দলীয়করণে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম হুমকিতে

অলংকরণ : মাসুক হেলাল
অলংকরণ : মাসুক হেলাল

ত্রাণ আত্মসাৎ বিষয়টি নতুন কিছু নয়। তবে ছিল রাখঢাক, ভয়ভীতি। দুর্নীতি দমন কমিশন না থাকলেও ছিল ব্যুরো। ত্রাণ বণ্টনের অনিয়ম বা আত্মসাতের অভিযোগে সে ব্যুরো অনেককে আইনের আওতায় এনেছে। দুদক গঠিত হওয়ায় আইনি দিক অনেক জোরদার হয়েছে। তবে তাদের কার্যক্রম আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী জোরদার হয়নি। বর্তমানে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত জনগণকে উদারভাবে সহায়তা দিতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। কিন্তু এ পদক্ষেপকে বানচাল করে নিজেরা লাভবান হতে কিছু সুবিধাভোগী নেমে পড়েছেন। তঁাদের অনেকে তৃণমূল পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি। তাঁদের কারও ঘরে শতাধিক বস্তা চাল কিংবা কারও খাটের নিচে হাজার লিটার সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে।

যত ঘটনা ঘটে, তার খুব কমই গণমাধ্যমে আসে। আর কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে মিটমাটও হয়ে যায়। এযাবৎ যেসব বিষয় গণমাধ্যমে এসেছে, তা দেখে আমরা হতচকিত হয়ে পড়েছি। করোনাভাইরাস বিপর্যয়ে বিশাল জনগোষ্ঠী হারিয়েছে তাদের কাজ ও আয়। এ ক্ষেত্রে সরকারের দেওয়া সুবিধাদি থেকে প্রকৃত প্রাপকদের বঞ্চিত করে এর একটি অংশ আত্মসাৎ করছে ত্রাণ বণ্টনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তৃণমূল পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের একটি অংশ।

করোনাভাইরাসজনিত বিপর্যয়ে ত্রাণসহায়তা কার্যক্রম শুরু হয়েছে মাত্র। সরকারের আরও বড় পরিকল্পনা আছে। নগদেও দেওয়া হবে নিরাপত্তাবলয়ের আওতায়। সেটা হয়তো ব্যাংক হিসাবে যাবে। তবে কারা পাবেন, সে তালিকা মূলত তৈরি করবেন স্থানীয়
পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিরাই। ঘোষণা হয়েছে, ৫০ লাখ রেশন কার্ড দেওয়া হবে বিপন্ন পরিবারগুলোকে। তাঁরা নামমাত্র মূল্যে খাদ্যসহায়তা পাবেন এসব কার্ড দিয়ে। সে তালিকাও ওই পর্যায়ে তৈরি হবে। অতীতেও হয়েছে। কোনো বিচ্যুতি হয়নি এমন দাবি করা যাবে না। তবে কিছুকাল যাবৎ এ ধরনের তালিকায় নাম তুলতে টাকা লেনদেনের অভিযোগ আসছে। আবার তালিকা করতে গিয়ে সরকারি দলের লোকজন দলীয় বিবেচনাকেই গুরুত্ব দেবে, এটা ধারণা করাও অসংগত হবে না। এ পর্যন্ত ১২ জন তৃণমূল জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে আত্মসাতের
অভিযোগ আনা হয়েছে। কয়েকটি ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যক্রম রুজু হয়েছে। কয়েকজনকে সরকার সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছেন।

