গ্রামশক্তি জাগালে গ্রামই বাঁচাবে

গ্রামশক্তি
গ্রামশক্তি

রাতের অন্ধকারে ওরা বেরিয়েছে। কুড়িগ্রামের রাজারহাটের বোতলার পাড় গ্রাম। ঘুটঘুটে অন্ধকারে অটোরিকশা ঘুরছে বাড়ি বাড়ি। ঠিক বাড়ি না, বাড়ি থেকে দূরে থামে। খাদ্যের থলে হাতে কয়েকজন গিয়ে গোপনে দিয়ে আসে। অর্থ জোগানো হয়েছে কিন্তু প্রকাশ্যে। ২২ এপ্রিল রাতে প্রথম ১০৭টি বাড়িতে খাদ্যসহায়তা দেওয়া হয়। অর্থদাতার তালিকা বাড়ছে, বাড়ছে সহায়তা পাওয়া মানুষের তালিকাও। তরুণদের পণ, বোতলারপাড়ে কেউ যাতে না খেয়ে না থাকে। শুধু এক মাসের জন্য নয়, তাঁদের পরিকল্পনা অনাগত দিনের জন্যও। জনস্বাস্থ্য সচেতনতাও তাঁদের কাজের অংশ।

শুরু হয়েছে সবজি চাষ। শাক হতে লাগে ২০ থেকে ২৫ দিন, পেঁপে ৫০ দিনে খাওয়া যায়। রাস্তার দুই ধারে লাগানো হবে অরহড় ডালের গাছ। এতে নতুন করা রাস্তাও সুরক্ষা পাবে। ধান উঠলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধান সংগ্রহ করা হবে। এই ধান চাতালে দিলে তারা চাল দিয়ে দেবে। সেই চাল খাদ্যসহায়তায় বিতরিত হবে মেম্বরদেরও জড়িত করা হচ্ছে তালিকা তৈরির জন্য।

কুড়িগ্রাম দেশের দরিদ্রতম জেলা, রাজারহাট দরিদ্রদের মধ্যে দরিদ্রতর। যাঁরা পারছেন তাঁরা দিচ্ছেন, আর দিচ্ছেন শহরে থাকা ওই গ্রামের মানুষেরা। তাঁরা হয়তো গ্রামে খুব কম আসেন, কিন্তু গ্রামের কাজে লাগতে পেরে সার্থক বোধ করছেন। একজন তো বললেন, যত দিন বেতন পাব, আমি দিয়ে যাব। দরিদ্র জেলার দরিদ্র একটি গ্রাম যদি এভাবে তার সব প্রতিবেশীর দায়িত্ব নিতে পারে, তুলনায় যেসব জেলা সমৃদ্ধ, সেখানে তো আরও অনেক কাজ হওয়ার কথা। সেই পথই দেখাচ্ছেন বোতলারপাড় গ্রামের তরুণেরা। আন্তরিকতার এই শক্তিকে বলে সামাজিক পুঁজি। উত্তরবঙ্গে এই পুঁজি এখনো ব্যাপক।

‘বোতলার পাড় সুরক্ষা কমিটি’
আমাদের এ উদ্যোগের সাংগঠনিক রূপ ‘বোতলার পাড় সুরক্ষা কমিটি’। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহাবুল ইসলাম এর আহ্বায়ক, ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম সদস্যসচিব। অন্য সব কর্মী সেই কমিটির সদস্য। রংপুর সরকারি কলেজের শিক্ষক আপেল মিত্র সার্বক্ষণিক সহায়তায় আছেন। কমিটির ছেলেরা গ্রামে কোথাও জটলা–আড্ডা দেখলে বুঝিয়ে বলছেন। গ্রামের প্রবেশপথেও আছে তাঁদের নজর। ঢাকা–নারায়ণগঞ্জ থেকে যাঁরা আসছেন, তাঁরা যাতে বাড়িতেই থাকেন, সেদিকে খবর রাখছেন।

অসহায় ও সামর্থ্যবানদের তালিকা প্রণয়ন
পাড়াভিত্তিক তরুণেরা নিজ নিজ পাড়ার ঘরের খবর জানেন। অসহায়দের তালিকার পাশাপাশি সামর্থ্যবানদের তালিকাও এখন তাঁদের হাতে। কয়েক দিন পরই ধান কাটা শুরু হবে। অভাবীদের মধ্যে যাঁরা ধান কাটার কাজে থাকবেন, তাঁদের নাম তালিকা থেকে সাময়িক বাদ রাখব। আবার যখন দরকার, তখন তাঁদের সহায়তা দেব। পরিবারের সদস্য অনুপাতে সহায়তা দেওয়া হবে। দরকার না থাকলে তাঁরাও আপাতত বাদ থাকবেন। সরকারি ত্রাণের সঙ্গে এই সহায়তা সমন্বয় করা হচ্ছে। উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, সেনাবাহিনীসহ সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো চাইলে এই গ্রামের প্রকৃত চিত্র কমিটির মাধ্যমে জানতে পারবে।

গ্রামশক্তি
গ্রামশক্তি

অর্থ সংগ্রহ
সামর্থ্যবানদের তালিকা ধরে আমি এবং ওই গ্রামের বাসিন্দা রংপুর অঞ্চলের বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির সহকারী আঞ্চলিক বীজ প্রত্যয়ন কর্মকর্তা কষিবিদ নুরুজ্জামান দুজন মিলে অনেকের কাছে ফোন করেছি আর্থিক সহায়তা চেয়ে। একজনও না করেননি। প্রত্যেকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। শুধু একবার দিলেই হবে না। যত দিন সমস্যা দূর না হবে, তত দিন এটা চালিয়ে যেতে হবে। কলেজশিক্ষক রেজাউল করিম, বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা রাকিব সিদ্দিকী, সাবেক সেনা কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম, সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা আবদুল লতিফ, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা নায়েব আলী, বাংলাদেশ পুলিশের সার্জেন্ট রাশেদুল ইসলাম, বিদ্যুৎ বিভাগের প্রকৌশলী আনোয়ারুল ইসলাম, রংপুর সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী রাশেদুজ্জামানসহ যাঁদের কাছে ফোন করেছি, তাঁরা সবাই আগ্রহ নিয়ে অর্থ প্রদান চালু রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কয়েক দিন পর ঘরে ঘরে ধান উঠবে। অবস্থ বুঝে আমরা গৃহস্থদের থেকেও ধান নেব।

সবজিচাষের শুরু
গ্রামে যেন সামান্য জমিও অনাবাদি পড়ে না থাকে, সে বিষয়েও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। আমরা সংগঠন থেকে বীজ রোপণের ব্যবস্থা করছি। সংকট দীর্ঘায়িত হলে যেন গ্রামেই যথেষ্ট সবজি মজুত থাকে। আমরা এক-দেড় হাজার পেঁপের চারা, এক থেকে দেড় হাজার মরিচের চারা, পর্যাপ্ত সবজি, পুঁইশাকসহ বিভিন্ন শাক, অরহর ডাল চাষের উদ্যোগ নিয়েছি। এই বীজ এবং চারার জন্য ফোন করেছিলাম রাজার হাট উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পদক রাজজীবন কুণ্ডুকে। তিনি শুনে উদ্যোগের প্রশংসা করে বললেন যত টাকা লাগে তিনি দেবেন। আমাদের এই উদ্যোগের কথা শুনে বোতলারপাড় গ্রামে বাসিন্দা বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা নায়েব আলী বললেন, ‘আমি খাদ্যসহায়তার জন্য যতদিন টাকা দিতে হয় দেব। গ্রামে আমার একটি জমি আছে সেখানে তোমরা প্রয়োজনমতো সবজি চাষ করো গরিবদের জন্য।’

মুঠোফোনেই সব যোগাযোগ
যুগটাই মুঠোফোনের। তাই সভা আহ্বানেরও খুব প্রয়োজন হচ্ছে না। আমরা যেটুকু কাজ করেছি, তা সভা না করেই। গ্রামে যে দু-চারজন একসঙ্গে হচ্ছেন, তাঁরাও বিধি মেনে কাজ করছেন। আমাদের যোগাযোগ হচ্ছে সার্বক্ষণিক। আমরা অর্থ সংগ্রহের জন্য একটি বিকাশ নম্বর ঠিক করেছি। সততা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে যাতে কাজটি পরিচালিত হয়, সেদিকটিতে মনোযোগ দিয়েছি।

নিম্নমধ্যবিত্তদের জন্য করণীয়
করোনা সংকটে অনেক বড় বিপদে পড়বে নিম্নœমধ্যবিত্ত মানুষ। এই মানুষদের খবর নিকটজনদের মাধ্যমেই জানতে হবে। নয়তো এই বিপদে পড়া মানুষদের চেনা যাবে না। যদি গ্রাম গ্রামের সহায়ক শক্তি হয়ে উঠতে পারে, তাহলে এই সংকট থেকে রক্ষা পাওয়া সহজ ও সম্ভব হবে।

দেশব্যাপী আহ্বান
সারা দেশ গ্রাম দিয়ে গ্রামের সমস্যা দূর করার উদ্যোগ নিতে পারলে দ্রুতই ফল পেতে পারি। মাত্র তিন দিনেই বদলে যেত পারে সার দেশের চিত্র। গ্রামের একজন মানুষও ত্রাণের দাবিতে সড়কে নেমে আসবে না। এ কথা ঠিক, সরকারকেই সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। সেই সঙ্গে গ্রামে গ্রামে যদি এ রকম উদ্যোগ গ্রহণ করা সম্ভব হয়, তাহলে আমরা বড় বিপদও পাড়ি দিতে পারব। গ্রামের সাধারণ মানুষ হয়তো চিকিৎসাসেবা দিতে পারবে না। কিন্তু যাতে সহজেই চিকিৎসা পেতে পারে, যাতে রোগ না ছড়ায়, যাতে গ্রাবাসী আতঙ্কিত না হয়, যাতে ক্ষুধার মতো অভিশাপ গ্রাস না করে, সেই কাজে তো এগিয়ে আসতে পারবে। বিশেষত ক্ষুধা দূরীকরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারবে। অভাব-অনটনে চুরি-ডাকাতিসহ অনেক সামাজিক অপরাধ রোধেও এ উদ্যোগ বড় ভূমিকা রাখতে পারবে।

মানুষই জিতবে
যখন অসহায় মানুষের ত্রাণের টাকা চুরি হচ্ছে ঠিক তখনি কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার বোতলার পাড় গ্রাম একটা দৃষ্টান্ত। আমরা মনে করি এই দৃষ্টান্ত সারা দেশের মানুষের গ্রহণ করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। দেশের সবচেয়ে গরিব জেলার একটি গ্রাম যদি নিজ গ্রামের অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো সাহস করতে পারে, তাহলে দেশের আর সব উন্নত জেলার গ্রামগুলো কেন পারবে না? আমরা মনে করি দেশের সব গ্রাম এই পথ অনুসরণ করলে কাজ অত্যন্ত সহজ হয়ে উঠবে।

তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর এবং পরিচালক, রিভারাইন পিপল
[email protected]