ডাক্তার কেন মুখ লুকাবে?

সেদিন সকালে একজন পরিচিত ডাক্তারের সঙ্গে টেলিফোনে কথা হচ্ছিল, যিনি এই করোনাকালে সামনের সারি থেকে রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। কথা শুনে বোঝাই যাচ্ছিল তিনি খুবই আপসেট হয়ে আছেন। অনেকক্ষণ আলাপের পর তিনি এর কারণ জানালেন। তাঁর করোনা টেস্ট পজিটিভ এসেছে। তাঁর পরিবারের বাইরে প্রতিবেশী কাউকে জানাননি তাঁর আক্রান্ত হওয়ার কথা। তিনি একা একটি ঘরে আইসোলেশনে আছেন। ঘরের বাতি নিভিয়ে রাখেন, ফিসফিস করে ফোনে কথা বলেন যেন তাঁর ছোট ছোট ছেলেমেয়ে দুটি টের না পায় যে তাঁদের বাবা বাসায় আছে। টের পেলে তাঁদের কাছে আসা থেকে আটকে রাখা অনেক কষ্টের হবে।

আলাপের শেষে তিনি আমাকে অনুরোধ করলেন, আমি যেন কাউকে এই সংবাদটি না জানাই। না জানানোর কারণটিও বললেন আমাকে। সামাজিকভাবে হেনস্তা হওয়ার ভয়। পত্রিকার খবর বলছে, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় একজন ডাক্তার তাঁর পরিবারের ১৭ জন সদস্যসহ করোনা পজিটিভ হওয়ায় এলাকার লোকজন বাড়িতে ঢিল ছুড়েছে এবং বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে।

আমি ভাবতে বসেছি, করোনায় আক্রান্ত ডাক্তার কেন মুখ লুকাবেন!

১. বারবার ঘরে থাকতে বলার পরেও যিনি অকারণে বাইরে গিয়েছেন, মসজিদে নামাজ পড়ার জন্য ছুটে গিয়েছেন, জানাজায় শামিল হয়েছেন, বাজারের ভিড়-জনসমাগমে গিয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এবং সর্বোপরি রোগের উপসর্গ লুকিয়ে, তথ্য গোপন করে ডাক্তারকে ঝুঁকিতে ফেলেছেন, তাঁর উচিত লজ্জায় মুখ ঢাকা।

২. নিজেরা সুরক্ষিত স্থানে বসে থেকে সরকারি যে কর্তৃপক্ষ, যে প্রতিষ্ঠান মানহীন মাস্ক সরবরাহ করেছে; ফটোসেশন করার জন্য, সংবাদমাধ্যমে কাভারেজ পাওয়ার জন্য যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান রেইনকোট কোয়ালিটির পিপিই সরবরাহ করে ডাক্তারদের মিথ্যা নিরাপত্তা দিয়ে করোনার মুখে ঠেলে দিয়েছেন, তাঁদের উচিত লজ্জায় মুখ ঢাকা।

৩. যেসব কি-বোর্ড যোদ্ধা ‘পিপিই’–এর দরকার কী?’ ‘পিপিই আর কিছু না, ডাক্তারদের কাজ না করার বাহানা’ বলে বলে ডাক্তারদের ওপর সামাজিক চাপ তৈরি করেছেন সুরক্ষা ছাড়াই সেবা দিয়ে যেতে এবং আক্রান্ত হতে, তাঁদেরই তো উচিত লজ্জিত হওয়া।

৪. চিকিৎসকেরা যখন পিপিইর অভাবে চরম ঝুঁকি নিয়ে রোগী দেখছেন, তখন যাঁরা ক্ষমতার জোরে পিপিইগুলো অপ্রয়োজনীয়ভাবে পরে ফটোসেশন করেছেন, তাঁদের উচিত মুখ লুকানো।

৫. দায়িত্বপূর্ণ চেয়ারে বসে থাকে যাঁরা আশ্বস্ত করার নামে বারবার ‘প্রস্তুত আছি’ রেকর্ড বাজিয়ে গেছেন, গ্যারান্টি দিয়ে বলেছেন করোনা কখনো বাংলাদেশে আসবে না, বেশি তাপমাত্রায় করোনা বাঁচে না, যাঁদের দেওয়া ভুল তথ্য চিকিৎসা দেওয়া ডাক্তারদের সতর্ক হওয়া থেকে বিরত রেখেছে, তাঁদের উচিত মুখ লুকানো।

৬. যে হাসপাতাল প্রশাসন কোভিড রোগীকে আলাদা করার জন্য হাসপাতালে ট্রিয়াজ তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে এবং মাধ্যমে কর্মরত অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর পাশাপাশি ডাক্তারকে অপ্রস্তুত অবস্থায় রোগীদের সামনে ফেলেছেন, সেই হাসপাতাল প্রশাসনের উচিত লজ্জিত হওয়া।

৭. করোনা ঠেকাতে ‘টেস্ট টেস্ট টেস্ট’–এর যেখানে বিকল্প নেই, সেখানে টেস্ট করার সুযোগ সারা দেশে ছড়িয়ে না দিয়ে একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে আটকে রাখার আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত যাঁরা নিয়েছিলেন, লজ্জিত হওয়ার কথা তাঁদের।

৮. রোগ ছড়ানো বন্ধ করতে সঠিক সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, বিদেশ থেকে আসা ফ্লাইট, যানবাহন চলাচল ইত্যাদি বন্ধ করার সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে যাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন, মুখ লুকানোর কথা তাঁদের।

৯. বিশ্বের কোনো দেশেরই যে রোগ থেকে চিকিৎসার মাধ্যমে লোকজনকে সারিয়ে তোলার সামর্থ্য নেই, সেই কোভিড–১৯–কে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ঠেকানোর চেষ্টা না করে যেসব নীতিনির্ধারক সমস্ত চাপ সামর্থ্যহীন হাসপাতালের দিকে ঠেলেছেন, ডাক্তারদের শুধু অসহায়ই করে তুলেছেন, তাঁদের উচিত এই সময়ে মুখ লুকানো।

১০. ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা যেসব যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ‘কোয়ারেন্টিন’, ‘আইসোলেশন’, ‘সামাজিক দূরত্ব’–এর মতো দুর্বোধ্য শব্দমালা ব্যবহার করে কোভিড বিষয়ে সাধারণ মানুষকে আরও অপ্রস্তুত, সিদ্ধান্তহীন করেছেন, পরোক্ষভাবে রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছেন এবং প্রকারান্তরে হাসপাতালে চিকিৎসককে চাপে ফেলেছেন, মুখ লুকানোর দলে তো তাঁদের থাকা উচিত।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, যাঁদের কথা বললাম, তাঁরা কেউই মুখ লুকিয়ে নেই। তাঁরা উচ্চকণ্ঠে চিকিৎসকদের ভুল ধরে বেড়াচ্ছেন, সেজেগুজে নিয়মিত টেলিভিশনে মুখ দেখাচ্ছেন, পত্রিকায় বিবৃতি দিচ্ছেন। লজ্জার লেশমাত্র নেই তাঁদের কারও চেহারায়।

কোভিড–১৯–এ আক্রান্ত ব্যক্তিদের সেবায় সামনের সারিতে থাকা চিকিৎসক, আপনি তো হাসপাতালগুলোয় সীমাহীন লুটপাটের অংশীদার নন। হাসপাতালের অব্যবস্থাপনার দায় কোনোভাবেই আপনার ঘাড়ে পড়ে না। কোভিড–১৯ রোগীর সেবা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হলে আপনি কেন মুখ লুকাবেন?

আপনি আমাদের কোভিড–বীর। আপনাকে অভিবাদন।

ড. রোমেন রায়হান: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
[email protected]