প্রথাগতভাবে স্থানীয় প্রশাসন এ ত্রাণসহায়তা বিতরণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। তবে সুবিধাভোগীদের তালিকা তৈরি ও তৃণমূল পর্যায়ে ত্রাণসামগ্রী বণ্টনের ক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা অপরিহার্য। এ–জাতীয় বিপর্যয়েও যদি তঁারা লোভ সামলাতে না পারেন, তবে সরকারের উদ্দেশ্য অনেকাংশেই ব্যাহত হবে। প্রশ্ন উঠবে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা সম্পর্কেও। যেকোনো আকৃতি বা প্রকৃতিতেই হোক, সারা দেশ কিংবা বিশেষ অঞ্চলে আমাদের নিয়মিতই ত্রাণসহায়তা দিতে হয়। জনপ্রতিনিধিদের কেউ কেউ ত্রাণ নিয়ে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়লেও তঁারা কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নন। তাঁদের কার্যক্রম তদারক করার জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মকর্তা থাকার কথা। প্রশ্ন হচ্ছে জনপ্রতিনিধিরা এত বেপরোয়া কেন, আর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভূমিকা কী? এ দুটোই দেখা দরকার। সূচনাতেই বিষয়টি চেপে না ধরলে ভবিষ্যতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে এ–জাতীয় কাজে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।

দেখা দরকার একটি কার্যক্রম শুরু হওয়ামাত্র জনপ্রতিনিধিদের কারও কারও বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ আসতে শুরু করল কেন? এর অনেক কারণ থাকতে পারে। অনেকের মতে, এ সংকট জোরদার হয়েছে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা দলীয়করণের ফলে। আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন ছিল নির্দলীয়। ২০০৯–এ বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পর্যায় পর্যন্ত সব স্তরে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করা হয়।

সিটি করপোরেশন ও জেলা পরিষদ বাদ দিয়ে এর নিচের স্তরের স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর নির্বাচন নির্দলীয় ভিত্তিতে হলে এগুলো সামাজিক প্রতিষ্ঠানের রূপ পেত। সব দল–মতের লোকের অংশগ্রহণ থাকত এগুলোতে। আর নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও নিজেদের দলীয় পরিচয়ের বাইরে থেকেই কার্যক্রম চালাতেন। নির্বাচনও হতো অনেক বেশি অংশগ্রহণমূলক ও বিতর্কের ঊর্ধ্বে। দলীয় প্রক্রিয়ায় নির্বাচনে মনোনয়নের জন্য বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় আজ একটি ওপেন সিক্রেট বিষয়। সে ব্যয়ভার তাঁদের কেউ কেউ কর্মক্ষেত্র থেকে তুলতে চাইবেন। আর এর প্রভাব ত্রাণ ও পুনর্বাসনসহ সব কাজে পড়তে পারে। ত্রাণ বিতরণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর ইউনিয়ন পরিষদ। এটি দলীয়করণ হয়েছে। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্বাচনে জিতলেনও ক্ষমতায় থাকা দলের মনোনীতরাই। তাঁরা ভাবেন, দুর্নীতির কারণে সাময়িক অসুবিধা হলেও দলীয় আনুগত্য তঁাদের পরিত্রাণ ঘটাবে। একটি দায়মুক্তির বোধ তাঁদের মধ্যে রয়েছে।

দুদক সম্পর্কেও দুটো কথা এখানে রয়ে যায়। এ সংকটে যারা রাষ্ট্রের দায়িত্বে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে, আত্মসাৎ করেছে ত্রাণসামগ্রী, তাদের অপরাধ দুদক আইনের অন্তর্ভুক্ত। আপনাদের গর্জন আমরা শুনেছি। কিছুটা বর্ষণও করুন। আমরা চাই দুদকের আওতা ও ক্ষমতার বিন্দুমাত্র হানি না করে তাদেরই পরামর্শে এ–জাতীয় অপরাধ দ্রুত তদন্ত ও বিচারের ব্যবস্থা হোক। সরকার প্রধান ত্রাণসামগ্রী বিলিবণ্টনে অনিয়মে জিরো টলারেন্স দেখানোর কথা বলেছেন। আমরা এ বক্তব্যের ওপর আস্থা রাখতে চাই। তা করতে হলে দলীয় আবরণের কিছু তৃণমূল জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্টদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনা হোক। আর তৃণমূলের স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে দলীয় নির্বাচনভিত্তিক ব্যবস্থা থেকে মুক্তি দেওয়া হোক।

আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব