে ছিলাম, সেই তিমিরেই থাকব।

প্রথম আলো: কোভিড-১৯ মোকাবিলার বিদ্যমান ব্যবস্থা যথেষ্ট?
রোবেদ আমিন: লকডাউন কার্যকর ও লক্ষণযুক্ত ব্যক্তিদের পরীক্ষায় শৈথিল্য থাকলে এপ্রিলের শেষে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি উঁচুতে যেতে পারে। তখন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মাধ্যমে সুবিধা প্রদান পুরোপুরি নিঃশেষিত হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার ভেন্টিলেটর নিয়েও হিমশিম খাচ্ছে। ইতালি তাদের ৪৫ হাজার ভেন্টিলেটর শেষ হওয়ার পরে নির্দয় সিদ্ধান্ত নিল। বলল, ভেন্টিলেটর তরুণের প্রাপ্য, প্রবীণের নয়। তাই সেখানে বহু প্রবীণ রোগী ওয়ার্ডেই মারা গেলেন। আমাদের আপাতত কোভিড হাসপাতাল ২৯টি। আর ভেন্টিলেটর সারা দেশেরটা জড়ো করলেও ৫০০–এর বেশি হবে না। অথচ এমন করোনা রোগী সামনে অন্তত পাঁচ হাজার হতেও পারে।

প্রথম আলো: সামনে সম্ভাব্য কত রোগী হলে, কী কী ব্যবস্থা, এ রকম সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা আছে বলে জানেন?
রোবেদ আমিন: বিদেশে যেমনটা গাণিতিক হিসাব ধরে পরিকল্পনা করা হয়েছে, সেটা হয়নি। আমরা যেটা করছি, সেটা হলো রি-অ্যাকশনারি মিটিগেশন বা অবস্থা দেখে ব্যবস্থা, এতে সমাধান নেই। জার্মানি, তাইওয়ান, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো বহু দেশ সংকট গভীর হওয়ার আগেই করণীয় নির্দিষ্ট করেছে। খুব সম্পদ নেই, অথচ দক্ষতা দেখিয়ে সফল হওয়ার মধ্যে ঘানা, নেপাল, ভুটান ও শ্রীলঙ্কার নাম করতে পারি। তাদের রোগীর সংখ্যা পঞ্চাশ কি একশতেই রেখেছে। কারণ, তারা সজাগ ছিল। ধরুন, ১০ হাজার রোগী হবে ধরে ভেন্টিলেটর প্রস্তুত করা হলো, অথচ বাস্তবে তা লাগল না। তাতে দেশের ক্ষতি হবে না। বরং ভবিষ্যতের কোনো মহামারি রুখতে জাতীয় শক্তি-সামর্থ্য বাড়ল। ১৯১৮ সালের মহামারির আগে বিশ্বে অ্যান্টিবায়োটিক ও ভেন্টিলেটরের মতো দরকারি বিষয় ছিল না। মহামারি রোধের প্রস্তুতিহীনতায় আজকের বাংলাদেশ, সেই ১৯১৮ সালের আগের অবস্থায় রয়ে গেছে।

প্রথম আলো: চিকিৎসক সমাজ কতটা উদ্দীপ্ত?
রোবেদ আমিন: তাঁরা ‘ডিমরালাইজড’ ছিলেন। তাঁরা ‘ডিমটিভেটেড’ হয়ে গেছেন। গোটা বিশ্বে ফ্রন্টলাইনারদের উজ্জীবিত করাই টার্গেট। ট্রাম্পকে নিয়ে আমরা যা–ই বলি, তিনি কিন্তু সারাক্ষণ বলছেন, আমার ডাক্তার, আমার সিডিসি শ্রেষ্ঠ। বরিস জনসন বলছেন, প্রিয় দেশবাসী, আমাদের কিছু নেই, সবাই এগিয়ে আসুন। ফ্রন্টলাইনাররা থাকলে বাঁচব, নইলে আমরা বাঁচব না। তাঁরা বারংবার এসব বলছেন, কারণ এ ধরনের পরিস্থিতিতে এমন কথাই গোটা জাতিকে উদ্দীপ্ত করতে পারে। বিমার মতো বিষয় বাংলাদেশের ডাক্তারদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়, তাঁরা সম্মান চান। সিস্টেমের লসের কারণে ডাক্তাররা অনেক ক্ষেত্রে অপারগ থাকছেন। যাঁরা দায়িত্বহীন হবেন, তাঁরা শাস্তি পেতে পারেন। কিন্তু তা বলার দরকার নেই। এন-৯৫ যে ডাক্তারের থাকবে না, তিনি আইসিইউতে ঢুকলে তো অন্যদের ক্ষতি করে দেবেন। আর আন্তর্জাতিক রেগুলেশনে স্পষ্ট লেখা আছে, পিপিই না পেলে একজন স্বাস্থ্যকর্মী কাজ করতে অস্বীকৃতি জানানোর অধিকার রাখেন।

