লকডাউন মানুষ মারার চেয়ে বাঁচাবে বেশি

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

‘সমস্যা সারাতে গিয়ে আমরা পরিস্থিতি আরও খারাপ করে ফেলতে পারি না। একটি দেশকে মহামন্দার মধ্যে ফেলে আপনারা আরও অনেক বেশি সংখ্যক লোককে মেরে ফেলতে যাচ্ছেন। আপনারা হাজার হাজার লোককে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন।’—এ কথাগুলো খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের।

তিনি পরিষ্কার বলেছেন, লকডাউনের কারণে যে সংখ্যক মানুষ কোভিড-১৯–এর ছোবল থেকে প্রাণে বাঁচবে, তার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ মারা যাবে। লকডাউন তুলে নেওয়ার যুক্তি হিসেবে ট্রাম্প এই কথা বলেছেন। ধারণা করা যায়, মানুষের জীবন বাঁচানোর বিষয়ে ট্রাম্প যতটা না উদ্‌গ্রীব, তার চেয়ে অনেক বেশি উদ্‌গ্রীব তাঁর পুনর্নির্বাচন নিশ্চিত করা নিয়ে। আমেরিকায় লকডাউনের কারণে যেভাবে আর্থিক সংকট দানা বাঁধছে, তা ট্রাম্পকে রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় ফেলবে। সেই অবস্থা থেকে বাঁচার জন্য তিনি লকডাউন তুলে নেওয়ার পক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন বলেই আন্দাজ করা যায়।

কিন্তু ট্রাম্পের কথায় কি যুক্তি আছে? কেউই ট্রাম্পকে মহামারির সময়ের অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ হিসেবে মনে করেন না। কিন্তু মজার বিষয় হলো ট্রাম্প যখন এ বক্তব্য দেন, প্রায় একই সময়ে টাইমস অব লন্ডন-এর একটি প্রতিবেদনে প্রায় একই ধরনের বক্তব্য ছাপা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটির প্রকৌশল অনুষদের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বিষয়ের একজন বিখ্যাত অধ্যাপকের একটি গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, ‘করোনাভাইরাস লকডাউনের কারণে জিডিপি যদি ৬.৪ শতাংশের নিচে নেমে যায়, তাহলে এই ভাইরাসের হাত থেকে যত মানুষকে বাঁচানো যাবে, তার চেয়ে মানুষের গড় আয়ু অনেক বেশি হারাতে হবে।’

 দক্ষিণপন্থী কলামিস্টরা দ্রুত এ গবেষণা তথ্য লুফে নিয়েছেন এবং লকডাউন তুলে নেওয়ার পক্ষে কথা বলছেন। আরও ভয়ানক বিষয় হলো বিবিসি পর্যন্ত এটিকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছে। নানা ধরনের পরিসংখ্যান ব্যাখ্যা করে গবেষণাপত্রটিতে বলা হয়েছে, যেসব দেশের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির গড় বেশি, সেসব দেশের মানুষের গড় আয়ু বেশি হয়ে থাকে। ওই গবেষকের যুক্তি হলো লকডাউনের কারণে জিডিপি পড়ে যাবে এবং এর ফলে গড় আয়ু কমে যাবে।

ধনী দেশগুলোর মানুষ সাধারণত বেশি দিন বাঁচে, এ কথা ঠিক। কিন্তু তার মানে এই নয় যে বর্তমান সংকটের জের ধরে জিডিপিতে প্রবল ধস নামলে সেখানকার মানুষের গড় আয়ুতে ধস নামবে। আসলে জিডিপি এবং গড় আয়ুর সম্পর্ক খুবই জটিল এবং সম্ভবত এই সম্পর্ক দুভাবেই কাজ করে। অর্থাৎ জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঘটলে যেমন প্রবৃদ্ধি বাড়ে, তেমনি প্রবৃদ্ধি বাড়লে জনস্বাস্থ্যের উন্নতি হয় তথা গড় আয়ু বাড়ে।

তার চেয়ে বড় কথা হলো, ওই গবেষণাপত্রের যুক্তি স্বাস্থ্য ও সম্পদের প্রতিষ্ঠিত ধারণাকেই বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। দীর্ঘ মেয়াদে যদি প্রবৃদ্ধি কমে তাহলে হয়তো গড় আয়ুতে প্রভাব ফেলতে পারে। কিন্তু লকডাউনে যে মন্দাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তা সেই মাত্রার দীর্ঘমেয়াদি অচলাবস্থা সৃষ্টি করবে না, যা গড় আয়ুর ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।

অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী অ্যানগাস ডেটন এর ঠিক উল্টোটা দাবি করেছেন। অর্থনৈতিক অবস্থা ও গড় আয়ুর সম্পর্ক নিয়ে করা এক গবেষণায় তিনি বলেছেন, ‘নানান সময়ে, নানান জায়গায়, নানান গবেষণায় দেখা গেছে মন্দার সময় মৃত্যুহার কমে যায়।’ তিনি বলেন, মন্দার প্রাথমিক প্রভাবে গড় আয়ু বাড়তে দেখা যায়। তিনি উল্লেখ করেন, ২০০৮ ও ২০০৯ সালে মহামন্দার পর গ্রিস ও স্পেনের জনগণের গড় আয়ু বেড়ে গিয়েছিল।

মন্দায় গড় আয়ু বাড়ে—এ দাবি অনেকের কাছে অদ্ভুত লাগলেও এটিই সত্যি। অর্থনৈতিক সংকটের সময় ইউরোপের ওপর গবেষণামূলক নজরদারি করা হয়েছিল। তখন দেখা গেছে সংকটের সময় দুর্ঘটনা কম ঘটে। আরও অবাক করা বিষয় হলো এ সময় অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন ও এ সংশ্লিষ্ট রোগের কারণে মৃত্যুর পরিমাণ কমে যায়।

ট্রাম্প এ তথ্য সঠিক দিয়েছেন, সেটি হলো মহামন্দায় আত্মহত্যার ঘটনা ৪ শতাংশ বেড়ে যায়। কিন্তু সেই পরিমাণটাও অতি অল্প। মোট মৃত্যুর মাত্র ২ শতাংশ। কিন্তু এই সময়টাতে মোট মৃত্যুহার ৩.৪ শতাংশ কমে যায়।

কোভিড-১৯ একটি স্বল্পমেয়াদি স্বাস্থ্যসংকট। এটি দিয়ে দীর্ঘ মেয়াদের বেকারত্ব ও দারিদ্র্যকে আমন্ত্রণ জানানোর কোনো মানে হয় না।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

জনাথন পোর্টেস লন্ডনের কিংস কলেজের ইকোনমিকস অ্যান্ড পাবলিক পলিসি বিষয়ের অধ্যাপক