রহমতের মাস রমজান

রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস রমজান। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সিফাতে জামালি বা সৃজনশীল গুণাবলির অন্যতম হচ্ছে রহমত। রহমত অর্থ দয়ামায়া, কৃপা-করুণা, অনুকম্পা, অনুগ্রহ ইত্যাদি। কোরআন–হাদিসে এ শব্দের দুটি রূপ ব্যবহৃত হয়েছে, তা হলো ‘রহমান’ ও ‘রহিম’। এই শব্দ কোরআন কুঞ্জিকা বিসমিল্লাহ শরিফের মধ্যেই রয়েছে দুবার। উম্মুল কোরআন বা কোরআন জননী ফাতিহা শরিফের দ্বিতীয় আয়াতে একই রূপে রয়েছে আরও দুবার। কোরআন নাজিলের মাস রমজান। কোরআনের সঙ্গেও রহমতের আর রহমানের সম্পর্ক সুনিবিড়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘দয়াময় আল্লাহ! কোরআন শেখালেন, মানুষ সৃষ্টি করলেন।’ (সুরা-৫৫ রহমান, আয়াত: ১-৩)।

আল্লাহ তাআলার বিশেষ গুণ বা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো রহমত। রহমান অর্থ পরম করুণাময়। মহান আল্লাহর এ গুণ সারা দুনিয়ার সব মানুষ—মুসলিম–অমুসলিম, বাধ্য–অবাধ্য সবার জন্যই সমভাবে প্রযোজ্য। যিনি দয়া বা রহমত কারও প্রতি কোনো অবস্থায় এক মুহূর্তের জন্যও বন্ধ করে দেন না, তিনি রহমান। রহিম অর্থ অতীব মেহেরবান, অতিশয় দয়ালু। আল্লাহর এ দয়া শুধু মুমিন মুসলিমদের জন্য খাস বা বিশেষায়িত, যা আখিরাতে বিশেষভাবে প্রকাশিত হবে। যারা দুনিয়ার জীবনে আল্লাহ ও রাসুল (সা.)–কে মেনে ইসলামের অনুশাসন বা রীতিনীতি অনুসারে জীবন যাপন করেছেন, শুধু তঁারাই মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে কবর, মিজান, পুলসিরাত ও হাশরে আল্লাহর ‘রহিম’ নামক দয়া বা অনুগ্রহ লাভে ধন্য হবেন।

রমজানের প্রথম দশক রহমতের। আল্লাহ চান তাঁর বান্দা তাঁর গুণাবলি অর্জন করে সে গুণে গুণান্বিত হয়ে আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি সেই গুণের প্রকাশ ঘটাক। আল্লাহ তাআলা কোরআন মজিদে বলেন: আল্লাহর রং! আর আল্লাহর রং অপেক্ষা চমৎকার আর কোনো রং হতে পারে? (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৩৮)। হাদিস শরিফে আছে: তোমরা আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হও। (তিরমিজি)। যেহেতু মানুষ আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি, তাই তাকে খিলাফতের দায়িত্ব পালনের যোগ্য হতে হলে অবশ্যই সেসব গুণ অর্জন করতে হবে। আল্লাহর রং বা গুণ কী? তা হলো আল্লাহ তাআলার অসংখ্য গুণবাচক নাম। এ প্রসঙ্গে হাদিস শরিফে এসেছে: নিশ্চয় আল্লাহ তাআলার নিরানব্বইটি (অনেক) গুণবাচক নাম রয়েছে, যারা এগুলো আত্মস্থ করবে, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। (মুসলিম ও তিরমিজি)। মহান আল্লাহর নামাবলি আত্মস্থ করার বা ধারণ করার অর্থ হলো সেগুলোর ভাব ও গুণ অর্জন করা এবং সেসব গুণ ও বৈশিষ্ট্য নিজের কাজে–কর্মে–আচরণে প্রকাশ করা তথা নিজেকে সেসব গুণের আধার বা অধিকারী হিসেবে গড়ে তোলা। আল্লাহ আমাদের প্রতি দয়া করবেন, আমাদেরও তাঁর সৃষ্টির প্রতি দয়া করতে হবে। কোরআন কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘দয়ার বিনিময় দয়া ছাড়া আর কী হতে পারে?’ (সুরা-৫৫ রহমান, আয়াত: ৬০)।

যদিও বান্দার প্রতি আল্লাহর দয়া বা রহমত সর্বকালে সর্বক্ষণ বর্ষিত হতে থাক, বিশেষ করে পবিত্র মাহে রমজানে এর ব্যাপকতা আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে। রমজানের প্রথম দশক রহমতের দশক হিসেবে বিশেষায়িত। পবিত্র মাহে রমজানের বরকতে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রাখা হয়। ফলে আদম সন্তান রোজা পালন, নামাজ আদায়, কোরআন তিলাওয়াত, দান–সদকা, ফিতরা, জাকাত প্রদান ও জিকির–আসকার ইত্যাদিতে মশগুল হয়ে তাকওয়া অর্জনে অধিক সচেষ্ট হতে পারে।

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন সকল মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বড় দানশীল। যখন রমাদান আসত, জিবরাইল (আ.) প্রতি রাতে আসতেন, কোরআনের তালিম করতেন, তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রবাহিত বায়ু অপেক্ষা অধিক হারে দান খয়রাত ও নেক আমল করতেন।’ অন্য বর্ণনায় রয়েছে: ‘রমাদান এলে রাসুল (সা.) এত বেশি দান–খয়রাত করতেন, যেন তা প্রবাহিত বায়ু।’ (বুখারি, হাদিস: ৪৭১১; মুসলিম, হাদিস: ২৩০৮)। আল্লাহর রহমত পেতে সৃষ্টির প্রতি দয়াশীল হতে হবে। নবীজি (সা.) বলেন, ‘তোমরা দুনিয়াবাসীর প্রতি রহম কর, আসমানওয়ালা খোদা তোমাদের প্রতি রহম করবেন।’ (বুখারি)।

আল্লাহর রহমত লাভ করতে পারলেই বিপদ-আপদ ও বালা–মুসিবত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। সংযমের মাস রমজান, আল্লাহর রহমত পাওয়ার জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে সংযমী ও নিয়ন্ত্রিত আচরণ করতে হবে। নিয়মানুবর্তিতা, সুশৃঙ্খল জীবন ও আল্লাহর ওপর নির্ভরতা সব সংকট উত্তরণে সহায় হবে ইনশা আল্লাহ!

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
smusmangonee@gmail,com