প্রথাগত পদ্ধতিতে পরিস্থিতি সামলানো যাবে না

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

প্রতিটি উপমহাদেশের শুধু নয়, প্রতিটি দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এশিয়ার সঙ্গে আফ্রিকার যেমন মিল নেই, তেমনি বাংলাদেশের সঙ্গে ইরানের, তুরস্কের বা সুইজারল্যান্ডের কোনো সাযুজ্য নেই। করোনার মতো অস্বাভাবিক ও অচিন্তনীয় মহামারির প্রাদুর্ভাবে তুরস্ক, ফ্রান্স, ব্রিটেন, ইতালি, স্পেন যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, বাংলাদেশের ব্যবস্থা হতে হবে তাদের থেকে অন্য রকম। তা ছাড়া অস্বাভাবিক ও অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে প্রথাগত ও প্রচলিত ব্যবস্থা ফলপ্রসূ হয় না। করোনা রোগটি যেহেতু অভিনব ও অদ্ভুত, করোনা উদ্ভূত পরিস্থিতিটিও অস্বাভাবিক, সুতরাং এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রথাগত ব্যবস্থার বাইরেও অপ্রথাগত ও অগতানুগতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং তার কোনো বিকল্প নেই।

যানজটের রাজধানী নগরী ঢাকার রাস্তার ট্রাফিক সিগন্যালগুলোতে ১০ থেকে ২০-২৫ মিনিট পর্যন্ত যানবাহনকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। প্রতিটি সিগন্যালে অন্তত ২০টি শিশু, কিশোর-কিশোরী, নারী ও পুরুষ তাদের বিভিন্ন পণ্য নিয়ে গাড়ির যাত্রীদের কাছে ছোটে। ছেলেরা কামরাঙা, শসা, আমড়া প্রভৃতি ফল লবণ-মরিচের গুঁড়া মাখিয়ে বিক্রি করে, মেয়েরা রান্নাঘরের হাঁড়ি-পাতিল ধরার এটা-ওটা, কেউ বিক্রি করে খেলনা, বেলুন প্রভৃতি, কেউ পানির বোতল এবং ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বিক্রি করে ফুল। রোদ নেই, ঝড়-বাদলা নেই, তারা থাকে সড়কে। কোলের সন্তানকে সড়কদ্বীপে শুইয়ে রেখে তাদের কেউ পণ্য নিয়ে এক গাড়ির জানালা থেকে আরেক গাড়ির যাত্রীর দিকে ছোটে, এদের মতো ফেরিওয়ালা ইউরোপের রাস্তায় দেখা যায় না। শুধু ঢাকাতেই এদের সংখ্যা পাঁচ লাখের ওপর।

এই মহানগরী এক মাসেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে যেত, যদি আমাদের চিত্রশিল্পী বন্ধু রফিকুন নবীর ভাষায় টোকাইরা না থাকত। ওরা তো আমাদের চেয়ে বড় পরিবেশকর্মী। সূর্য ওঠার আগে ওরা পিঠে বস্তা নিয়ে অভুক্ত অবস্থায় রাস্তায় নামে। রাতে শুয়ে থাকে পথচারী পারাপার সেতুতে কিংবা ওভারব্রিজের নিচে, দোকানের বারান্দায় অথবা সুয়ারেজের পাইপের ভেতরে। ওরা শিশি-বোতল, ছেঁড়া কাগজের টুকরা, শীতল পানীয়র ক্যান, পলিথিন ব্যাগ, পরিত্যক্ত বলপয়েন্ট কলম প্রভৃতি কুড়িয়ে পেটের ভাতই জোগাচ্ছে না, অর্থনীতিতেও রাখছে অবদান। পরিবেশকে রাখছে বসবাসযোগ্য। লালবাগ ঢাল, আমলিগোলা, কামরাঙ্গীরচরে খোঁজ নিয়ে শুনেছি, সেই টোকাইদের সংখ্যা লাখ তিনেকের বেশি। করোনা সংকটের পর থেকে ফেরিওয়ালা, টোকাই প্রভৃতি কীভাবে বেঁচে আছে, তা আমরাও জানি না, আমাদের রাষ্ট্রেরও জানার কথা নয়।

ঢাকায় পুরোনো খবরের কাগজ, পরিত্যক্ত হাঁড়ি–পাতিলের ফেরিওয়ালা লাখখানেকের বেশি। তাঁরা দিন এনে দিন খান। অলিতে–গলিতে গৃহিণীদের কাছে ছাই বিক্রি করেন, এমন দুস্থ নারী কয়েক হাজার। ছাই তাঁদের কিনে আনতে হয় বউভাত ইত্যাদির অনুষ্ঠানের বিরিয়ানি, রেজালা, রোস্ট রান্নার বাবুর্চিদের থেকে। সেসব অনুষ্ঠান হচ্ছে না, ছাইওয়ালির রোজগারও বন্ধ। ফুটপাতে চা-বিস্কুট-কলা ও ঝালমুড়ি বিক্রি করে জীবন ধারণ করেন পাঁচ লাখ নারী-পুরুষ। তাঁরা উপার্জনহীন। জামাকাপড়, জুতা-স্যান্ডেলের ফেরিওয়ালাদের কথা বাদই দিলাম। তাঁরা দেশের বাড়িতে চলে গেছেন। সেখানে তাঁরা কীভাবে দিন পার করছেন, তা শুধু তাঁরাই জানেন।

যাঁদের আমরা ছিন্নমূল মানুষ বলে অবহেলা করি, তাঁরাও জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখেন। তাঁদের সেই অবদানের কথা তাঁরাও জানেন না, আমরাও স্বীকার করি না। রিকশাওয়ালাদের বহু রকম ‘সমবায় সমিতি’ আছে। সেই সব সমিতির নেতারা সন্ধ্যাবেলা কোঁচড় ভর্তি করে বাড়িতে টাকা নিয়ে যান। সিটি করপোরেশনে তাঁদের জবাবদিহি নেই। তাঁদের এখন ভূমিকা কী?

করোনা পরিস্থিতির পর থেকে সরকার যেসব প্রণোদনার কথা ঘোষণা করেছে, ক্রিয়া পদের কাল হিসেবে তার সবই ফিউচার টেনসে। ভবিষ্যতে করব, করা হবে ইত্যাদি। প্রতিদিন অব্যাহত বলা হচ্ছে এক কোটি লোককে সরকার খাওয়াবে। কী খাওয়াবে, ভাত-মাছ না ডাল-রুটি, দিনে একবার না দুবার, সে সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু জানা যায়নি। গত ৩০ দিনে মোট কত মানুষকে খাওয়ানো হয়েছে, তারও কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া সেই এক কোটি লোক কারা, কোন ইউনিয়নে কতজন, তার তালিকা কার কাছে আছে, আমাদের জানার সুযোগ হয়নি। গত এক মাসে পৌরসভাগুলোর কমিশনার এবং ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বারদের কী কী কাজে লাগানো হয়েছে, তা খবরের কাগজ থেকে জানা যায়নি।

১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষের সময় থেকে সরকারি কর্মকর্তা ও লোকাল গভর্নমেন্টের প্রতিনিধিদের যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণের পদ্ধতি, তা দিয়ে বর্তমান অস্বাভাবিক পরিস্থিতি মোকাবিলা সম্ভব নয়। তাঁরা খুব বেশি হলে জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, বন্যাদুর্গতদের ত্রাণ দিতে পারেন। এবং সেই ধরনের ত্রাণ বিতরণে যে ৫০ ভাগের বেশি দুর্নীতি হবে, তা অবধারিত। এখন মিডিয়া তত্পর বলে কিছু ধরা পড়ছে। সরকারি দলের নেতাদের ঘরের মেঝের নিচে গরিবের চালের বস্তা, খাটের নিচে ভোজ্যতেলের বিপুল মজুত, টিসিবির ডিলারের অপকীর্তি, এসব বর্তমান পদ্ধতিতে খুবই স্বাভাবিক। দেশব্যাপী বিপুল ত্রাণ তত্পরতা প্রচলিত ও প্রথাগত পদ্ধতিতে চালানো সম্ভব হবে না।

টোপলায় চাল, তেল বিতরণের যে দৃশ্য টেলিভিশনে দেখা যাচ্ছে, তা যথারীতি চলতে থাকুক। কিন্তু লাখ লাখ ছিন্নমূল অভুক্ত মানুষকে বাঁচানোর জন্য অন্য উপায়ও অবলম্বন করতে হবে। ঢাকায় অন্তত রান্না করা খাবার বিতরণের ব্যবস্থা না করলে শিশুসহ বহু মানুষ অনাহারে মারা যাবে। সে জন্য প্রতি ওয়ার্ডে চার-পাঁচটি জায়গায় প্রতিদিন খিচুড়ি রান্না করে দুস্থদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা অবিলম্বে নেওয়া দরকার। এই মুহূর্তে ওয়ার্ড কমিশনারদের প্রধান কাজ হওয়া উচিত সেটাই। রান্না করা খাবারের ব্যবস্থা করা হলে সাধারণ সচ্ছল মানুষেরাও তাদের সাধ্যমতো শরিক হবেন।

প্রথাগত চিন্তা ও গতানুগতিক পদ্ধতিতে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায় না। মানুষের জন্য কিছু করার সুযোগও প্রতিদিন পাওয়া যায় না। বিশেষ সময়ে, বিশেষ পরিস্থিতিতে সে সুযোগ আসে। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করার মধ্যে যে আত্মতৃপ্তি, তা থেকে যে বঞ্চিত হয়, সে খুব বড় হতভাগা। মানুষ হিসেবে তার মূল্য নেই। যেকোনো ইতর প্রাণীর সঙ্গে তার বিশেষ পার্থক্য নেই। আজ করোনার পরিস্থিতি মানুষের মনুষ্যত্ব প্রমাণের সুযোগ করে দিয়েছে।

সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক ও গবেষক