তৈরি পোশাকের বাজার হারালে ফেরত পাওয়া যাবে না

>
আহসান এইচ মনসুর
আহসান এইচ মনসুর
আহসান এইচ মনসুর। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান। লকডাউনের কারণে দেশের অর্থনীতি ও জনজীবন প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। উত্তরণের উপায় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন এই অর্থনীতিবিদ।  সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান

প্রথম আলো: করোনার প্রাদুর্ভাবের মধ্যেই কিছু কিছু কারখানা খোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক কারখানা। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

আহসান এইচ মনসুর: বেশির ভাগ দেশ শিল্পকারখানা খুলে দিচ্ছে। আমাদেরও খুলতে হবে। তবে দেখতে হবে আমরা কোন অবস্থায় আছি। এ কথা ঠিক যে করোনা পরিস্থিতি আমরা ঠিকভাবে সামাল দিতে পারিনি। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। আবার তৈরি পোশাক খাতে আমাদের প্রতিযোগী চীন ও ভিয়েতনাম শিল্পকারখানা খুলে দিয়েছে। এ সময় আমরা বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে যে অর্ডার বা কার্যাদেশ পাব, সেটি কমই হবে। আগামী দু–তিন মাস ২০ শতাংশ হতে পারে। একটি হিসাবে এপ্রিলে ১৬ শতাংশ কার্যাদেশ এসেছে। মে মাসে ২০ শতাংশ। কিন্তু এসব কোনোভাবে হাতছাড়া করা যাবে না। কেননা একবার ছেড়ে দিলে ফেরত পাওয়া যাবে না। আমাদের অর্থ ও শ্রমিকদের কর্মসংস্থান দুটোরই প্রয়োজন আছে। 

প্রথম আলো: তাহলে আপনি বলছেন, বিদেশি বাজার ধরে রাখতে কারখানা এখনই খুলে দেওয়া উচিত?

আহসান এইচ মনসুর: এই কার্যাদেশের ভিত্তিতে কারখানা খুলে দেওয়া যেতে পারে। এ জন্য সব শ্রমিককে এখনই কাজে লাগানোর প্রয়োজন নেই। যাঁরা আশপাশে আছেন, তঁাদের দিয়েই কারখানা চালু করতে হবে। যঁারা দূরে আছেন, তাঁদের আনার দরকার নেই। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারের স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি মেনে চলতে হবে। বিজিএমইএর একটি নীতিমালা করেছে, যাতে মোটামুটি সবকিছু আছে। এখন এই স্বাস্থ্যবিধি দৃঢ়ভাবে প্রতিপালন করতে হবে। অনেক দেশে সেটি করেছেও। শ্রমিকেরা কারখানায় একদিক দিয়ে ঢুকবেন, অন্যদিক দিয়ে বের হবেন। তঁাদের বসার ব্যবস্থাও করতে হবে দূরত্ব রেখে। যেহেতু সব শ্রমিককে কাজ লাগানো হচ্ছে না, সেহেতু দূরত্ব বজায় রেখে তাঁদের বসানোর কাজটি কঠিন হবে না। আমি মনে করি, কারখানা খোলার জন্য অন্তত এক সপ্তাহের প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল। প্রস্তুতি নিয়ে কারখানা চালু করলে ঝুঁকি থেকেই যাবে। 

প্রথম আলো: স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে কি না, সেটি কে তদারক করবে। সরকার না বিজিএমইএ?

