করোনা অরাজকতার আভাষও দিচ্ছে

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এই সপ্তাহে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বার্ষিক সভা অনুষ্ঠিত করতে যাচ্ছে। তারা গত মঙ্গলবারে সতর্কবাণী দিয়েছে যে করোনাভাইরাস সংকট অন্য যেকোনো সংকটের মতো নয় বরং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মহামন্দার পর প্রথম সবচেয়ে খারাপ অবস্থা। তবে শুধু অর্থনৈতিক বিষয় নিয়েই উদ্বেগ বাড়ছে না বরং ধারণা করা হচ্ছে, ২০২০ সালে এটি নতুন কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতার সূচনা করতে পারে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং বিশ্বব্যাংকের সহ সংগঠন জাতিসংঘও ধেয়ে আসা এই রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, যা গত সপ্তাহের শেষের দিকে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের বক্তব্য থেকে বোঝা যায়। তিনি সতর্কবাণী দিয়েছেন যে এই বৈশ্বিক মহামারির কারণে সামাজিক অশান্তি এবং হিংস্রতা বাড়তে পারে, যা এই মহামারির বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই করার ক্ষমতাকে দমিয়ে দিতে পারে। বিশেষ করে গুতেরেস কিছু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার কথা উল্লেখ করেছেন, যা সামাজিক বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পারে যেমন নির্বাচন বা গণভোট পিছিয়ে দেওয়া, মহামারির ফলে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জগুলো বেড়ে যাওয়া, পাবলিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থা কমে যাওয়া এবং বৃহত্তর কোনো বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি; যার মাধ্যমে কিছু সমাজে বিভাজন অথবা অশান্তি দেখা যাওয়া।

যদিও, অর্থনৈতিক সংকট যত বাড়বে, সামাজিক বিশৃঙ্খলা তত বাড়বে। এখানে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার প্রকাশিত খবর খুব একটা আশানুরূপ নয়, যেখানে তারা সতর্ক করেছে যে এই মহামারির কারণে ২০০ মিলিয়ন মানুষ তাঁদের চাকরি হারাতে পারেন এবং ১ দশমিক ২৫ বিলিয়ন মানুষের উপার্জন অনেক কমে যেতে পারে।

এখানে দক্ষিণ এশিয়ার উদাহরণ ধরা যাক। গত সপ্তাহে বিশ্বব্যাংক বলেছে যে এই মহামারি ইতিমধ্যে এই অঞ্চলে ঝড় তুলেছে, কারণ বিগত ৪০ বছরের মধ্যে এখানকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সর্বনিম্ন এবং কয়েক দশক ধরে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যে সফলতা অর্জনের প্রচেষ্টা চলছিল, তা করোনাভাইরাসের কারণে এখন হুমকির মুখে। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং কিছু ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, যাদের মিলিত জনসংখ্যা প্রায় ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন এবং পুরো পৃথিবীর মধ্যে যা সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, এখন পর্যন্ত তুলনামূলকভাবে কম করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঘটনা নথিবদ্ধ করেছে কিন্তু আশঙ্কা করছে যে তারা করোনাভাইরাসের পরবর্তী হটস্পট হতে পারে। বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে যে এই বছর এই অঞ্চলের প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৮ শতাংশের মধ্যে থাকবে, যা এই প্রাদুর্ভাবের আগেও ৬ দশমিক ৩ শতাংশ ধারণা করা হয়েছিল অর্থাৎ, প্রায় অর্ধেকের মতো দেশ দীর্ঘ মন্দায় পতিত হবে।

তবে, বিশ্বের এই তিমিরাচ্ছন্ন সময়ে দক্ষিণ এশিয়া একা নয়। বিশ্বব্যাংক এর তথ্য অনুযায়ী বিগত ২৫ বছরের মধ্যে এই প্রথম সাব-সাহারা আফ্রিকা এক দীর্ঘ মন্দার দিকে যেতে চলেছে। কারণ, উন্নত দেশগুলো থেকে কাঁচামাল যেমন তেল বা মূল্যবান ধাতু এসবের চাহিদা কমে গেছে। বিগত বছরের ২ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অনুযায়ী আনুমানিক হিসাব করা হয়েছে, ২০২০ সালে এই বৃদ্ধি ২ দশমিক ১ থেকে ৫ দশমিক ১ শতাংশের মধ্যে থাকবে।

