ত্রাণচোরদের সামাজিকভাবে লজ্জা দিতে হবে

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

হুমায়ূন আহমেদ খাঁচার পাখিকে বলতে শিখিয়েছিলেন ‘তুই রাজাকার’। সেটা ছিল এমন এক সময়, যখন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধূসর হয়ে আসতে শুরু করেছে। যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, তাদের হাতেই ক্ষমতার দণ্ড। পাখির গলায় ‘তুই রাজাকার’ মন্ত্র শুনে আমরা রাজাকারকে রাজাকার বলার সাহস পেয়েছিলাম।

এখন হুমায়ূন আহমেদ হয়তো আবার কোনো পাখিকে বলতে শেখাতেন ‘তুই চোর’। সে কথা শুনে হয়তো আমরাও চোরকে চোর বলা শিখতাম। বলা বাহুল্য, করোনাভাইরাস সংক্রমণে বিপর্যস্ত নাগরিকদের জন্য বরাদ্দ সরকারি ত্রাণসামগ্রী যেভাবে তছরুপ হচ্ছে, তা দেখেশুনে এমনই মনে হচ্ছে।

ক্ষমতাবান লোকেরা সুযোগ পেলে সরকারি ধন লুটেপুটে খায়। যে কম ক্ষমতাবান, সে পুকুরের মাছ চুরি করে। যে বেশি ক্ষমতাধর, সে পুরো পুকুরটাই গাপ করে দেয়। প্রথমজন ট্রাক থেকে দশ ব্যাগ ত্রাণের চাল সরিয়ে নিজের গুদামে লুকিয়ে রাখে। অন্যজন পুরো ট্রাকটাই ঘুরিয়ে নিজের গ্যারেজে নিয়ে যায়।

এসব জানা থাকা সত্ত্বেও সেই ক্ষমতাবান লোকদের হাতে ত্রাণের সাহায্য তুলে দেওয়া কেন? যুক্তি উঠবে, তঁারা জনপ্রতিনিধি, জনতাই তঁাদের ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছে। কিন্তু আমরা তো জানি, তাঁদের অধিকাংশের লক্ষ্য জনতার সেবা নয়, নিজের গোলায় ধান তোলা।

জনপ্রতিনিধিদের বাদ দিয়ে যদি সরকারি কর্তাব্যক্তিদের ত্রাণ বণ্টনের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাতেও বিপদ কিছু কম নয়। সরকারি কর্তাব্যক্তি মানে রাজকর্মচারী। রাজার কর্মচারীরা কীভাবে সুযোগ পেলেই রাজার ধন লোপাট করে, তা তো প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে কৌটিল্য বলে গেছেন। ঠোঁটের আগায় যদি মধু তুলে দেওয়া হয়, সে মধু চেটে দেখবে না, এমন সাধু ব্যক্তি ভূ–ভারতে মিলবে না, তিনি সাবধান করেছিলেন। তাঁর ব্যাখ্যা অনুসারে, এই রাজকর্মচারীরা অনেকটা জলে ক্রীড়ারত মৎসে্যর ন্যায়। মৎস্য কখন কতবার ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে, সে কথা বোঝা অসম্ভব।

যত দূর জানা যায়, কৌটিল্য খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ সালে চন্দ্রগুপ্তের রাজসভার মাঝারি গোছের একজন উপদেষ্টা ছিলেন। রাজার উপকার হবে ভেবে তিনি অর্থশাস্ত্র নামে একখানা বই লিখেছিলেন। অত আগের বই, অথচ তার প্রতিটি কথা আজকের দিনে আমাদের দেশে টায় টায় মিলে যায়। কৌটিল্য লিখেছিলেন, এই রাজকর্মচারীদের তূণে কম করে হলেও চল্লিশ রকমের বাণ (অর্থাৎ কুবুদ্ধি) রয়েছে। যেমন ধরুন, তারা মুখে বলবে এক, আর খাতাপত্রে লিখে রাখবে আরেক হিসাব। বাজেট করার সময় আগাম নয়ছয়ের ব্যবস্থা করে রাখবে, বিলিবণ্টনের সময় ওজনে কম দেবে, প্রকৃত মূল্য গোপন রেখে দাম বাড়িয়ে দেখাবে, ইত্যাদি।

দুর্নীতিবাজদের কীভাবে শিক্ষা দেওয়া যায়, তারও কিছু সবক দিয়ে গিয়েছিলেন কৌটিল্য। তিনি রাজা চন্দ্রগুপ্তকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, প্রতিটি দুর্নীতিবাজকে প্রকাশ্যে দণ্ডদান করতে হবে। লঘু অপরাধের জন্য অর্থদণ্ড, গুরু অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড। দুর্নীতি ঠেকাতে তিনি কঠোর আইন প্রণয়নের পক্ষে কথা বলেছিলেন, সেই আইন যাতে মেনে চলা হয়, তার নিশ্চয়তার জন্য রাজাকে অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বনেরও পরামর্শ দিয়েছিলেন।

কৌটিল্যের অধিকাংশ পরামর্শ খুব চমৎকার, কিন্তু সব আজকের দিনে তেমন বাস্তবসম্মত নয়। আইনের কথা ধরুন। আমাদের দেশে আইনের অভাব নেই, সেই আইন বাস্তবায়নের জন্য সরকারের পক্ষে প্রতিশ্রুতিরও কমতি নেই। কিন্তু শুধু প্রতিশ্রুতিতে যদি চিড়ে ভিজত, তাহলে বাংলাদেশে প্রতিটি নির্বাচন মুক্ত ও স্বচ্ছ হতো, প্রতিটি নাগরিক কথা বলত নির্ভয়ে, প্রশাসন হতো দুর্নীতিমুক্ত।

অন্য কথায়, কৌটিল্য বাবুকে দিয়ে হবে না। এইখানে দরকার একজন হুমায়ূন আহমেদের। ঠাট্টা করছি না, সত্যি বলছি। আমরা যদি পত্রিকায় বা টিভির সন্ধ্যার খবরে ত্রাণ চুরির খবর জানতে পেরে যার যার বৈঠকখানায় নিজেদের মধ্যে গজর গজর না করে রাস্তায় নেমে চোরকে তার প্রকৃত নাম ধরে ডেকে ‘তুই চোর’ বলে পাড়া মাত করতে পারতাম, তাহলে অবস্থা বদলাত।

ধরুন, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কিংবা সাংসদ ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করার বদলে নিজের গুদামে তুলেছেন। তাঁদের নামধাম গণমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হচ্ছে। তখন আমাদের উচিত হবে চুপচাপ বসে না থেকে তঁাদের মুখোমুখি হওয়া, তঁাদের কাছে ত্রাণসামগ্রীর হিসাব চাওয়া। তিনি আপনাকে গুন্ডা দিয়ে ঠ্যাঙানোর ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু ভয় পাবেন না। একা নয়, কয়েকজন একত্রে এগিয়ে আসুন, কাউকে মুখেও কিছু বলতে হবে না। হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে আসুন, তাতে লেখা থাকবে, ‘তুই চোর’। এক দিন নয়, প্রতিদিন সে বাড়ি ঘেরাও করুন। সেই চোর এবং তঁার বাড়ির সবাই যাতে সেই প্ল্যাকার্ড দেখে, স্লোগান শোনে, তা নিশ্চিত করুন। টিভি ক্যামেরার দরকার নেই, সাংবাদিকেরও প্রয়োজন নেই, নিজেরাই ছবি তুলুন, ভিডিও করুন। তারপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা প্রকাশ করুন।

রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে এর নাম ‘নেমিং অ্যান্ড শেমিং’। অর্থাৎ অপরাধীর নাম ধরে তাঁকে লজ্জা দেওয়া। এই কৌশল বিশেষভাবে কার্যকর যখন ক্ষমতাধরেরা অপরাধীকে শনাক্ত করা ও শাস্তি দেওয়ার বদলে তঁার মাথায় ছাতা ধরে রাখে। মানবাধিকার আন্দোলনের কৌশল হিসেবে নেমিং অ্যান্ড শেমিং পুরোনো বুদ্ধি। মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের চিহ্নিত করার জন্য জাতিসংঘ পর্যন্ত এ কৌশল অবলম্বন করছে। প্যারিসে স্বাক্ষরিত জলবায়ু চুক্তিতে নেমিং অ্যান্ড শেমিং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নীতিকৌশল। একুশ শতকের গোড়ার দিকে বলকান অঞ্চলে নাগরিক অধিকারকর্মীরা আরেক বুদ্ধি বের করেছিলেন। সার্বিয়ার কসাই স্লোবোদান মিলোসেভিচের ছবি এক মস্ত প্লাস্টিকের ফুটবলের ওপর এঁকে সবাইকে আহ্বান করেছিলেন, আসুন, প্রত্যেকে এই ফুটবলে একবার লাথি দিয়ে যান। ওই লাথি খেয়ে আর কিছু না হোক লজ্জায় মুখ কালো হয়েছিল মিলোসেভিচের। এটাও একধরনের নেমিং অ্যান্ড শেমিং। এই বুদ্ধিটাও আমাদের ত্রাণচোরদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যেতে পারে।

অতএব আসুন, চোরের দিকে আঙুল তুলে বলি, ‘তুই চোর’।

হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক