কাজের ধরন বদলে দিতে পারে কোভিড-১৯

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

কোভিড–১৯–এর প্রভাবে বন্ধ হয়ে গেছে অফিস-আদালত, কলকারখানা, দোকানপাট। কিন্তু কাজ একদম থেমে নেই। কাজ হচ্ছে ঘর থেকে, অন্তর্জালভিত্তিক। উন্নত দেশগুলোয় এর আগেই ঘর থেকে কাজ করার সংস্কৃতি চালু হলেও বাংলাদেশে এই অভিজ্ঞতা এবারই প্রথম। তাই দেখা যাচ্ছে, আগে যেখানে বৈঠক করার জন্য কর্তাদের যানজট ঠেলে সময়মতো অফিসে পৌঁছানোর জন্য রীতিমতো যুদ্ধ করতে হতো, সেই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে এখন আর সশরীরে যেতে হচ্ছে না। জুমের মতো অনেক ভিডিও কনফারেন্সিং প্ল্যাটফর্মের কল্যাণে এখন ঘরে বসেই তা করা সম্ভব হচ্ছে।

শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা পৃথিবীতেই এখন বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। এই মহামারি করপোরেট সংস্কৃতিতে পরিবর্তন নিয়ে আসবে বলে মনে করছেন অনেকে। কর্মীরা এভাবে কাজ করেও যখন স্বাভাবিক উৎপাদনশীলতা বজায় রাখতে পারছেন, তাতে এই প্রশ্ন ওঠা খুবই স্বাভাবিক, তাহলে সাধারণ সময়ে প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা কেন। করপোরেট জগতে ব্রেকফাস্ট বা লাঞ্চ মিটিংয়ের চল শুরু হয়েছে। কিন্তু এখন সেসব বৈঠকের কাজ অনায়াসে জুমের মাধ্যমে হয়ে যাচ্ছে। এসব বৈঠক অনেক সময় পাঁচ তারকা হোটেলেও হতো। এই পরিস্থিতিতে সেই টাকা বেঁচে যাচ্ছে। করোনাভাইরাসের সংকট কেটে যাওয়ার পরও যদি এই সংস্কৃতি চালু থাকে, তাহলে প্রতিষ্ঠানগুলো সেই টাকা কর্মীদের পেশাগত উন্নয়নে বা তাদের নিরাপত্তায় ব্যয় করতে পারে। তবে বিষয়টি মনোভঙ্গির ওপর নির্ভরশীল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

এই প্রসঙ্গে উন্নয়ন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ আনিস পারভেজ বলেন, ‘আমাদের কর্মসংস্কৃতিতে সময় ও মেধা অপচয়ের রীতি আছে। বসের কাছে ধরনা দেওয়া বা তাঁর মনোতুষ্টির জন্য কথা বলা—এসব না করলে যেন ঠিক অফিস অফিস মনে হয় না আমাদের। এমনকি যে অনুমতি ফোনে বা যোগাযোগ অ্যাপের মাধ্যমে নেওয়া যায়, সেটাও বসের আসা পর্যন্ত আটকে থাকে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কোভিড-১৯ আমাদের এই সংস্কৃতি বদলানোর সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছে। ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে অনেক কাজ হয়ে যাচ্ছে। এমনকি এসব প্ল্যাটফর্মে যাবতীয় নথি উপস্থাপন করা যায়। আমি নিজেও চারটি দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঘরে বসেই কাজ করছি।’ কাজের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্য কাজ—এই কথাটি মনে রাখতে হবে বলে মত দেন আনিস পারভেজ। বলেন, এটি মনে রাখলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। সারা পৃথিবীতেই এখন এটি চর্চিত হচ্ছে। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে অন্তর্জালভিত্তিক কাজের সংস্কৃতি চালু করতে জাতীয় পরিসরে কর্মপরিকল্পনা থাকতে হবে, ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড় তিন পর্যায়েই।

আনিস পারভেজ আরও বলেন, মূল বিষয়টি হলো কাজটা হওয়া। কীভাবে হলো, সেটা অনেক ক্ষেত্রেই বড় বিষয় নয়। উন্নত দেশে রাস্তায় যানজট নেই, নেই ধুলাবালু, তারপরও সেখানে বাড়ি থেকে কাজ করার সংস্কৃতি কয়েক বছর ধরে চর্চিত হচ্ছে। প্রতিদিন না হলেও সপ্তাহের নির্দিষ্ট কিছুদিন তাঁরা বাড়ি থেকে কাজ করছে। এতে মানুষ পরিবারের সঙ্গে বেশি সময় কাটাতে পারছেন। মন ভালো থাকছে। মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার অনেক গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, কর্মসন্তুষ্টি মানুষকে আরও বেশি উৎপাদনশীল করে তোলে। আর অনেক কাজ যেখানে একটি ভিডিও কনফারেন্সিং/কলের মাধ্যমে করা সম্ভব, তার জন্য ঘণ্টাখানেক রাস্তায় বসে থাকার মানে খুঁজে পান না অনেকেই। এতে অর্থের অপচয় হয়। প্রভাব পড়ে মানুষের স্বাস্থ্যেÑশারীরিক ও মানসিক। অন্তর্জালভিত্তিক কাজের সংস্কৃতি চালু হলে রাস্তায় গাড়ি কমবে। কমবে যানজট। ভালো থাকবে পরিবেশ। এ ছাড়া কার্যালয়ের বিদ্যুৎ ব্যবহারও অনেক কমবে। মানুষ পরিবারের সঙ্গে আরও বেশি সময় কাটাতে পারবে। বিশেষ করে নারীদের জন্য এটি খুবই ভালো হবে বলে মনে করেন মানবসম্পদ বিশ্লেষকেরা। অফিসে যাওয়া এবং বাসায় ফেরার যে যন্ত্রণা, তা থেকে মুক্তি মিলবে।

সহজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মালিহা কাদির এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা আসলে প্রযুক্তির ব্যবহারের সঙ্গে অতটা পরিচিত নই। প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনেক কিছুই করা সম্ভব। কোভিড-১৯ আমাদের অন্তত সেই শিক্ষাটা দিয়েছে। এ ছাড়া বাড়ি থেকে কাজ করলে কর্মীদের উৎপাদনশীলতা বাড়ে। মহামারির পর আমরা সীমিত পরিসরে হলেও এই সংস্কৃতি চালু রাখার চেষ্টা করব।’

তবে মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সব কর্মীকে বাড়ি থেকে কাজ করানো সম্ভব নয়। সামাজিকীকরণ বা দল গঠনের জন্য মাঝেমধ্যে একত্র হওয়া দরকার। তবে কার্যালয়ে বড়জোর ৩০ শতাংশ কর্মী থাকলেই চলে। এটি আবার উৎপাদনশীল কারখানায় সম্ভব নয়, সম্ভব মেধাভিত্তিক কাজে, বিশেষ করে প্রযুক্তিভিত্তিক কাজে। এ ক্ষেত্রে এটি খুবই যথাযথ বলে মনে করছেন মানবসম্পদ বিশ্লেষকেরা।

ঘর থেকে কাজ করার এই সংস্কৃতি আবার প্রযুক্তিভিত্তিক ফ্রিল্যান্সারদের নতুন কাজের সুযোগ করে দেবে বলে মনে করেন বেসিসের সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর। সম্প্রতি অন্য এক প্রসঙ্গে আলোচনার সময় তিনি বলেন, করোনার এই সময়ে মানুষ ভিডিও কনফারেন্সিংয়ে অভ্যস্ত হয়েছে। এই সংস্কৃতি হয়তো মহামারির পরও চালু থাকবে। তখন এ ক্ষেত্রে ফ্রিল্যান্সারদের কাজ করার নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে। অন্যদিকে, তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই অন্তর্জালভিত্তিক কাজের সংস্কৃতি চালু হলে ইন্টারনেট ব্যবস্থায় চাপ পড়বে। পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি থাকলে তা হয়তো সামাল দেওয়া সম্ভব হবে। এই মুহূর্তে তাঁরা একদম ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলতে চান না।