প্রথম আলো: পিপিই বা মাস্কের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
রোবেদ আমিন: এটা পেলেই হলো না, এর উপযুক্ততার টেস্ট আছে। সেটা নিশ্চিত না করলে সংখ্যা দিয়ে পরিমাপ করলে হবে না। প্রকৃত এন-৯৫ না থাকলে আইসিইউ, সিসিইউ, এসডিইউ চলবে না। আবার ফ্রন্টলাইনার বলতে ডাক্তার নন, নার্স, আয়া, ক্লিনার, প্লাম্বার, অ্যাম্বুলেন্স কর্মী, এমনকি কবর খননকারীও আছেন। তাঁদের সবার পিপিই লাগবে।

প্রথম আলো: এটা কি ঠিক যে যাদের উচ্চ মাত্রায় অক্সিজেন লাগবে, তাদের ভিন্ন ধরনের মাস্ক লাগবে। তার সরবরাহ?
রোবেদ আমিন: হ্যাঁ। সেগুলোকে বলা হয় ভেনচুরি বা রিব্রেদিং মাস্ক। অক্সিজেন আছে, এই মাস্ক নেই। তাহলে রোগীকে কিন্তু অক্সিজেন দেওয়া যাবে না। এমনিতে সরকারি হাসপাতালগুলোর অ্যানেসথেসিয়া বিভাগে দু-একটা পাবেন। দরকার হাজারে হাজার। তাই অক্সিজেন, ভেনচুরি মাস্ক ও নেগেটিভ ফ্লো বা কাস্টমাইজ প্রেশার রুম, কতটা কী লাগবে, তা ঠিক করে ফেলতে হবে। শুধু অক্সিজেন ঠিকভাবে দিতে পারলে বিপুলসংখ্যক রোগী বেঁচে যাবে। লাগুক না লাগুক, অন্তত ৩০ হাজার (সম্ভাব্য দুই লাখ রোগীর ১৫ ভাগ) মানুষের অক্সিজেন ও মাস্ক তো এই মুহূর্তে মজুত থাকবে। ওই পরিকল্পনাটারই অভাব চলছে। সবাইকে সম্পৃক্ত করতে পারলে এটা এক সপ্তাহে সম্ভব। মহামারির অন্যতম নীতি স্বচ্ছতা। কেন জানি মনে হয়, তেমন স্বচ্ছতায় এখনো যেতে পারিনি পুরোপুরি। আমার একজন কমান্ডার থাকবেন, তিনি আমাকে প্রতিনিয়ত করণীয় নির্দেশ করবেন। যেখানেই ঘাটতি থাক, সেটা জানাতে হবে। পূরণের জন্য সাহায্য চাইতে হবে। গার্মেন্টসকে উদ্দীপ্ত করার কারণেই তারা পিপিই, মাস্ক দিচ্ছে। কিন্তু কারও দ্বারা প্রতিনিয়ত গৎবাঁধা ব্রিফিং, সেটা তো ঠিক হলো না। যত বেশি স্বচ্ছতা, উন্মুক্ততা, তত কাজগুলো ভালো হবে। ডব্লিউএইচওর একজন কর্মকর্তা বললেন, আমি নিজেও রাজনীতিক, তবে পক্ষ-বিপক্ষ দেখার সময় এটা নয়। মানুষের জীবন বাঁচাতে হবে। এখানে ঐক্য এলে দেশে, বিশ্বে সংহতি হবে। করোনা পর্যুদস্ত হবে।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
রোবেদ আমিন: ধন্যবাদ।