অর্থনৈতিক দুর্বলতার এই অবস্থায়, যে বিষয়টি সামাজিক নিরাপত্তাকে আরও জটিল করে তুলতে পারে তা হলো, ২০০৮-০৯ সালের আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংকটের পর থেকে বিভিন্ন দেশে বিদ্যমান উত্তেজনাকর রাজনৈতিক পরিবেশ, যা করোনাভাইরাসের অনেক আগেই হাঙ্গামার সূত্রপাত ঘটিয়েছে। হিসাব অনুযায়ী ২০১৭ সাল থেকে এখানে প্রায় ১০০টারও বেশি সরকারবিরোধী আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে, যার মধ্যে ২০ শতাংশ আন্দোলন সরকারের পতন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে, এমনকি গত বছর লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি ও এর অন্তর্ভুক্ত।

এই অরাজকতার অন্যতম পরিচালক হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের শক্তিশালী ভূমিকা। যদিও এখানে বিতর্ক থেকেই যায় যে রাজনৈতিক অরাজকতা তৈরিতে গণমাধ্যম কতটা সহায়ক ভূমিকা পালন করছে, কেউ এটিকে অসন্তোষ সৃষ্টির ক্ষেত্রে অপরিহার্য উপাদান হিসেবে দেখছে নাকি ইতিমধ্যে বিদ্যমান অরাজকতাকে জোরালো করার শুধু একটা উপাদান হিসেবে দেখছে, তবে এটি নিঃসন্দেহে যথেষ্ট সক্রিয় এবং গতিশীল ভূমিকা পালন করে গেছে, যা শুধু প্রযুক্তির বৃদ্ধি ও অগ্রগতির মাধ্যমে প্রসার লাভ করতে পারে।

বলতে গেলে, রাজনৈতিক অস্থিরতা কী পরিমাণ বাড়তে পারে, তা অন্তত দুটো সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে ধারণা করা যেতে পারে, বিশেষ করে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার সাপেক্ষে।

প্রথমত, ইতিমধ্যে অনেক দেশেই অর্থনৈতিক বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে, যা বড় ধরনের রাজনৈতিক অরাজকতা তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে সেসব মানুষের দ্বারা, যারা রাজপথে নেমেছে এটা গভীরভাবে উপলব্ধি করে যে তারা জাতির উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত। এটা যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য, বিশেষ করে এই কারণে যে করোনাভাইরাস ধনী সম্প্রদায়ের তুলনায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীতে বেশি প্রভাব বিস্তার করছে এবং এই মহামারির মাধ্যমে বৈষম্যের রাজনীতি বেড়ে যেতে পারে, অথবা নতুন কোনো অশান্তির স্ফুলিঙ্গ তৈরি হতে পারে।

দ্বিতীয়ত, দেখা যায় যুবসমাজই অর্থনৈতিক মন্দায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় যেমন ২০০৮-০৯ এর মন্দার পরের বছরের ঘটনা দেখলে বোঝা যায় ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সের যুবক, যাঁরা বিশ্বের ২০ শতাংশ জনসংখ্যার অধিকারী ছিলেন, বেকারত্বের হার প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে যাওয়ার পেছনে তাঁরা অন্যতম কারণ হিসেবে কাজ করেছেন। করোনাভাইরাস মন্দার ফলে যুবসমাজ যত বেশি প্রভাবিত হবে, অসন্তোষ তত বাড়বে।

একত্রে দেখতে গেলে, এই মহামারির কারণে নতুন ধরনের রাজনৈতিক অসন্তোষ সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার ফলে শুধু তীব্র অর্থনৈতিক বৈষম্য অরাজকতাই ডেকে আনবে না বরং বৃহত্তর রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক অসন্তুষ্টিও এই অরাজকতার কারণ হতে পারে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সাহায্যে এটা ত্বরান্বিত হতে পারে।

মো. শরীফ হাসান: শিক্ষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]