মানুষ কেন অপ্রয়োজনেও বের হয়

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

করোনা সংকটের শুরু থেকেই মানুষকে অপ্রয়োজনে ঘর থেকে বের হতে মানা করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে অকারণে আড্ডা থেমে নেই। কৌতূহলবশত কিছুদিন আগে পাড়ার গলিতে কয়েকজনকে আড্ডা দিতে দেখে কারণ জানতে চাইলাম। তাঁদের একজন একটা বেসরকারি ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। ভণিতা ছাড়াই উত্তরে জানালেন যে স্বাভাবিক সময়ে সারা দিন অফিস করেন। এরপর বাসায় বসে থাকতে আর ভালো লাগে না। তাই সন্ধ্যাবেলা এমন আড্ডা দেওয়ার অভ্যাস। লোকটার জবাব শুনে মনে পড়ল মার্শাল বারম্যানের কথা।

১৯৮২ সালে লেখা ‘অল দ্যাট ইজ সলিড মেল্ট ইন্টু এয়ার’ নামে বারম্যানের একটি বিখ্যাত বই আছে। সেখানে তিনি পথ খুঁজেছিলেন মানুষ কীভাবে আধুনিক দুনিয়াকে নিজের কবজায় আনতে পারে এবং এই ব্যবস্থার মধ্যেই নিজেদের আশ্রয়স্থল অনুভব করতে পারে। অর্থাৎ যে আধুনিক জীবনযাত্রায় আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি, সেখানেই স্বস্তি খোঁজা আর এই ঘোড়দৌড়ের মধ্যেই কমিউনিটির ধারণা খুঁজে পাওয়ার সংগ্রাম। এই সংগ্রাম নিরন্তর সন্দেহ নেই। আধুনিক মানুষ আজও সেই খোঁজ পায়নি, যা আধুনিকতা-পূর্ব সমাজে মানুষ পেত। পাড়ার ঘুপচি-গলিতে, চায়ের দোকানে আড্ডা সেই নিরন্তর সংগ্রামেরই অংশ।

মহাসড়ক ফাঁকা থাকলেও পাড়ার গলিতে, চায়ের দোকানে একশ্রেণির লোকেরা সন্ধ্যা হতেই আড্ডা জমায়। অনেকে মাস্ক পরেই বের হয়। কিন্তু পাড়ার দোকানে চা খাওয়ার সময় মাস্ক একটু নিচে নামিয়ে চা খায়। ব্যস্ত নগরীর ব্যস্ত মানুষেরা কাজ শেষে কিংবা কাজ না থাকলে, কারণে-অকারণে আড্ডা জমায়। তারা মার্শাল বারম্যানের সেই ‘আধুনিক মানুষ’ যারা আধুনিকায়নের ‘সাবজেক্ট’ ও ‘অবজেক্ট’ দুটোই। যারা আধুনিকতার মধ্যেই তাদের আবাসস্থল খুঁজে বেড়ায়। প্রযুক্তির বানে গা ভাসিয়ে তারা স্মার্টফোন কিংবা ল্যাপটপে ডুবে থাকতে চায়। কিন্তু সেখানে ব্যর্থ হয়েই তারা ফিরে আসে আধুনিকতা-পূর্বের সেই বাঙালি সামাজিকতায়, যার অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো আড্ডা।

বহু বাঙালি লেখক আড্ডাকে মহিমান্বিত করে গেছেন। অনেকে নিজেদের প্রাণখোলা আড্ডার কাহিনি বিভিন্ন লেখায় লিখে গেছেন। বিখ্যাত লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী এতটাই আড্ডাবাজ ছিলেন যে মজা করে সবাই তাঁকে ‘আড্ডা চক্রবর্তী’ বলে ডাকত। চক্রবর্তী শব্দের অর্থ সম্রাট। বিখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক বিনয় সরকারের বহু লেখা রয়েছে, যেগুলো পড়লে মনে হবে, তিনি আড্ডার গল্পই লিখেছেন। চল্লিশের দশকের বিখ্যাত এই সমাজতাত্ত্বিক এ-ও বলেছেন যে ‘জনগণ’ হিসেবে মানুষের যে স্বভাবজাত প্রবৃত্তি, বাঙালিদের ক্ষেত্রে তা টিকিয়ে রাখা এবং সমৃদ্ধ করার কাজটি করেছে এই আড্ডা। অর্থাৎ বাঙালিরা রাজনীতি সচেতন হয়ে রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে আড্ডার মাধ্যমে। আড্ডার সঙ্গে বাঙালির আত্মিক সম্পর্ক। 

অন্যদিকে নিরোদ সি চৌধুরী তাঁর ‘অ্যান অটোবায়োগ্রাফি অব অ্যান আননৌন ইন্ডিয়ান’ বইয়ে আড্ডাকে দেখেছেন বাঙালি চরিত্রের এক ‘গভীর’ ও ‘চলমান’ রোগ হিসেবে। আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বিপরীতে বাঙালির এই আড্ডাবাজ চরিত্রকে তিনি আধুনিকতা-পূর্ব সমাজের ‘দলবদ্ধ মানসিকতা’ হিসেবে দেখেছেন। অর্থাৎ বাঙালি আধুনিক হয়ে উঠতে পারেনি।

বাঙালি লেখক ও সাহিত্যিক যাঁরা আড্ডাকে মহিমান্বিত করেছেন, তাঁরা বিষয়টিকে বাঙালির সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া হিসেবেই দেখেছেন। কিন্তু সেগুলো স্বাভাবিক সময়ের প্রেক্ষাপটে। মহামারি-অতিমারিকালে সেসব পরামর্শ তাঁরা দেননি।

তবে পুঁজিবাদী আধুনিকতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিরোদ সি চৌধুরীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ধারণ করা আর ঘরে বসে স্বস্তি খোঁজা আমাদের জন্য বেশ কঠিন। মহাসড়ক অনেক সময় নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও পাড়া-মহল্লার গলিতে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। পুলিশ টহল দেওয়ার সময় মানুষ লুকোছাপা করছে। কিন্তু এরপর আড্ডা আবার আগের মতোই চলছে। পুলিশের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিজের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে এই লুকোচুরি খেলার কাহিনি বলেছেন।

তবে অনেক মানুষ বাস্তব প্রয়োজনেই রাস্তায় নামছে। একদিকে করোনা, অন্যদিকে অনাহার—দুটোই এসব মানুষের জন্য মৃত্যুর পরোয়ানা। দিগ্বিদিকশূন্য এসব মানুষ তাই হেঁটে শত মাইল পাড়ি দেন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বকেয়া মজুরির দাবিতে বিক্ষোভ করে চলেন দিনের পর দিন। তাঁদের করোনার ভয় নেই, ক্ষুধার ভয় আছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির এই সমাজই তাদের তপ্ত রোদে মাইলের পর মাইল ক্ষুধার ম্যারাথনে অংশ নিতে বাধ্য করেছিল। একই কারণে এখনো বিক্ষুব্ধ সেসব কারখানার শ্রমিকেরা রাস্তায়। অন্যদিকে রয়েছে যুক্তিহীনতার সংস্কৃতি। তাই নিয়মের তোয়াক্কা না করে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয় জানাজায়। প্রতিবেশীর জানাজায় না গেলেও বহুদূর পাড়ি দিয়ে জানাজায় অংশ নিতে সমস্যা নেই। এসব মানুষ যুক্তিহীনতায় অভ্যস্ত হয়েছে এই সমাজের আলো-বাতাসেই। আমাদের তৈরি করা শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমেই তারা অন্ধ অনুকরণ শিখেছে। তাই তাদের ঢালাওভাবে দোষারোপ করলেই সমাজ দায়মুক্ত হয় না, রাষ্ট্র কর্তব্য থেকে ভারমুক্ত হয়ে যায় না।

