জেআরসি: অনেক শ্রদ্ধায় স্মরণ

জামিলুর রেজা চৌধুরী
জামিলুর রেজা চৌধুরী

চাকরির জন্য সিভি বা জীবনবৃত্তান্ত হিসেবে পরিচিত জীবনবৃত্তান্ত মাঝেমধ্যে পেতাম। কাগজের উপরিভাগে খুব ছোট্ট অক্ষরে ইংরেজিতে লেখা থাকত 'শাহদীন, প্লিজ সি। জেআরসি'। মাঝেমধ্যে যে সিভিগুলো পাঠাতেন, সে ব্যাপারে পরে কোনো দিনই কিছু জিজ্ঞাসা করেননি। ধরে নিতাম ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে তাঁর বরাবর এই সিভিগুলো আসত আর তিনি যথারীতি আমাকে পাঠিয়ে দিতেন। স্বাক্ষরের জায়গায় থাকত তাঁর হাতে লেখা 'জেআরসি'।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিকের বছরগুলোর কথা। নিয়মকানুন, রীতি-পলিসি একে একে হচ্ছিল। এগুলো তৈরি করতে সময় লাগে, তাই কিছু কিছু কাজ হতো অনানুষ্ঠানিকভাবে। সেই সময়ের কথা। জেলা জজ পর্যায়ের এক বিচারকের সঙ্গে কথাবার্তা হলো। খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে আইনের একটা বিষয়ে পড়াবার ব্যাপারে কথা পাকাপাকি হলো। তারপর বিচারকের একটা সিভি নিয়ে গেলাম জেআরসির সঙ্গে কথা বলতে। বিচারকের নাম বলতেই সেই বিচারক কখন কোন জেলায় কোন পদে চাকরি করেছেন, তাঁর বাবা কী করতেন, বড় ভাই কে ছিলেন—সবকিছুই মোটামুটি একনিশ্বাসেই বলে গেলেন। সিভি পড়ার কোনো প্রয়োজনই হয়নি। পরেও দু-চারবার এই রকম আরও কিছু ব্যক্তির সম্পর্কে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা হয়েছিল। মোটামুটিভাবে নাম উচ্চারণ করলেই সেই ব্যক্তির শুধু পেশাগত যোগ্যতা-দক্ষতাই নয়; তাঁর বাবা, পরিবার, ভাগনে আর খালা কে—সবই বলে দিতে পারতেন। ফলে আমার একটা ধারণা জন্মেছিল যে ঢাকা শহরে বোধ হয় মধ্যবিত্ত পেশাজীবী এমন কোনো ব্যক্তি নেই, যাঁর ঠিকুজি জেআরসি জানতেন না।

২০১৮ সালে জাতীয় অধ্যাপক নিযুক্ত হওয়ার পর বুয়েট অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন তাঁকে একটা সংবর্ধনা দিয়েছিল। ইঞ্জিনিয়ারদের বাইরে এই অধমকে তলব করা হয়েছিল অল্প কিছু বলার জন্য। স্টেজে উঠে শত শত ইঞ্জিনিয়ারের মধ্যে জেআরসির কিছু সমালোচনাই করে বসি। শ্রোতাদের হাসির রোল পড়ে গিয়েছিল।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়ে ফিরে যাই। ল স্কুলের কী যেন একটা ব্যাপারে ভীষণ গোসসা করে জেআরসিকে একটা আনুষ্ঠানিক চিঠি পাঠাই। ই–মেইল না করে ল স্কুলের প্যাডে প্রিন্ট করে, যাকে কিনা বলে একেবারে হার্ড কপি। দিন তিনেক পরে ল স্কুলের সব শিক্ষক–শিক্ষিকার সঙ্গে উপাচার্যের পূর্বনির্ধারিত মিটিং ছিল। আমার লেখা চিঠির ব্যাপারে খুবই কড়া অবস্থান নেব, দু-একজন সহকর্মীকে আগেভাগেই বলে রেখেছিলাম। এসপার–ওসপার হয়ে যাবে। পূর্বনির্ধারিত বিষয়ে আলোচনার পরে আমার ঝগড়ার বিষয়টা উপস্থাপন করার ঠিক আগ মুহূর্তে জেআরসি বললেন, 'তোমার চিঠি পড়েছি, সমাধান করতে বলে দিয়েছি।'

অধস্তন সহকর্মীর এত কড়া সমালোচনা এককথায় এত সহজে নিতে পারার জন্য কত বড়ের মনের অধিকারী হতে হয়, তা এখনো ঠাওর করতে পারিনি। তাই বুয়েট অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনে আমার ঠাট্টার ছলে করা সমালোচনার পরে জেআরসি আমাকে হেসে হেসে বলেছিলেন, ভালোই বলেছ।

তাঁর সহকর্মী ও বহু আগের ছাত্রদের মুখে শুনেছি যে তিনি যাঁদের ক্লাস নিতেন, সেই ষাট বা সত্তরের দশকের ছাত্রের রোল নম্বর এখনো বলে দিতে পারতেন।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিয়েছিলাম বেশ কয়েক বছর আগে। তত দিনে জেআরসি ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্যের দায়িত্ব নিয়ে ফেলেছেন। আমার ব্র্যাক ছাড়ার কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর ফোন পেলাম। জানতে চাইলেন, এশিয়া প্যাসিফিকে পড়াব কি না। ক্লান্ত ছিলাম, তাই কিছুদিন সময় চেয়ে নিলাম। সাত-আট মাস পর আবার ফোন। জেআরসিকে দুবার তো আর একই কথা বলা যায় না। ইমারত আইন ও বিধি সম্পর্কে সব সময়ই তাঁর উৎসাহ ছিল। ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকে 'রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন ল' পড়ানো হয়। এই রকম আইন অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয় বলে জানা নেই।

অনেক বছর আগে তাঁর একটা অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু সেতু নিয়ে বিদেশি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সব বোঝাপড়া হয়ে গিয়েছিল। দিনক্ষণ ঠিক হয়েছিল চূড়ান্ত মিটিংয়ে। ওই দিনই চুক্তির সব কাগজপত্র সই হবে। জেআরসি আমাকে বলেছিলেন, আমি ছয়জনের দল নিয়ে মিটিংয়ে গেলাম। আমরা সবাই ইঞ্জিনিয়ার। বিদেশিরা এল। তাঁদের দলেও ছয়জন। পরিচয় পর্ব শেষে বুঝলাম, ওঁদের দলে একজন ইঞ্জিনিয়ার আর বাকি পাঁচজনই আইনজীবী। ওই অভিজ্ঞতাটাই ইমারত আইন ও বিধির ব্যাপারে জেআরসির উৎসাহ বা উপলব্ধি তৈরি করেছিল কি না জানি না। আগেই বলেছি, এশিয়া প্যাসিফিকে এই আইন পড়ানো হয়।


জাতীয় অধ্যাপক নিয়োজিত হওয়ার পর এশিয়া প্যাসিফিকে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। সেই সংবর্ধনায় জেআরসি তাঁর বক্তৃতায় বলেছিলেন, আর কোথাও দায়িত্ব নেবেন না। এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্যের পদই হবে তাঁর শেষ দায়িত্ব। সেই সংবর্ধনার দুই বছরও হয়নি ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি এত তাড়াতাড়ি শেষ পদ ছেড়ে তিনি চিরবিদায় নেবেন। কয়েক দিন ধরেই ভাবছিলাম, ফোন করে জিজ্ঞেস করব করোনাকালে কেমন আছেন। সেই ফোনটি করা হয়ে ওঠেনি। পরিচিত কেউ না–ফেরার দেশে চলে গেলে তাঁদের কথা মনে করে আফসোস হয়, ছোটখাটো ব্যাপারেই বেশি।

ড. শাহদীন মালিক
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক।