ফেসবুকে প্রদর্শনী ভাইরাসের প্রতিষেধক কী?

বাংলাদেশে ক্যামেরার অশ্লীল ব্যবহার বিপজ্জনক রকম ছোঁয়াচে হয়ে উঠেছে। হাতে হাতে ক্যামেরা এসে পড়লে সমাজের দশা যে কী হবে, ফ্রান্সের সংস্কৃতিতাত্ত্বিক পল ভিরিলিও আজ থেকে আঠারো বছর আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তাঁর দ্য ভিজ্যুয়াল ক্রাশ ধারণার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে বাংলাদেশের মাঠের রাজনীতিকদের অশ্লীল প্রদর্শনীকামিতা। এ কারণে দ্য ভিজ্যুয়াল ক্রাশকে নাম দিচ্ছি প্রদর্শনী ভাইরাস।

এক সাংসদ কৃষকের কাঁচা ধান কেটেছেন। সেই ছবি-ভিডিও অনেকেই দেখেছেন। পাকা ধান পাওয়া যায়নি। তাই কাঁচাই সই। যিনি এই কাজটি করেছেন, তিনি লজ্জা তো পেলেনই না উল্টো নানা রকম হাস্যকর ব্যাখ্যা-অজুহাত দিচ্ছেন। এ রকম একটি-দুটি নয়, শয়ে শয়ে ছবি ভিডিও আছে সামাজিক মাধ্যমে। কৃষকের ধান কেটে দেওয়ার নাম করে জনপ্রতিনিধি ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা-নেত্রীরা সদলবলে গিয়ে কৃষকের খেতের ধান মাড়িয়ে একাকার করে দিয়ে এসেছেন। আমরা দেখেছি নিরন্নদের হাতে আধা কেজি চাল ধরিয়ে দিয়ে তার ওপর ডজন ডজন দাতা হাত রেখে ছবি তুলেছেন। এমনকি সরকারি ত্রাণ দিতে গিয়েও সবাই ত্রাণগ্রহীতাদের ছবি-ভিডিও রাখতে ছাড়ছেন না। মূল দায়িত্বের প্রতি তাঁদের মনোযোগ সামান্যই। আসল মনোযোগ ছবি-ভিডিওতে।

এসব কিছুরই উদ্দেশ্য ফসল কাটায় সহায়তা নয়, ছবি তোলা ও ভিডিও করে রাখা। সেগুলো আয়নায় বাঁধিয়ে অফিসের দেয়ালে ঝুলিয়ে নিজেদের দানবীর ও গণমানুষের নেতা প্রমাণ করা। সামাজিক মাধ্যমে তো বটেই, স্থানীয় সুবিধাভোগী হলুদ কাগজে ও অনলাইন পত্রিকায় ছাপানো।

২০০২ সালে ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস Ctrl [space]: Rhetorics of Surveillance from Bentham to Big Brother নামে যে ঢাউস আকারের সংকলনটি ছাপে, সেখানেই পল ভিরিলিওর প্রবন্ধটি যুক্ত হয়। পল বলেছিলেন, রাজনীতিকেরা ক্যামেরা ব্যবহার করবে জনগণকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য। বিশেষ করে বিরোধী পক্ষের কে কে কোথায় যায়, কী কী করে, কী কী খায়—সবকিছু নজরে রেখে প্রমাণ বানিয়ে শায়েস্তা করতে পারার জন্য। জর্জ অরওয়েল যেমনটি বলেছিলেন, বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং—বড় মিয়া (ক্ষমতাধর) কিন্তু সব দেখছেন! সুতরাং সাধু সাবধান! সমাজবিজ্ঞানী ও দার্শনিক জেরেমি বেন্থামের প্যানঅপটিকন বা কারাগারি-নজরদারি ধারণার আলোকে মিশেল ফ্যুক্যো এবং জ্যিল ডেল্যুজও এ রকমই ভেবেছিলেন। কিন্তু পল ভিরিলো আরও কয়েক কদম এগিয়ে ভবিষ্যৎকে দেখলেন। বললেন, নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যকে ছাড়িয়ে নজরদারি নানা রকম বিকৃতির দিকে যাবে। প্রথম পর্যায়ে খারাপের দিকে যেতে যেতে অশ্লীল অবলোকনকামিতায় (ভয়্যারিজম) মোড় নেবে। সেই প্রমাণ দেদার মিলছে। মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তা বলে আর কিছু থাকছে না। আড়ংয়ের স্টোরগুলোর নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাও ঠুনকো প্রমাণিত হয়েছে। একজন ভয়্যার—গোপন দর্শনকারী নারীদের পোশাক-বদলকক্ষে গোপন ক্যামেরা বসিয়ে শতাধিক ভিডিও করেছিল। কেউ টেরও পায়নি। ঘটনাটি ২০১৮ সালের।

বাংলাদেশের রজনীতিকদের অশ্লীল প্রদর্শনকামী খাসলতটি ব্যাখ্যা করতে গেলে পল ভিরিলিওর দ্বিতীয় পর্যায়ের বিকৃতি আলোচনাটি লাগবেই। পল বলেছিলেন দ্বিতীয় পর্যায়ে নিজেরাই নিজেদের ছবি-ভিডিও নির্মাণ করবে। উদ্দেশ্য প্রচার-প্রচারণা, নিজের ঢাকঢোল নিজের পেটানো। বাড়বে নার্সিসিজম বা আত্মপ্রেম এবং একজিবিশনিজম বা প্রদর্শনকামিতা। লোক দেখানোই হয়ে উঠবে মুখ্য। এবং প্রদর্শনকামী লাজলজ্জা, সম্মানবোধ, অন্যদের পছন্দ-অপছন্দের মনোভাববিষয়ক কোনো কিছুকেই আর আমলে নেবে না। পল বললেন, লাইভ ক্যামেরার বিস্তার (প্রলিফারেশন অব লাইভ ক্যামেরাস)–এর ফলে বিশ্বময় নজরদারির জনপ্রিয়তা যথাতথা-যত্রতত্র (দ্য ব্যানালাইজেশন অব পপুলারাইজেশন অব গ্লোব্যাল সার্ভিল্যান্স) হয়ে উঠবে। তাতে পরিণতিটি কী হবে? পরিণতি—ডেমোক্র্যাটাইজেশন অব ভয়্যারিজম বা গুপ্তদর্শনকামিতার গণতান্ত্রিকীকরণ। গণতন্ত্র যেমন গোপন কিছু নয়, প্রকাশ্য; প্রদর্শনবাদও প্রকাশ্য হয়ে উঠবে। গণতন্ত্র যেমন অধিকার, এই প্রকাশ্য প্রদর্শনবাদকেও মনে হবে যেন অধিকার। এ পর্যায়টি জনপরিসরের পর্যায়। তবু সবাই ভয়্যার। ফলে কেউ কাউকে দেখে ফেলার মধ্যে আর সংকোচের কিছু থাকবে না। ছবি-ভিডিওতে আত্মপ্রচারণা, আত্মপ্রেম, আত্মমগ্নতা সবকিছুই এই পর্যায়ে চাক্ষুষ। সামনাসামনি। পাকাপাকি লাজলজ্জাহীনভাবেই ঘটবে ক্যামেরার ব্যবহার। একটি কারণ থাকবে উন্মুক্ত অনলাইন পরিসরে নিজেকে প্রচার করার লোভ বা সাইবার-এক্সিবিশনিজম। এটি তাই একটি ভাইরাসের মতোই।

বাংলাদেশের রাজনীতিকদের মধ্যে এই প্রদর্শনী ভাইরাসটির ছড়াছড়ি বেশি কেন? কী কী সমাজতাত্ত্বিক কারণ থাকতে পারে? মূল কারণ, তাঁরা জল না চাইতেই বৃষ্টির মালিক। নির্বাচিত হতে ভোট লাগেনি। জনগণকে লাগেনি। কিন্তু ভবিষ্যতেও এমন রৌদ্রোজ্জল দিন থাকবে সেই নিশ্চয়তা নাই। পরের দফায় পার্টি নমিনেশন পাবেন সেই গ্যারান্টিও নেই। নির্বাচনহীনতার অবাধ সুবিধা নিতে নতুন নতুন সুবিধাভোগী এবং সুবিধাপ্রত্যাশীরা প্রাণপণ উঠেপড়ে লাগবে। যেহেতু কোনো প্রমাণ নেই তাঁরা জনপ্রিয় কিনা, তাই তাঁদের বাদ পড়া ও ছিটকে পড়ার ঝুঁকিই বেশি। কারণ, নতুন সুবিধাভোগীকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান। সে ক্ষেত্রে যত বেশি জনসম্পৃক্ততার প্রমাণ দেখানো যাবে, ততই পুনরায় নমিনেশন পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।

কেন এই কদাচারটি একধরনের প্রদর্শনী ভাইরাস? কারণ, রাজনীতিকেরাই এই রোগটি ছড়ান। অধস্তন ও শিক্ষানবিশ ছাত্র-যুবা রাজনীতিকেরা তাঁদের দেখেই শেখেন এবং এভাবে আচরণগুলো প্রজন্মান্তরে ছড়ায়। রাজনীতিকদের দেখাদেখি প্রশাসনের নানা পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিরাও এই খেলায় কমবেশি নেমে পড়েন।

প্রদর্শনী ভাইরাস আর কীভাবে সমস্যা? প্রদর্শিত আচরণগুলো যে বিবেচনাবোধহীন, অসংবেদনশীল ও আত্মমর্যাদাবোধহীন এ ভাবনাটি একসময়ে নির্বাচক ও নির্বাচিত উভয়েই হারিয়ে ফেলে। এ রকম অবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণে প্রকৃত নির্বাচনও যদি হয়—নিম্নমানের ও নিম্নরুচির রাজনৈতিক নেতৃত্বই জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন। সামাজিক মনোবিজ্ঞানে পার্কিনসন্স ল অব ট্রিভিয়্যালিটি বা পার্কিনসনের মামুলিপনার নিয়ম বলে একটি অভিজ্ঞান আছে। জনগণ মামুলি ও ক্ষুদ্র বিষয় দেখতে থাকলে মামুলিপনা ও ক্ষুদ্রত্বকেই নিয়ম মানতে শুরু করে। তারা তখন আর গভীর সুচিন্তাবোধ ও দায়িত্ববোধের পরিচয় দিতে পারে না।

২০১৫ সালে দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার রাজনীতি ও মনোবিজ্ঞান বিভাগের একটি প্রতিবেদন ব্যাপক পঠিত ও আলোচিত হয়েছিল। সাড়া জাগানো শিরোনামটি ছিল জনগণ কেন বিচার-বিবেচনা-বিবেকবোধহীনদের নির্বাচিত করে? (হোয়াই ডু পিপল কিপ ইলেক্টিং ইডিয়টস?)। প্রতিবেদনে এই ধরনের রাজনীতিকদের জিতে আসাকে ডানিং-ক্রুগার ইফেক্ট বলা হয়েছে। ডানিং ও ক্রুগার নামের দুই মনোবিজ্ঞানীর নামে ইফেক্টটির নামকরণ। ডানিং ও ক্রুগারের গবেষণামতে—যাঁদের বিবেক-বিবেচনাবোধ ও লজ্জাশরমবোধ যত কম, তাঁরা তত আত্মবিশ্বাসী হয়। যাঁদের ধীশক্তি ও নীতিনৈতিকতাবোধ যত বেশি, তাঁরা তত কম আত্মবিশ্বাসী হবেন। লজ্জাশরমবোধহীনদের মাত্রাতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস দেখে জনগণ বিভ্রান্ত হয়। ভাবে, এঁরা এতটা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে যেহেতু নিজেদের গুণপনার প্রচার করছে, নিশ্চয়ই গুণবান-গুণবতীই হবেন।

বাংলাদেশেও এ রকম জনপ্রতিক্রিয়ার কারণে গত কয়েক বছরে সংক্রামক হয়ে ছড়িয়ে পড়া অভব্য প্রদর্শনী ভাইরাসটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নিয়মে পরিণত হয়ে যেতে পারে। কোনো সমালোচনা দিয়েই যেহেতু অভব্যতাটিতে রাশ টানা যাচ্ছে না, এ রকম পরিণতির আশঙ্কাই স্বাভাবিক। জন–অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ধারা যত দিন অনুপস্থিত থাকবে, জনগণের প্রতি জনপ্রতিনিধিদের নির্ভরশীলতা, দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি ও থাকবে না। সে ক্ষেত্রে প্রদর্শনী ভাইরাস থেকে মুক্তি মেলাও দুষ্কর। এ অবস্থায় একমাত্র উপায় প্রদর্শনী ভাইরাসটির বিরুদ্ধে সামাজিক মনোভাব নির্মাণ। শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সমাজচিন্তকও সিভিল সোসাইটির সদস্যরা বিষয়টিকে তুচ্ছ বিষয় ভেবে এড়িয়ে না গিয়ে গণতন্ত্রহীন রাজনীতির গভীর সমস্যা হিসেবে দেখুন এবং মুখ খুলুন। ঘৃণা জানান। প্রতিবাদ করুন। নয়তো আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির রাহুটি বৃহদাকারই হতে থাকবে।

হেলাল মহিউদ্দিন: হেলাল মহিউদ্দীন: অধ্যাপক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোশিওলজি; নর্থ সাউথ