আহসান এইচ মনসুর: সরকারের শিল্প ও শ্রম মন্ত্রণালয় আছে। তারা আইনি বিষয়টি দেখবে। বিজিএমইএ দেখবে সদস্য কারখানাগুলো তাদের নির্দেশিত নীতিমালা মানছে কি না। আবার করোনাভাইরাসের ঝুঁকিটা এত গুরুতর যে কারখানার মালিকদেরও সর্বোচ্চ সজাগ থাকতে হবে। কোনো কারখানায় সংক্রমণ দেখা দিলে এর মালিক- শ্রমিক উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। 

প্রথম আলো: কিন্তু এখন পর্যন্ত সব কারখানা শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধ করেনি। 

আহসান এইচ মনসুর: এটি দুঃখজনক। শ্রমিকদের মজুরি না পাওয়ার সমস্যা একটি পুরোনো সমস্যা। বিজিএমইএ বলেছে, ৭০টির মতো কারখানা মার্চ মাসের মজুরি দিতে পারেনি। বাকিগুলো দিয়েছে। সমস্যা হলো যেসব কারখানা বিজিএমইএর সদস্য নয়, সেসব কারখানার দায়িত্ব তারা নিতে চায় না। বিকেএমইএর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ২০১০ সালের দিকে আমরা প্রস্তাব দিয়েছিলাম যে প্রতি ১০০ টাকা রপ্তানি আয় থেকে ১০ পয়সা হারে কেটে একটি তহবিল করা হোক। শ্রমিকেরা বিপদে পড়লে তা থেকে অর্থের জোগান দেওয়া যাবে। সরকারও সেই প্রস্তাবে রাজি ছিল। কিন্তু বিজিএমইএর আপত্তির কারণে সেটি হয়নি। 

প্রথম আলো: লকডাউনের কারণে অধিকাংশ তৈরি পোশাক কারখানা ইতিমধ্যে লে–অফ ঘোষণা করা হয়েছে। এতে তো শ্রমিকেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

আহসান এইচ মনসুর: এখানে নীতি ও উদ্দেশ্যের মধ্যে বিরোধ আছে। মালিকেরা যুক্তি দেখাচ্ছেন, কারখানায় উৎপাদন বন্ধ আছে। এ অবস্থায় লে-অফ ঘোষণা না করে উপায় নেই। তাঁরা আইনসিদ্ধভাবেই এটি করেছেন। আবার শ্রমিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, এটিও একটি সমস্যা। এই মুহূর্তে বড় জরুরি হলো অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখা। আর সে জন্য কারখানা চালু করার বিকল্প নেই। একজন কারখানামালিক আমাকে বললেন, তিনি ১৪ এপ্রিলই তাঁর কারখানার শ্রমিকদের মার্চের মজুরি সাড়ে ৪ কোটি টাকা পরিশোধ করেছেন। এ মাসে কারখানা বন্ধ। তিনি জানেন না আগামী মাসে কীভাবে মজুরি দেবেন। তাই গণমাধ্যমেরও উচিত হবে শ্রমিকদের পাশাপাশি মালিকদের সমস্যাটিও তুলে ধরা। উভয় পক্ষকে সমঝোতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। পুরো মজুরি পরিশোধ করে মালিক কারখানা বন্ধ করলেও তো শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। 

প্রথম আলো: লকডাউনের কারণে সবচেয়ে বিপদে পড়েছেন দরিদ্র মানুষ। তাঁরা বেকার হয়ে পড়েছেন। তাঁদের সহায়তায় সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তাকে কি যথেষ্ট মনে করেন?

