করোনা প্রতিরোধে লকডাউন ও কিটতত্ত্ব

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

উন্নত বিশ্বে যেখানে লকডাউন ঘোষণা করতে অনেকটাই দেরি করেছিল, যার মাশুল এখনো তাদের গুনতে হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশ সরকার সংক্রমণের ১৭ দিনের মাথায় দেশে লকডাউন ঘোষণা করে। দ্রুত লকডাউনের সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ যে কতটা উপকৃত হয়েছে, তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে। এটি নিঃসন্দেহে সরকারের একটি ভালো উদ্যোগ ছিল। যদিও প্রথম দিকে করোনা পরিস্থিতিকে পাত্তা না দেওয়া, মন্ত্রী ও সংশ্লিষ্টদের বাগাড়ম্বর, প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিয়ন্ত্রণহীনভাবে দেশে প্রবেশ করাসহ অন্য অনেক বিষয়ে সরকারের নড়বড়ে অবস্থান আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। প্রশংসনীয় এই সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতা লকডাউন শিথিল কিংবা তুলে নেওয়ার ক্ষেত্রে দেখাতে হবে।

হ্যাঁ, লকডাউন চলছে। কিন্তু লকডাউন তো সব সময় আর থাকবে না। একটা সময় লকডাউন শিথিল কিংবা তুলে নিতেই হবে। দীর্ঘ লকডাউনের ধকল বাংলাদেশের অর্থনীতি নিতে পারবে না। আমরাও লকডাউন শিথিল কিংবা তুলে নেওয়ার পরিকল্পনার কথা শুনতে পাই। কিন্তু প্রশ্ন হলো লকডাউন তুলে দেওয়ার সময় কি হয়েছে? আমরা যদি দৈনিক সংক্রমণের গ্রাফের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাই, ৩০তম দিনের পর সংক্রমণ জ্যামিতিক হারে ঊর্ধ্বগামী হয়েছে এবং এখন পর্যন্ত পরিস্থিতির কোনো উন্নতি নেই। এমন সময় লকডাউন শিথিল কিংবা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত মারাত্মক হতে পারে।

পোশাক কারখানাগুলো খুলতে শুরু করেছে, হাজার হাজার শ্রমিক আগের মতো আবার ঢাকায় আসতে শুরু করেছেন। এদিকে প্রধানমন্ত্রী আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখার জন্য বলেছেন, যদি করোনা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকে। তার অর্থ সরকার ধাপে ধাপে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে লকডাউন শিথিল কিংবা তুলে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে। তার আগে চারটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে।

প্রথমত, করোনা প্রতিরোধে বাংলাদেশের জন্য একটি সফল মডেল তৈরি করতে হবে এবং সেই মডেলের প্রতি জনগণকে আস্থায় নিতে হবে। ৬৮ হাজার গ্রামের প্রত্যেক স্বাস্থ্যকর্মীকে সক্রিয় করতে হবে। তাঁরা প্রত্যেক বাড়ি বাড়ি গিয়ে করোনা উপসর্গের সকল ব্যক্তির তথ্য গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মাধ্যমে আইইডিসিআরকে পাঠাবে। আইইডিসিআর ওই ব্যক্তিদের টেস্ট এবং চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করবে।

দ্বিতীয়ত, ৪০ থেকে ৬০ তম দিনের মধ্যবর্তী সময় উচ্চ আক্রান্তের দেশগুলোয় সংক্রমণ বেশি হয়েছে। আমরা এখন সেই সময় অতিক্রম করছি। আমরা মনে করছি, সংক্রমণের চতুর্থ স্তরে বাংলাদেশ রয়েছে। সুতরাং আগামী দুই থেকে তিন সপ্তাহ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। দু–তিন সপ্তাহ পর পরিস্থিতি বিবেচনা সাপেক্ষে লকডাউন শিথিল কিংবা ধাপে ধাপে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তুলে নেওয়া যেতে পারে।

তৃতীয়ত, দৈনিক সংক্রমণ নিম্নগামী হতে হবে এবং শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে এবং মৃত্যু অবশ্যই শূন্য হতে হবে।

সর্বশেষ, লক্ষণ আছে বা লক্ষণ নেই করোনায় আক্রান্ত সব ব্যক্তিকে টেস্ট এবং চিকিৎসার আওতাধীন করতে হবে। দেশব্যাপী হটস্পট চিহ্নিত এবং সেখানে লকডাউন আরও শক্তিশালী করতে হবে।

উপরিউক্ত বিষয়গুলো নিশ্চিতকরণে টেস্টের বিকল্প কিছু নয়। অনেকেই আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন যে আমাদের দেশে হয়তো আমেরিকা, ইতালি কিংবা স্পেনের মত হবে না। সংক্রমিত ব্যক্তির সংখ্যা লাখে পৌঁছাবে না। কারণ, আমাদের সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হার ওই দেশগুলোর তুলনায় কম। এই যুক্তি অবশ্যই হাস্যকর। বর্তমান হারে ভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষা যদি আগামী দুই সপ্তাহ ধরেও চলে, তাহলে সর্বমোট পরীক্ষার সংখ্যা লাখে পৌঁছাবে না। তাহলে শনাক্তের সংখ্যা সর্বদাই কম থাকবে এবং স্থানীয় সংক্রমণে দেশের প্রকৃত অবস্থা কখনোই জানা যাবে না। সুতরাং, যেকোনো মূল্যে টেস্ট বাড়াতে হবে।

এই বাস্তবতার মধ্যে পিসিআরের জটিল ও ব্যয়সাপেক্ষ টেস্টের পাশাপাশি, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র করোনাভাইরাস শনাক্তকারী কিট (জিআর কোভিড-১৯ ডট ব্লট) উৎপাদনে সক্ষম হয়েছে এবং তা হস্তান্তর করতে চেয়েছে বলে আমরা জেনেছি। যদি এই কিটের কার্যকারিতা এবং সংবেদনশীলতা ঠিক থাকে, তাহলে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করে এই কিট দিয়ে আগামী দুই সপ্তাহে দুই থেকে তিন লাখেরও বেশি মানুষের অল্প খরচে পরীক্ষা করা সম্ভব। আমরা কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের প্রকৃত অবস্থা জানতে পারব এবং এর ওপর ভিত্তি করে লকডাউন শিথিল কিংবা তুলে নেবার সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। শনাক্তকরণ কিট উদ্ভাবনী টিমের সব সদস্যকে অভিনন্দন, শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা। দেশের সংকটময় মুহূর্তে, স্বল্প খরচে, স্বল্প সময়ে ভাইরাস শনাক্তকরণ পদ্ধতি নিঃসন্দেহে তাদের একটি বড় এবং দেশের জন্য সম্মানজনক আবিষ্কার।

তবে এই উদ্ভাবন নিয়ে বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণির মানুষের ভেতর রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। গবেষক মহলে কৌতূহল রয়েছে যে উদ্ভাবিত কিটের কথিত অ্যান্টিবডি কোভিড-১৯–এর জন্য নির্ধারিত কি না। জানা গেছে, অ্যান্টিবডি সিস্টেমের পরিবর্তে অ্যান্টিবডি-অ্যান্টিজেন পেপটাইড ব্যবহার করা হয়েছে, যা কাঁচামাল হিসেবে চীন থেকে আমদানি করা হয়েছে। কিন্তু তাতে সমস্যা কী? আলোচ্য কিটের একটি সম্ভাবনা হলো ফলস নেগেটিভ কিংবা ফলস পজিটিভ রেজাল্ট দেওয়া। কিন্তু সেই সম্ভাবনাটুকুও সঠিকভাবে জানা দরকার। যদি প্রতি হাজারে ৮০০ ব্যক্তির ফলাফল সঠিক আসে আর ২০০ না আসে, সেটিও একটি বড় সাফল্য। ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করুন। জরুরি পরিস্থিতিতে এভাবে গবেষণা পরবর্তী ট্রায়াল হতে পারে। উদ্ভাবনী দলের এক সদস্য বলেছেন, ‘আমরা ফর্মুলা দিয়েছি, আপনারা টেস্ট করুন, সেনসিটিভিটি দেখুন, কার্যকারিতা দেখুন। তারপর সিদ্ধান্ত নিন যে এই কিট ব্যবহার করবেন, নাকি করবেন না।’ তাহলে সমস্যা কোথায়? কেন এই গড়িমসি?

