ড. সা'দত: জাঁদরেল আমলার প্রতিকৃতি

ড. সা’দত হুসাইন
ড. সা’দত হুসাইন

ড. সা’দত হুসাইনের মৃত্যুর খবর শুনে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আচমকা স্মৃতির ঝাঁপি খুলে যায়। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে পেশাগত কারণে এমন জাঁদরেল আমলার মুখোমুখি হয়েছি। প্রাথমিক ও গণশিক্ষাসচিব ছিলেন, পরে শিক্ষাসচিব। এই সুবাদে তাঁর কাছে যাওয়া শুরু। প্রথম দিকে শিক্ষা নিয়ে কাজ করতাম। সাংবাদিকতার কারণেই তাঁর কাছে যেতে হতো। দুরুদুরু বুকে তরুণ বয়সে তাঁর কক্ষে ঢুকতাম। রাশভারী কণ্ঠে বসতে বলতেন। এরপর বলতেন, ‘বলো কী জানতে চাও।’ কথা শুরু হলে রং চা আর নোনতা বিস্কুট।

সাংবাদিকতা জীবনে অনেক পদস্থ সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে কাজ করেছি। কিন্তু মনে রাখার মতো গুটি কয়েক কর্মকর্তার একজন তিনি। তাঁকে মনে হতো শিক্ষক। যতটুকু তথ্য দেওয়ার, তা দিয়ে দিতেন। সবচেয়ে কঠিন ছিল তাঁর রুমে ঢোকা। তাই একবার ঢুকতে পারলে সহজে বের হতে চাইতাম না। ইনিয়ে-বিনিয়ে কত বেশি সময় থাকা যায়। তিনি কথা বলতেন, আর ফাইল দেখতেন। তাঁর কনিষ্ঠদের দেখতাম ভয়ে ভয়ে সামনে ফাইল নিয়ে আসতে।

একজন তরুণ রিপোর্টার হিসেবে তাঁর মতো সিএসপি কর্মকর্তার কাছ থেকে তথ্য বের করা ছিল প্রায় দুঃসাধ্য বিষয়। তিনি যতটুকু দেবেন, তার বাইরে যতই চেষ্টা করা হোক সাধারণত কিছু পাওয়া যেত না। তবে যেটুকু দিতেন, তার সংবাদমূল্য ছিল অনেক। সব সময় ইঙ্গিতপূর্ণ তথ্য দিতেন। কখনো কোনো কাগজ দিতেন না। তারপরও তাঁর মুখের কথার ওপর অসংখ্য প্রতিবেদন তৈরি করেছি।

থাইল্যান্ডের জমতিয়েনে ১৯৯০ সালে অনুষ্ঠিত শিক্ষা বিষয়ে প্রথম বিশ্ব সম্মেলনে সবার জন্য শিক্ষা এবং সেনেগালের রাজধানী ডাকারে দ্বিতীয় শিক্ষা সম্মেলনের প্রাপ্তিসহ শিক্ষার নানা বিষয়ে তাঁর কাছ থেকে তথ্য, অভিজ্ঞতা ও ধারণা পেয়েছি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শিক্ষা নিয়ে ওই সময়ের হইচই যদিও এখন আর নেই। সবার জন্য শিক্ষা, বাধ্যতামূলক শিক্ষা, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা, বয়স্ক শিক্ষা—এসব বিষয় থেকে সরকারের দৃষ্টি অন্যদিকে সরে গেছে। ড. সা’দত যখন শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষাসচিবের দায়িত্বে ছিলেন, তখন এই বিষয়গুলো দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় থাকা শিক্ষার এসব বিষয় এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি।

ড. সা’দাত যেখানে কাজ করেছেন, সেখানেই পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছেন। তাঁর শেষ কাজ ছিল সরকারি কর্মকমিশনে (পিএসসি) পরিবর্তন আনা। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের সময়ে অনিয়ম, দুর্নীতিতে পিএসসির ভাবমূর্তি যখন প্রায় শূন্যের কোটায়, তখনই চেয়ারম্যান হিসেবে এর হাল ধরেন তিনি। এতে স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণ অনেকটাই কমে যায়। পিএসসির স্বচ্ছ ভাবমূর্তি ফিরে আসে। পিএসসির চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় তিনি গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনায় আসেন। ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর ওই বছরের মে মাসে তাঁকে পিএসসির চেয়ারম্যান (২০০৭-২০১১) করা হয়। যোগ দিয়েই তিনি ২৭তম বিসিএস পরীক্ষার ফলাফল বাতিল করেন। শুরু হয় বিতর্ক, যা শেষ হবে না কোনো দিনও। চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করার পর সেই ফল আবার বাতিল করেন। নতুন করে মৌখিক পরীক্ষা নেন। আগের ফলে যাঁরা বাদ পড়েন, তাঁরা মামলা ঠুকে দেন। এতে নতুন ফলাফলে উত্তীর্ণদের নিয়োগ অস্বাভাবিক বিলম্ব হয়। এরপর অবশ্য ২৮, ২৯ ও ৩০তম বিসিএস পরীক্ষায় অনেকটাই নিয়ম–নীতি ফিরে আসে।

বিসিএস পরীক্ষা মানে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, আর্থিক লেনদেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস—জোট আমলের শেষ দিকে (২০০৪, ২০০৫) পিএসসির সেই চেহারা তিনি পাল্টে দেন। একবার তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘কটা দিন সবুর করো। রোজ রোজ তোমাকে আর লাল রঙের লিড নিউজ করতে হবে না।’ উল্লেখ্য, জোট সরকারের শেষভাগে পিএসসি হয়ে উঠেছিল দুর্নীতির আখড়া। স্থবির হয়ে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। তখন প্রথম আলোয় টানা কয়েক দিন লিড নিউজ ছাপা হয়। প্রায় প্রতিদিনই প্রথম পাতায় পিএসসি নিয়ে নিউজ ছাপা হতো।

সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে (২০০৭-২০০৮) ড. সা’দত অনেকটাই স্বাধীনভাবে কাজ করেছেন। পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক সরকারের সময়ে চাপের মুখে পড়েন। একপর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার চাইছিল তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করুন। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি তাঁকে চায়ের দাওয়াত দিয়েছিলেন। তাঁর বাসার নিরাপত্তা শিথিল করা হয়। কিন্তু সব চাপ উপেক্ষা করে সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। এর কারণ ছিল তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং সততা। সব সময় তাঁকে মনে হয়েছে পেশাদার আমলা। রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি না করেই সরকারের দায়িত্ব পালন করেছেন, যেটি এখন অনেকটাই বিরল দৃষ্টান্ত।

২০০৯ সালে নতুন সরকার দায়িত্ব নিয়ে সরকার সমর্থক বলে পরিচিত তিনজন সদস্যকে পিএসসিতে নিয়োগ দেয়। শুরুর দিকে ড. সাদাত তাঁদের পিএসসিতে বসতে পর্যন্ত দেননি। তাঁরা কাজ পাননি। এ নিয়ে পিএসসিতে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল। এখন পিএসসিতে পরিবর্তনের যে ধারা, তা শুরু করেছিলেন ড. সা’দত।

টুকরো টুকরো অসংখ্য স্মৃতি এ মানুষটি ঘিরে। বুধবার রাতে মৃত্যুর পর ফেসবুকে তাঁকে নিয়ে যে শ্রদ্ধার ঢল ও যত স্মৃতিচারণা দেখলাম, তাতে মন ভরে যায়। একজন আমলা সব শ্রেণি-পেশার মানুষের এত কাছাকাছি আসতে পারেন, এটা বিস্ময়কর। তিনি সংবাদপত্রে কলাম লিখেছেন, বই লিখেছেন, টক শো করেছেন। গণমাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন পরিচিত মুখ। মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ভারতে গিয়ে প্রবাসী সরকারে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন ‘মুক্তিযুদ্ধের দিন-দিনান্ত’, আছে আরও কয়েকটি গ্রন্থ। আর্থিক কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন—এমনটা শুনিনি। জানাশোনা ও পড়াশোনা ছিল প্রচুর। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, অর্থনীতির ছাত্র ছিলেন। যুক্ত ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে। ১৯৮৭ সালে পিএইচডি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৯৭০ সালে সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানে (সিএসপি) যোগ দেওয়া এই কর্মকর্তা আমলা হিসেবে সুনামের সঙ্গে চাকরি থেকে অবসর নেন।

নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে তিনটি সরকারের সময়ে তাঁকে দায়িত্ব পালন করতে দেখেছি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রাথমিক ও গণশিক্ষাসচিব এবং শিক্ষাসচিব হিসেবে তাঁকে পাই। স্বরাষ্ট্রসচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ২০০১ সালে জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর মন্ত্রিপরিষদ সচিব (২০০২-০৫ সালে) নিযুক্ত হন।

ড. সা’দত সব সময় সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির সংস্কার চাইতেন। তাঁর যুক্তি ছিল—সাধারণ ছেলে মেয়েদের মধ্যে মেধাবীরাই যেন সরকারি চাকরি পান। তাঁর সেই স্বপ্ন অনেকটাই বাস্তবায়িত হয়েছে। এখন কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সরকারি চাকরিতে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ হচ্ছে।

এখনকার বড় আমলাদের অনেকেই অবসরে গিয়ে জনপ্রতিনিধি হতে চান। রাজনীতি করতে চান। অথবা অবসরের পর সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হয়ে কোনোমতে সময় পার করতে চান। অনেকেই আবার নানা প্রশ্ন ও বিতর্কের জন্ম দেন। তাঁরা একসময় হারিয়েও যান।

তবে জীবনভর সরকারি চাকরি করে, দায়িত্বশীল পদে থেকে হারিয়ে যাওয়াটা কাম্য নয়। যেমনটি হারিয়ে যাননি ড. সা’দত হুসাইন, ড. আকবর আলি খান, আলী ইমাম মজুমদারসহ কয়েকজন। আমলাতন্ত্রের মধ্যে আমরা এমন মুখ খুঁজতেই থাকব, যাঁরা অবসরে গিয়েও মানুষের কথা বলবেন এবং মানুষের সঙ্গে থাকবেন।

কানে বাজে সেই কথা—তুমি তো বাসায় আসলে না। তাঁর বাসা ছিল শহরের এক প্রান্তে। ওখানে যেতে হলে এক দিন না হলেও এক বেলা পুরো সময় নিয়ে যেতে হয়। সেই সুযোগটা আর হয়ে ওঠেনি। সহকর্মীদের কেউ তাঁর কাছে গেলে আমার কথা বলতেন। একটু বুঝতাম, তিনি আমাকে পছন্দ করতেন। আমারও গভীর শ্রদ্ধা ছিল তাঁর প্রতি। কিন্তু দুঃখিত জনাব, করোনা পরিস্থিতির কারণে আপনার জানাজায়ও অংশ নিতে পারলাম না। সাংবাদিকতা করতে গিয়ে আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু জেনেছি, শিখেছি। আমলাতন্ত্রের মধ্যে এমন অনেক সা’দত হুসাইনের আরও জন্ম হোক।

শরিফুজ্জামান, হেড অব রিপোর্টিং, প্রথম আলো।