অনেকের আবার ঘরেও যে খুব জায়গা আছে তেমন নয়। একজন রিকশাচালক চা খাচ্ছেন গলির দোকানে। জিজ্ঞেস করতেই জানালেন যে বস্তিতে থাকেন। একটিমাত্র কক্ষ। স্ত্রী-ছেলেমেয়ে নিয়ে পরিবারের সদস্য ছয়জন। তাই ঘরে বেশিক্ষণ থাকতে ইচ্ছে হয় না। বস্তির ওই ঘুপচি ঘর যাঁরা স্বচক্ষে দেখেছেন, তাঁরা জানেন সেখানে সারা দিন ‘হোম কোয়ারেন্টিন’ নামক তোতাবচন মেনে চলা কতটা কষ্টকর।

সত্যিই যাঁরা পেটের দায়ে বাইরে বের হয়েছেন, তাঁদের দোষ দেওয়ার নৈতিক জায়গা আমাদের কতটুকু আছে? হয়তো রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সব ব্যবস্থা করলেও বাঙালির রসাল আড্ডা থামানো যেত না। কিন্তু তাদের বাইরে বের হওয়া বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নৈতিক শক্তি তৈরি হতো। এই নৈতিক শক্তির অভাবেই পুলিশ ও প্রশাসনের পক্ষে নিম্ন আয়ের মানুষদের ওপর কঠোর হওয়াটাও এখন কঠিন। কারণ, যেকোনো সংকটকালে পেশাদার বাহিনীর নৈতিক শক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পুলিশের একজন এসপি জানালেন, তাঁরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষই অপারগ হয়ে বের হয়েছে রাস্তায়। ঘরে খাবার নেই। তাই পুলিশ কঠোরও হতে পারছে না।

যা হোক, পেটের দায়ে বা সত্যিকারের প্রয়োজনে যারা বাইরে যায়, তাদের সঙ্গে আরেক দল মানুষও বাইরে যায়। তারা আড্ডা দেয়, ঘুরে বেড়ায়, পুলিশের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে।

আধুনিক জীবনে এখনো কেন আমাদের আড্ডা ছাড়া চলে না? পশ্চিমা আধুনিকতার সংজ্ঞাই তো হলো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ। ঘর আর অফিসই তো হওয়ার কথা ছিল আশ্রয় খোঁজার জায়গা। তবে এ কথা সত্য, বর্তমান আধুনিকতার ছত্রচ্ছায়ায় যে সমাজ আমাদের তৈরি হয়েছে, সেখানে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ না থাকলেও ব্যক্তিস্বার্থপরতা আছে। এই সমাজে মানুষ করোনার ভয়ে অসুস্থ মানুষকে সহায়তা করতে ভয় পায়। কিন্তু অকারণে আড্ডা দেওয়া, পাড়ার দোকানে দলবদ্ধ হয়ে চা খাওয়া আমাদের থেমে নেই।

পুঁজিবাদী আধুনিক সমাজে আমরা না পেরেছি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ শিখতে, না পেরেছি আগের সেই দলবদ্ধ চেতনা ধরে রাখতে। এই সংকর মানসিকতার জনগোষ্ঠী নিয়ে সংকট পাড়ি দেওয়া কঠিন। তাই সমাজের মৌলিক কাঠামো বদল নিয়ে আমাদের ভাবা উচিত। কারণ, পুঁজিবাদী আধুনিক সমাজে স্বস্তি খোঁজা আর ঘোড়দৌড়ের মধ্যে কমিউনিটির অনুভূতি খোঁজার সংগ্রাম যেমন নিরন্তর, সংকটও তেমনি নিরন্তর; এটাই শেষ নয়।

খলিলউল্লাহ্: প্রতিচিন্তার সহকারী সম্পাদক
[email protected]