১ মে: আজকের দিনে আরও যা ঘটেছিল

করোনাভাইরাসের কারণে সতর্কতা হিসেবে গ্রিসের অ্যাথেন্সে মে দিবসের জমায়েত হয় সামাজিক দূরত্ব মেনে। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাসের কারণে সতর্কতা হিসেবে গ্রিসের অ্যাথেন্সে মে দিবসের জমায়েত হয় সামাজিক দূরত্ব মেনে। ছবি: রয়টার্স

পয়লা মে মানেই হে মার্কেট, পয়লা মে মানেই ধর্মঘট, লাল পতাকা, শ্রমিক মিছিল। পয়লা মে মানে মে দিবস'; আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। পয়লা মে মানে ১৮৮৬, ধর্মঘটে হামলা। ১১ জোড়া মৃত চোখ। ক্যালেন্ডারের কোনো কোনো তারিখকে ইতিহাসের কোনো কোনো ঘটনা এমন করেই পুরোটা নিয়ে নেয়। সেই তারিখটির পরিচয় ও অস্তিত্বই তখন হয়ে যায় সেই ঘটনা। পয়লা মের ক্ষেত্রেও এমনটিই ঘটেছে। অথচ সত্য তো এই যে, ১৮৮৬ সালের আগেও মে মাসের ১ তারিখ ছিল, তারপরও হয়েছে।

বেশি দূর নয় ১৮৮৬ সাল থেকে মাত্র দু বছর আগে গেলেই পাওয়া যাবে হে মার্কেটের ঘটনার সূত্রটিকে। ১৮৮৪ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকেরা দিনের কর্মঘণ্টা আট ঘণ্টা করার দাবি প্রথমবারের মতো ঘোষণা আকারে জানান। আরও আগে যদি যাওয়া যায় তবে আরও অনেক চমকপ্রদ ঘটনার দেখা পাওয়া যাবে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাবে ১ মের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানবমুক্তি ও অধিকার সম্পর্কিত নানা ঘটনা।


স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা
১৩২৮ সালের ১ মে স্কটিশ স্বাধীনতা সংগ্রাম সমাপ্ত হয়। এ যুদ্ধের পরই ইংল্যান্ড স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়, স্বাক্ষরিত হয় শান্তির সনদ। অবশ্য ১৩৩২ সাল থেকেই দ্বিতীয় পর্যায়ের যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, যা চলেছিল ১৩৫৭ সাল পর্যন্ত।


সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন

আজকের দুনিয়ায় বিজ্ঞাপন ছাড়া সংবাদপত্র কল্পনাই করা যায় না। শুধু সংবাদপত্র কেন টিভি চ্যানেল থেকে শুরু করে মিডিয়া মাত্রই বিজ্ঞাপন। অবশ্য ছোট পরিসরে কোনো আন্দোলন বা গোষ্ঠীর প্রচারপত্র হিসেবে প্রকাশিত পত্রিকার কথা আলাদা। সে যাই হোক, এই বিজ্ঞাপনের প্রথম প্রকাশও কিন্তু হয়েছিল ১ মে। ১৭০৪ সালে বোস্টন নিউজলেটারে প্রথমবারের মতো কোনো বিজ্ঞাপন ছাপা হয়। এটি ছিল নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ডের ওয়েস্টার বের একটি এস্টেটের ক্রেতার খোঁজে দেওয়া ঘোষণা।


উদ্ভিদের শ্রেণিবিন্যাসবিদ্যার স্বীকৃতি

১৭৫৩ সালের পয়লা মে-তেই কিন্তু উদ্ভিদের শ্রেণিবিন্যাসবিদ্যাকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়। উদ্ভিদের নামকরণে বিজ্ঞানী ক্যারোলাস লিনিয়াসের পন্থাকে এ দিনেই স্বীকৃতি দিয়েছিল ইন্টারন্যাশনাল কোড অব বোটানিক্যাল নোমেনক্লেচার (আইসিবিএন)। আর হ্যাঁ, এই দিনেই কিন্তু প্রকাশিত হয়েছিল ক্যারোলাস লিনিয়াসের বিখ্যাত বই স্পেসিস প্লান্টেরাম।


ভিয়েনার মঞ্চ মাতালেন মোৎজার্ট

১৭৮৬ সালের ১ মে-তেই ভিয়েনার বার্গথিয়েটারে মঞ্চস্থ হয়েছিল উলফগ্যাং আমাদিউস মোৎজার্টের বিখ্যাত অপেরা 'দ্য ম্যারিজ অব ফিগারো'। তখনকার স্প্যানিশ সাহিত্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠা সাধারণ গল্প নিয়েই ছিল অপেরাটি। এক ধনীর দুলালির সঙ্গে গরিবের ছেলের প্রণয় ও পরিণয়ই ছিল এর উপজীব্য।

