প্রণোদনা থেকে কৃষক আসলে কী পাবে?

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

১২ এপ্রিল ‘কৃষি খাতে বিশেষ প্রণোদনামূলক পুনঃঅর্থায়ন স্কিম’ শীর্ষক পাঁচ হাজার কোটি টাকার একটি প্রণোদনা ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। ওই দিন ৫ শতাংশ সুদের কথা বলা হলেও পরদিন ৪ শতাংশ সুদের হার ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি সার্কুলার প্রকাশ করে। শস্য ও ফসল খাত ছাড়া কৃষির অন্য কয়েকটি খাতের ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকের জন্য এ প্রণোদনা দেওয়া হলেও এতে কৃষক কতটুকু সুফল পাবেন, তা নিয়ে সংশয়ের যথেষ্ট অবকাশ আছে।

প্রণোদনা ধান ও সবজিচাষিদের জন্য নয়
এ ঋণ বিতরণ করা হবে শস্য ও ফসল খাত ছাড়া কৃষির অন্য চলতি মূলধননির্ভরশীল খাতগুলোয়। যথা: হর্টিকালচার অর্থাৎ মৌসুমভিত্তিক ফুল ও ফল চাষ, মৎস্য চাষ, পোলট্রি, ডেইরি ও প্রাণিসম্পদ খাতে। অর্থাৎ, ধান, গম, ডাল কিংবা কোনো শাকসবজি চাষের জন্য এই স্কিমে ঋণ পাওয়া সম্ভব নয়। অবশ্য এর পেছনে বাংলাদেশ ব্যাংকের যুক্তি হচ্ছে, কৃষি ও পল্লিঋণের আওতায় ব্যাংকগুলোকে যে ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে, তার ‘৬০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা শস্য ও ফসল খাতে ঋণ বিতরণ করা সম্ভব হবে’। সরাসরি ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে ৯ শতাংশ এবং এনজিও ঋণ নিলে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ সুদ দিতে হয় এবং অধিকাংশ কৃষকই এনজিওর মাধ্যমেই ঋণ গ্রহণ করে থাকেন। অথচ কৃষকের জন্য এখন বিনা সুদে ঋণ এবং ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য নগদ অর্থসহায়তা অত্যন্ত জরুরি ছিল।