আহসান এইচ মনসুর: গরিব মানুষের জন্য সরকার তেমন কিছু করেনি। ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ কিছুই নয়। ২০১৯ সালে দারিদ্র্যসীমার নিচের মানুষ ছিল ২০ শতাংশ। এই এক মাসে সেটি ৩০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এদের সংখ্যা ৫ কোটির কম হবে না। এই ৫ কোটি মানুষকে খাইয়ে বাঁচানোর ব্যবস্থা করতে হবে। ২০ লাখ টন চাল কিনে গরিবদের কাছে বিক্রি (১০ টাকা কেজি দরে) করলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের লোকজন লাভবান হবেন। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের লোকজন লাভবান হবেন। পাকিস্তান প্রতিটি দরিদ্র পরিবারকে মাসে ১ হাজার ২০০ টাকা করে দিচ্ছে। আমাদেরও উচিত হবে খাদ্যের বদলে নগদ টাকা দেওয়া। এসএমএস করে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট 
বা বিকাশ নম্বরে পাঠাতে বলা হবে, সেই অ্যাকাউন্ট বা নম্বরে টাকা যাবে। এখানে দুর্নীতির সুযোগ কম। এতে সরকারের ২২–২৩ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। আর খাদ্যসহায়তা দিলে খাদ্য সংগ্রহ, তালিকা তৈরি, বিতরণ—তিন ধাপেই দুর্নীতি হবে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক প্রতিটি পরিবারকে ৩ হাজার টাকা করে দিচ্ছে। সরকারের এ সহায়তা কর্মসূচিকে রাজনীতি ও দুর্নীতির ঊর্ধ্বে রাখতে হবে। সবার আগে মানুষকে খাইয়ে বাঁচাতে হবে। 

প্রথম আলো: অর্থনীতির স্থবিরতা কাটাতে সরকার যেসব কর্মসূচি নিয়েছে, সে সম্পর্কে আপনার অভিমত? 

আহসান এইচ মনসুর: অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার যেসব কর্মসূচি নিয়েছে বা প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, সেগুলো বাস্তবতার কাছাকাছি বলে মনে করি। তবে এখানে সমস্যা হলো আমলাতান্ত্রিক। সরকার একতরফাভাবে পরিপত্রগুলো জারি করেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করেনি। ফলে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে আপত্তি উঠেছে। প্রণোদনার ক্ষেত্রে বেশি শর্ত চাপিয়ে দিলে উদ্দেশ্য ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা আছে। সহায়তা গ্রহীতাবান্ধব হতে হবে। এসএমই বা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে সরকার ২০ হাজার কোটি টাকা দেওয়ার কথা বলেছে। কিন্তু এই খাত তো বিশাল। এর সঙ্গে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান জড়িত। অতএব, প্রণোদনার অঙ্ক বাড়াতে হবে। একই কথা প্রযোজ্য ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রেও। এ খাতে ৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। কিন্তু আমি মনে করি, সরকার যদি অর্থনীতিকে চাঙা করতে চায়, তাহলে দুটোতেই বরাদ্দ বাড়াতে হবে। 

প্রথম আলো: আপনি বলেছিলেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। এখানে স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থার কোনো দুর্বলতা আছে বলে মনে করেন?

আহসান এইচ মনসুর: আমাদের স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থা যে খুবই নাজুক, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সেটি আবারও প্রমাণিত হলো। অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি, জনবল তিন ক্ষেত্রেই বেহাল পরিস্থিতি। আমরা কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন সরবরাহ আছে, এ রকম একটি হাসপাতালও করতে পারিনি। সিলিন্ডার দিয়ে চালানো হচ্ছে। আমাদের দক্ষ চিকিৎসকেরও অভাব আছে। যেসব পরিবারের সদস্য করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা ভয়ংকর। সরকার চীনের কাছে ১০০ চিকিৎসক ও ১০০ নার্স পাঠানোর অনুরোধ জানাতে পারত; যাঁরা এসে আমাদের চিকিৎসক ও নার্সদের প্রশিক্ষণ দিতেন। চীনের চিকিৎসক ও নার্সরা এ ব্যাপারে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। বিদেশে আমরা দেখি চিকিৎসকেরা করোনা সংক্রমিত রোগীদের খুব কাছে যান। কিন্তু আমাদের এখানে চিকিৎসক ও নার্স রোগীর কাছে যেতেই ভয় পান। এ জন্য শুধু তাঁদের দায়ী করা যায় না। কারণ, স্বাস্থ্য বিভাগ চিকিৎসক ও নার্সদের সুরক্ষাও নিশ্চিত করতে পারেনি। 

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

আহসান এইচ মনসুর: আপনাকেও ধন্যবাদ।