করোনায় ঘরবন্দী, তাতে কী। সুইজারল্যান্ডের জুরিখে সাধারণ মানুষেরা ঘরের বারান্দা থেকেই থালা-বাটি বাজিয়ে, লাল কাপড় উড়িয়ে মজুরি বৃদ্ধির দাবি জানালেন। ছবি: রয়টার্স
করোনায় ঘরবন্দী, তাতে কী। সুইজারল্যান্ডের জুরিখে সাধারণ মানুষেরা ঘরের বারান্দা থেকেই থালা-বাটি বাজিয়ে, লাল কাপড় উড়িয়ে মজুরি বৃদ্ধির দাবি জানালেন। ছবি: রয়টার্স

শতবর্ষী প্রকল্পের যাত্রবিন্দু

গ্রিম ভাইদের মনে আছে? সেই যে জ্যাকব ও উইলহেম গ্রিম? জার্মান এই দুই ভাই অভিধান রচনার যে কষ্টকর কাজটি শুরু করেছিলেন, তার প্রাথমিক সাফল্যও কিন্তু এসেছিল ১ মে। ১৮৫২ সালের এই দিনে তাঁদের রচিত জার্মান অভিধানের প্রথম খণ্ডটি প্রকাশিত হয়। এই অভিধান রচনার কাজটি সমাপ্ত হয়েছিল ১৯৬১ সালে।

এমন বহু ঘটনার সাক্ষী পয়লা মে। কিন্তু ১৮৮৬ সালের ১ মে বাকি সব ঘটনাকেই ঢেকে দিল। সেদিনের পর থেকে বাকি সব ঘটনাই যেন ওই এক দিনের বিশালত্বের কাছে চাপা পড়ে গেল। এটি হয়েছে শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে ও বিপক্ষে থাকা উভয় অংশের কারণেই। শ্রমজীবীদের পক্ষের মানুষেরা শ্রমিক অধিকার রক্ষার সেই আন্দোলনের স্মরণে প্রতি বছর মিছিল, সভা সমাবেশ করেন। আর বিরুদ্ধ গোষ্ঠী বরাবরই এগুলো পণ্ড করবার চেষ্টা করে। যেমনটা করেছিলেন ১৯২৩ সালে অ্যাডলফ হিটলার। মে দিবসের জমায়েতে তিনি তাঁর লোকেদের দিয়ে হামলা করান। আবার ১৯১৯ সালে গেলে আমরা পাব আন্তোনিও গ্রামসিকে, যিনি তাঁর বিখ্যাত সমাজতান্ত্রিক সাপ্তাহিক পত্রিকা নববিন্যাস বা 'দ্য নিউ অর্ডার' প্রথম প্রকাশ করেন এই দিনেই।

তাকানো যেতে পারে ১৯৬১ সালের দিকে, যখন কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রো শ্রমিক দিবসের সমাবেশ থেকে কিউবাকে সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ঘোষণা দেন এবং সব ধরনের নির্বাচনকে নিষিদ্ধ করেন। তাকানো যাক ১৯৭৩ সালের দিকে, যখন নিয়মিত মজুরি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ঠেকানোর দাবিতে এই মে দিবসেই ধর্মঘটে ও মিছিলে নেমেছিলেন ইংল্যান্ডের ১৫ লাখের বেশি শ্রমিক।

১৮৮৬ সালের আগের পয়লা মে ও পরের পয়লা মে-এর মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য ব্যবধান গড়ে দিয়েছে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের চেতনা। ১৮৮৬ সালের পরের মে-দিবসগুলো আবর্তিত হয়েছে এই অধিকার চেতনাকে ঘিরেই। হ্যাঁ, ১৯৩১ সালের এই দিনেই উদ্বোধন হয়েছে এম্পায়ার স্টেট ভবন, ১৯৪১ সালের এই দিনেই প্রথমবারের মতো প্রদর্শিত হয়েছিল বিখ্যাত চলচ্চিত্র 'সিটিজেন কেইন'; কিন্তু এসব ঘটনাকে তখন দেখা হয়েছে মে-দিবসের প্রেক্ষাপটেই। সামনের মে-দিবসগুলোকেও এভাবেই দেখা হবে।