প্রণোদনার কতটুকু কৃষকের জন্য
ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষিদের জন্য এ প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে বলা হলেও এখানে কৃষক ছাড়াও ‘যে সকল উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান কৃষক কর্তৃক উৎপাদিত কৃষিপণ্য ক্রয়পূর্বক সরাসরি বিক্রয় করে থাকে, তাদেরকেও এ স্কিমের আওতায় ঋণ বিতরণের জন্য বিবেচনা করা যাবে।’ (বাংলাদেশে ব্যাংক) এবং একটি একক উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান কোনো ব্যাংক থেকে পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারবেন। কিন্তু অবাক করা বিষয় হচ্ছে, কৃষি ও পল্লিঋণ বিতরণের বর্তমান নীতিমালা অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৪৮ লাখ ৬৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ পাওয়া যাবে গাভি পালন খাতে, পাঙাশ মাছ চাষের জন্য ১১ লাখ ৮৪ হাজার ৭৫৯ টাকা ঋণ পাওয়া সম্ভব। ফুল ও ফল চাষের জন্য এ অঙ্ক আরও অনেক কম। এ ক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো, কৃষির যে খাতগুলোয় এই ঋণ দেওয়া হবে, তার ‘কোনো একক খাতে ব্যাংকের অনুকূলে বরাদ্দকৃত ঋণের ৩০% এর অধিক ঋণ বিতরণ করতে পারবে না।’ কিন্তু উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান এই শর্তের আওতায় কি না, সে সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে স্পষ্ট করা হয়নি। তবে সার্কুলারে যেহেতু এই শর্ত উল্লেখের পরই উদ্যোক্তাদের ঋণ পাওয়ার সুযোগের কথাটি উল্লেখিত হয়েছে, তাই এটি অনুমান করা যায় যে তাঁরা এই শর্তের আওতাভুক্ত নন। সে ক্ষেত্রে ৪ শতাংশ সুদে পাঁচ হাজার কোটি টাকার এই ঋণ প্রণোদনার সিংহভাগই যে কৃষক পাচ্ছেন না, তা খুব সহজেই অনুমেয়। বরং বোরোর এই মৌসুমে ফড়িয়া কিংবা মধ্যস্বত্বভোগীরাই এই ঋণের মাধ্যমে লাভবান হচ্ছেন কি না, এমন আশঙ্কাও অমূলক নয়। আর এমনটা হলে কৃষি খাতের এই প্রণোদনা যে কৃষকের বঞ্চনাকেই আরও ত্বরান্বিত করবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে আদৌ আগ্রহী হবে কি
পাঁচ হাজার কোটি টাকা এই ঋণ স্কিমের জন্য বাংলাদেশ ব্যাকের ঘোষিত নীতিমালা অনুযায়ী কোনো সরকারি–বেসরকারি ব্যাংক এই ঋণে বিতরণে বাধ্য নয় বরং ঋণ আদায়ের দায়ভার শতভাগ ঋণ বিতরণকারী ব্যাংকেরই। ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংককে এই অর্থ যথাসময়ে পরিশোধে ব্যর্থ হলে অতিরিক্ত ২ শতাংশ হারে সুদসহ এককালীন এই অর্থ পরিশোধ করতে হবে। এবং এ ঋণ বিতরণের উদ্দেশ্যে পুনঃঅর্থায়ন গ্রহণে ‘ইচ্ছুক’ ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে একটি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হবে। প্রতি অর্থবছরে ব্যাংকগুলোর জন্য ২ শতাংশ কৃষিঋণ বিতরণে বাধ্যবাধকতা থাকার পরও তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয় না। তাই প্রশ্ন থেকে যায় মাত্র ১৮ মাসের (৬ মাস গ্রেস পিরিয়ডসহ) মধ্যে গ্রাহক পর্যায়ে ও ব্যাংক পর্যায়ে ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা থাকায় ব্যাংকগুলো কৃষকদের মাঝে এই ঋণ বিতরণে কতটা আগ্রহী হবে! অথচ, ফুল ও ফলচাষি ছাড়া এ স্কিমের আওতায় ঋণ পাবেন, এমন অন্য চাষিরা কৃষি ও পল্লিঋণের চলতি নীতিমালায় ঋণ পরিশোধে ৩৬ থেকে ৫৪ মাস (গ্রেস পিরিয়ডসহ) সময় পান। ব্যাংকগুলো আসলে কৃষকের চেয়ে উদ্যোক্তাদের মধ্যেই ঋণটি বিতরণে বেশি আগ্রহী হবে কি না, এমন প্রশ্নও থেকে যায়।

কৃষিঋণ ও সার্টিফিকেট মামলার পরিহাস
কৃষিঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ার কারণে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত কৃষকদের বিরুদ্ধে করা সার্টিফিকেট মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬৩ হাজার ৪৮৫। ১৯৯১ সাল থেকে কৃষকদের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলা শুরু করে ব্যাংকগুলো। ২০১৫ সাল পর্যন্ত সরকারি মালিকানাধীন ছয়টি ব্যাংক ২ লাখ ৫ হাজার ৩৭২ জন কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা করে। তখন এই কৃষকদের কাছে ব্যাংকের পাওনা ছিল ৫৬০ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে এই পাওনা টাকার পরিমাণ ছিল ৫১৫ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ গড়ে মাত্র ৩০ হাজার টাকার জন্য এত বিপুলসংখ্যক কৃষকের নামে মামলা ঝুলছে। কৃষকের এই ঋণ পরিশোধ করতে না পারার পেছনে প্রধান কারণগুলো হচ্ছে, কৃষি উপকরণের দাম বাড়ায় ফসলের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, ফসলের লাভজনক দাম না পাওয়া ও দুর্যোগের কারণে ফসলহানি। বাংলাদেশ কৃষক সমিতির দীর্ঘদিনের দাবি, সব সার্টিফিকেট মামলা অবিলম্বে বাতিল করে কৃষককে এই ঋণের দায় থেকে মুক্তি দিতে হবে। করোনার এই দুর্যোগে এসে মাত্র ৫০০ কোটি টাকার এই ঋণ মওকুফই হতে পারত কৃষকের জন্য একটি প্রণোদনা।

