'কারাগারের রোজনামচা'য় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং বর্তমান

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর আত্মজীবনী ‘কারাগারের রোজনামচা’য় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা, আইন, সেন্সরশিপ, গুজব, সাংবাদিক নির্যাতন, প্রেস বাজেয়াপ্ত করা প্রভৃতি প্রসঙ্গে যেসব উদ্বেগ ও উপলব্ধির কথা বর্ণনা করেছেন, আজকের বাংলাদেশকে নিশ্চয়ই সেই অবস্থার সঙ্গে তুলনা করতে চাই না। তারপরেও কতিপয় বিষয় আলোচনা করা বাঞ্ছনীয় বলে মনে হচ্ছে, কারণ আমরা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং দেশের সার্বিক অগ্রগতিতে বিশ্বাস করি। বঙ্গবন্ধুর সেই সময়কার চিন্তাচেতনা ‘কারাগারের রোজনামচা’য় যেভাবে বিধৃত হয়েছে, তা আজকে আমাদের সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে নতুন করে ভাবতে সুযোগ করে দিয়েছে।


১.
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপনের ক্ষণে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে তাঁর উপলব্ধির দিকে ফিরে তাকালে গণমাধ্যম নিয়ে এক গভীর উদ্বেগের চিত্র ফুটে উঠে। ১৯৬৬ সালের ৩০ জুন সাংবাদিক নির্যাতন প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু ‘কারাগারের রোজনামচা’য় লিখেছিলেন, ‘আজ ইত্তেফাক ও ইত্তেফাকের সম্পাদকের বিরুদ্ধে হামলা করা, কাল আবার অন্য কাগজ ও তার মালিকের ওপর হামলা করবে না, কে বলতে পারে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বলতে তো কিছুই নেই।’


গণতান্ত্রিক চর্চায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে গেলে দেশের সব ধরনের মানুষের গণতান্ত্রিক চর্চায় নিবেদিত হতে হবে। শুধু সরকারের সদিচ্ছাই যথেষ্ট না। তবে সরকার কিংবা প্রশাসন দেখেও না দেখার ভান করে থাকলে প্রকৃত অর্থে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও পেশাদারি—কোনোটাই প্রতিষ্ঠিত হবে না। সেই অর্থে যদি আমরা মূল্যায়ন করি তাহলে দেখব, গভীর রাতে সাংবাদিককে বাসা থেকে তুলে নিয়ে শারীরিক নির্যাতন, গুম, হত্যা থেমে নেই। করোনাভাইরাস সম্পর্কিত রিপোর্ট করতে গিয়েও সাংবাদিকেরা পুলিশ ও প্রভাবশালী লোকজনের হাতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। (দৈনিক প্রথম আলো, ২৮ এপ্রিল ২০২০) সাংবাদিকদের কখনো সামাজিকভাবে অপদস্থ করা হচ্ছে, কখনো আইনি হয়রানি করা হচ্ছে, কখনো আবার গণমাধ্যমে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ তৈরি করা হচ্ছে।


সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন বন্ধ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু ‘কারাগারের রোজনামচা’য় যেভাবে লিখে গিয়েছিলেন, এখনো তার সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায়। ‘আমাদের পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার তিনটা কাগজের বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিয়েছে। একটা সংবাদ, পূর্ব পাকিস্তানের কাগজ, আর দুইটা “নওয়াই ওয়াক্ত” ও “কোহিস্তান”—পশ্চিম পাকিস্তানের। প্রায় সকল কাগজকেই সরকার ছলেবলে কৌশলে নিজের সমর্থক করে নিয়েছে। যে দু'চারটা কাগজ এখনো নিরপেক্ষতা বজায় রেখে জনগণের দাবি দাওয়া তুলে ধরছে, তাদের শেষ করার পন্থা অবলম্বন করেছে সরকার।’ (পৃ.৬৬)
২.
দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা করতে গেলে একজন সাংবাদিককে কিংবা সম্পাদককে গেট কিপিং বা সেল্ফ সেন্সরশিপ করতে হয় এবং তার একটা পরিমিতিবোধ থাকতে হয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সেখানে তা না হয়ে রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্টতা হচ্ছে। যখন একটি গণমাধ্যম সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের মুখপত্র হিসেবে কাজ করে, তখন ওই গণমাধ্যমের সাংবাদিকেরা কখনই স্বাধীনভাবে সংবাদ পরিবেশন করতে পারে না। গণমাধ্যমের রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্টতা প্রসঙ্গে ‘কারাগারের রোজনামচা’য় লিখেছেন, ‘খবরের কাগজ এল। পাকিস্তান অবজারভার দেখে ভাবলাম বোধ হয় খবর একটু এরা ছাপে আজকাল। আমি নিজে অবজারভার সকল সময়ই পড়ি। একবার কয়েক দিনের জন্য রাগ হয়ে বন্ধ করেছিলাম বাইরে থাকতে। আবার নিলাম, কারণ যাহাই হউক না কেন পূর্ব বাংলার কাগজ। মর্নিং নিউজের মতো পশ্চিমা শিল্পপতিদের মুখপাত্র নয়। এবং সরকারের অন্ধ সমর্থকও নয়। আজাদ কাগজ সকল সময়ই কিছু কিছু সংবাদ বহন করে। মতের মিল না থাকতে পারে, সংবাদপত্র কেন সংবাদ দিবে না।’ (পৃ. ৬৬) এ কথা থেকে স্পষ্ট হয় যে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব থাকলে গণমাধ্যম তার গ্রহণযোগ্যতা হারায়। তা ছাড়া গণমাধ্যমের অন্যতম একটি দায়িত্ব হলো, যারা ক্ষমতায় নেই, যাদের কণ্ঠরোধ করা হয়েছে, তাদের বক্তব্যও সুষমভাবে গণমাধ্যমে জায়গা দেওয়া। রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্টতার কারণে ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতাহীন রাজনৈতিক দল-মতের সংবাদ সেন্সর করলে তা সাধারণ পাঠক কতটা গ্রহণ করবে?


৩.
গণমাধ্যম-আইন প্রসঙ্গে ‘কারাগারের রোজনামচা’য় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘খবরের কাগজ এসে গেল, দেখে আমি শিহরিয়া উঠলাম, এ দেশ থেকে গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথ চিরদিনের জন্য এরা ঊহ্য করে দিতে যাচ্ছে! জাতীয় পরিষদে, “সরকারী গোপন তথ্য আইন সংশোধনী বিল” আনা হয়েছে। কেউ সমালোচনামূলক যে কোনও কথা বলুন না-কেন মামলা দায়ের হবে।’ (পৃ. ৬১) ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার দেখলেও আমাদের এখন তেমনই শিহরিয়া উঠতে হয়। অবশ্য বলা হয়েছিল, এ আইনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে না। গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের এক বছরেই ৩৮ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এ আইনে মামলা হয়েছে। (দৈনিক মানবকণ্ঠ, ২০ এপ্রিল ২০২০) এখন বলা হচ্ছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা নেওয়ার আগে তদন্ত হয়ে থাকে। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলেই শুধু মামলা হয়। এ কথা আমাদের স্বস্তি দিলেও এ আইনে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা থেমে নেই। অতিসম্প্রতি ত্রাণের চাল চুরি নিয়ে রিপোর্ট করায় দুজন সম্পাদকের বিরুদ্ধে এ আইনে মামলা করা হয়। (বিডি নিউজ, ১৯ এপ্রিল ২০২০) জেল-জরিমানা-গ্রেপ্তারও থেমে নেই।


৪.
বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে গুজব ও অপপ্রচার গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পথে ভিন্ন এক সংকট তৈরি করেছে। সারা বিশ্বেই গুজব বা অপপ্রচার বন্ধের দোহাই দিয়ে মনিটরিংয়ের নামে গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। ভারতীয় সাংবাদিক প্রজ্ঞা তিওয়ারি ‘আল–জাজিরা’য় এক নিবন্ধে লিখেন, ‘ঐতিহাসিকভাবেই মহামারি, যুদ্ধ এবং দুর্ভিক্ষের মতো বিপর্যয় দেখা দিলে রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনেরা গণতান্ত্রিক অধিকার ও বাক্‌স্বাধীনতা দাবিয়ে রেখে ক্ষমতাচর্চার পরিধিকে সম্প্রসারিত করে। আর একবার এভাবে স্বাধীনতা হারালে, তা আর সহজে ফিরে পাওয়া যায় না।’ তাই এ ধরনের পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমকে সরকারি মনিটরিংয়ের ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। সরকারকেও বুঝতে হবে, তথ্যপ্রবাহ রোধ করে গুজব রোধ করা যায় না। বরং নির্ভরযোগ্য তথ্যের অবাধ প্রবাহের মাধ্যমেই গুজব প্রতিহত করতে হয়।


গুজব প্রসঙ্গে ১৯৬৬ সালের ১০ জুন ‘কারাগারের রোজনামচা’য় তৎকালীন একটি আন্দোলনের কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, সরকার এ আন্দোলনের কোনো সংবাদ পত্রিকায় ছাপাতে দেয়নি। ফলে জেলের কয়েদিদের মধ্যে একটি গুজব ছড়িয়ে যায় যে আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে হাজার লোকের ওপর মারা গেছে। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘সত্য খবর বন্ধ হলে অনেক আজগুবি খবর গ্রামে গ্রামে ছড়াইয়া পড়ে, এতে সরকারের অপকার ছাড়া উপকার হয় না।’ (পৃ. ৭৯) বর্তমান সময়ে ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায়ই গুজব ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। তথাকথিত কিছু অনলাইন গণমাধ্যমও গুজব ও অবান্তর সংবাদ ছড়িয়ে দেয়। এসব রুখতে মূলধারার গণমাধ্যমগুলোর সত্য ও বিশ্বাসযোগ্য খবরের প্রচার ও প্রসার বাড়ানোর বিকল্প নেই। কিন্তু কয়েক দিন আগেই এর উল্টো চিত্র দেখা গেল। গত ৫ মার্চ তথ্য মন্ত্রণালয় বেসরকারি টেলিভিশনে করোনাভাইরাস সম্পর্কিত গুজব ও অপপ্রচার পর্যবেক্ষণের জন্য একটি মনিটরিং সেল গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি করে। অবশ্য ব্যাপক সমালোচনার পর বিজ্ঞপ্তিটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।


৫.
আজ বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। দেশ মুক্ত হওয়ার প্রায় অর্ধশত বছর পরেও এই প্রশ্ন আমাদের তাড়া করে। দেশে সাংবাদিক নির্যাতন ও গুম-হত্যা—সবই চালু আছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে শুধু ঢালাও অভিযোগ করে সমাধান হবে না। গণমাধ্যমের সার্বিক পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় কয়েকটি বিষয় যেমন সাংবাদিকের পেশাদারিত্ব, বস্তুনিষ্ঠতা, সংবাদের আপেক্ষিকতা, সংবাদ-মূল্য, সাংবাদিকের মজুরি-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা ও গণমাধ্যমের অর্থনীতি ইত্যাদি বিবেচনায় রাখতে হবে। অপ্রিয় হলেও সত্য যে প্রেস বাজেয়াপ্ত করা, বিজ্ঞাপন প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা, জোরপূর্বক ফরমায়েশি লেখা ছাপাতে বাধ্য করা, সুনির্দিষ্ট বিষয়ে লিখতে না বলা, লেখক-আলোচক কে হতে পারবেন কে হতে পারবেন না, তা নির্ধারণ করে দেওয়া, গণমাধ্যমের মালিকপক্ষ ও বিজ্ঞাপনদাতাদের স্বার্থরক্ষায় সম্পাদকীয় নীতির পরিবর্তন করতে চাপ দেওয়াসহ নানা বাধায় গণমাধ্যমসমূহ গণতন্ত্রের চর্চা ভুলতে বাধ্য হবে, স্বাধীন চর্চা হ্রাস পাবে।
বর্তমানে গণমাধ্যমে যে অস্থিরতা ও চাকরি হারানোর অনিশ্চয়তা এদিকেও আমাদের পেশাজীবীদের প্রতি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। সর্বশেষ প্রকাশিত মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশ গত বছরের তুলনায় আরও এক ধাপ পিছিয়েছে। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের (আরএসএফ) তথ্য অনুযায়ী, ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫১। আমরা আশা করব, এ অবস্থার উত্তরণ ঘটিয়ে গণমাধ্যম আরও সুশোভিত ও বিকশিত হবে। প্রকৃত স্বাধীন গণমাধ্যম ও গণতান্ত্রিক চর্চা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যাশায় ফলপ্রসূ হবে।


ড. গোলাম রহমান: সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার ও অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
শরিফুল ইসলাম: প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।