এবার আসুন রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টিকে দেখি। কিটটিকে বলা হয় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কিট, কারণ উদ্ভাবনের পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়েছে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে এবং ‘কেন্দ্রে’ ছিলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী। কিট উদ্ভাবনে হয়তো তাঁর বৈজ্ঞানিক অবদান নেই, কিন্তু অন্যান্য সমর্থন ছিল, যা ছাড়া উদ্ভাবন আরও দীর্ঘায়িত হতো। উদ্ভাবনী দলের মূল সদস্যরা কিন্তু অধিকাংশই গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বাইরের গবেষক। তাঁরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সুনামের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত গবেষক। জাফরুল্লাহ চৌধুরী একজন সম্মানিত ব্যক্তি, যাঁর রাজনৈতিক পরিচয় পেশাদারি পরিচয়ের চেয়ে বেশি প্রকাশিত। তার কথাবার্তা-কাজকর্মে রাজনীতি থাকাটাই স্বাভাবিক। আমরা সে রকমই দেখেছি। কিট তৈরির আগে তাঁর বক্তব্য অনেক সময় ছিল অপ্রাসঙ্গিক এবং বিভ্রান্তিমূলক। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত তিনি যদি অন্তরালে থেকে তাঁর টিমের সদস্যদের সামনে রাখতেন, তাহলে অনেক অনভিপ্রেত ঘটনা এড়ানো যেত।

অন্যদিকে, করোনা পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশের ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীসহ স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে এই কিট উদ্ভাবনে উৎসাহ জুগিয়েছেন এবং সহযোগিতা করেছেন। সেখানে ওষুধ প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের তৎপরতা এবং উদ্ধত আচরণ আমাদের আহত করেছে। করোনাভাইরাস শনাক্তকরণে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কিট উদ্ভাবক দলের সদস্য এবং নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. ফিরোজ আহমেদের এ–সংক্রান্ত একটি উক্তি উদ্ধৃতি করছি, ‘কিট জমা দিতে যাওয়ার পর ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) তাঁর কার্যালয় থেকে আমাকে বের করে দিয়েছেন। জাতিকে বাঁচাব, এটা ছিল আমাদের উদ্দেশ্য। আমরা যারা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছি, সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছি, শোষণবিহীন সমাজের স্বপ্ন দেখি, আমরা যারা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে সমর্থন করি, আমরা যারা সাবেক বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, তারাই বলছি, সরকারকে আমরা বাঁচাতে চাচ্ছি। দেশটাকে বাঁচাতে চাচ্ছি, জনগণকে বাঁচাতে চাচ্ছি।’

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, একজন সম্মানিত শিক্ষক এবং গবেষককে এভাবে লাঞ্ছিত করাতে শিক্ষক সমাজ আজ আহত এবং অপমানিত বোধ করছে। যেখানে তাঁর প্রাপ্য ছিল প্রশংসা, সেখানে তিনি অপমানিত হলেন। আমরা আপনার দিকে তাকিয়ে আছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। সামনের যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার চেষ্টা অভ্যন্তরীণভাবই করতে হবে— এমন একটি ঘোষণা আপনার কাছে আশা করছি। আপনি ‘জিআর কোভিড-১৯ ডট ব্লট’ কিটের কার্যকারিতা এবং সেনসিটিভিটি নিরূপণের জন্য দ্রুত সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিন। আমরা ভালো কিছুর প্রত্যাশায়।

ড. মো. তাজউদ্দিন সিকদার: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ ইনফরমেটিক্স বিভাগের সভাপতি ও সহযোগী অধ্যাপক।