এ মুহূর্তে কৃষককে টিকিয়ে রাখতে হলে
করোনাকালীন এই দুর্যোগে লকডাউনের কারণে পৃথিবীজুড়েই কৃষিপণ্য সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। আমাদের দেশে উত্তরাঞ্চলের বেশ কিছু জেলায় এ মুহূর্তে টমেটো ও কুমড়ো মাঠে পচে যাচ্ছে। টমেটো পাইকারি বিক্রি করতে হচ্ছে দেড় টাকা, দুই টাকায়। বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে, কিন্তু কৃষক লাভজনক দাম পাওয়া নিয়ে সন্দিহান। এ বছর বোরো ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা ২ কোটি ৪ লাখ মেট্রিক টন হলেও এবারের ধান উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে যাবে। অথচ সরকার মাত্র ছয় লাখ মেট্রিক টন (২ দশমিক ৯৪ শতাংশ) ধান কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি কিনবে। ২৬ টাকা কেজি দরে (১০৪০ টাকা মণ) এই ধান কেনার পাশাপাশি সাড়ে ১১ লাখ টন চালও কিনবে, যাতে কৃষকের কোনো স্বার্থ নেই বরং চাতালমালিক ও মিলাররাই এতে লাভবান হবেন। আবার বিভিন্ন সিন্ডিকেট ও অনিয়মের কারণে সরকারিভাবে সামান্য পরিমাণ ধান কেনার সুফলও কৃষক পুরোপুরি পান না। তাই বাধ্য হয়ে তাঁকে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে কাঁচা ধান বিক্রি করে দিতে হয়। অথচ, এ বছর পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার মোট উৎপাদিত বোরো ধানের (আড়াই কোটি মেট্রিক টন) ২২ শতাংশ কৃষকের কাছ থেকে কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এই দুর্যোগকালেও ধানের লাভজনক দাম নিশ্চিত করা না গেলে আগামী আমন-আউশ মৌসুমে অনেক কৃষকেরই ধান চাষের আগ্রহ কিংবা সামর্থ্য থাকবে না। এতে সামনের কঠিন দিনগুলোয় আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা চরম হুমকিতে পড়ে যাবে। কারণ, ইতিমধ্যে ভারত ও ভিয়েতনামের মতো শীর্ষ চাল রপ্তানিকারক দেশগুলো তাদের মজুত সংরক্ষণের জন্য রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। বিশ্বের প্রায় সব দেশই এ মুহূর্তে রপ্তানির চেয়ে নিজেদের মজুতকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। তাই কৃষককে প্রণোদনা দিতে চাইলে অবিলম্বে সরকারিভাবে ইউনিয়ন পর্যায়ে ক্রয়কেন্দ্র চালু করতে হবে এবং ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা বহুগুণে বাড়াতে হবে। সরকার এই আকালের সময় এসেও যদি কৃষকের ধান কেনায় গড়িমসি করে এবং কৃষকের কষ্টার্জিত ফসলের দাম নিশ্চিত না করে মধ্যস্বত্বভোগীদের জন্য মুনাফা হাতিয়ে নেওয়ার রাস্তা প্রশস্ত করে রাখে, তবে এ কথা নিশ্চিত বলে দেওয়া যায়, সামনের দিনে দেশের জনগণের জন্য চরম দুর্ভোগ অপেক্ষা করছে। সম্ভাব্য খাদ্য–সংকটের দিনগুলোয় চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার স্বার্থেও সরকারের উচিত সিংহভাগ ধান কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি কেনা। কিন্তু সরকার কৃষকের জন্য ঘোষিত প্রণোদনাতেও কৃষকের চেয়ে মধ্যস্বত্বভোগীদের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। তবু আমাদের কথা বলে যেতে হবে, নিজেদের খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থেই আমাদের কথা বলতে হবে কৃষকের পক্ষে। শেষ দম পর্যন্ত কৃষকের পক্ষে লড়াই করা ছাড়া আমাদের সামনে কোনো বিকল্প নেই। জীবনের চেয়ে মুনাফাকে প্রাধান্য দেওয়ার নীতিকে গুঁড়িয়ে দিতে হবেই।

লাকি আক্তার: নির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ কৃষক সমিতি
[email protected]