মহানবীর মহানুভবতা রোজার কাজা ও কাফফারা

পবিত্র রমজান মাসের রোজা আল্লাহ তাআলার অনন্য নিয়ামতে পরিপূর্ণ। বান্দা তা সানন্দে পালন করে। কোনো কারণে সময়মতো রোজা রাখতে না পারলে তা কাজা আদায় করতে হয় এবং রোজা রেখে কোনো ওজর বা অসুবিধার কারণে ভেঙে ফেললে তা-ও পরে কাজা আদায় করতে হয়। কাজা হলো একটি রোজার পরিবর্তে একটি রোজা। কাজা রোজা যেকোনো সময় সুবিধামতো আদায় করা যায়, সব কাজা রোজা একত্রে আদায় করা জরুরি নয়।

রোজা রেখে ওজর ছাড়া কোনোরূপ ধোঁকায় বা তাড়নায় তা ভঙ্গ করলে এর জন্য কাজা ও কাফফারা উভয়ই আদায় করতে হয়। কাফফারা তিনভাবে আদায় করা যায়। একটি গোলাম আজাদ করা বা দাস মুক্ত করা; ধারাবাহিকভাবে ৬০টি রোজা পালন করা এবং ৬০ জন মিসকিনকে দুই বেলা ভালোভাবে তৃপ্তিসহকারে আহার করানো।

কাজা রোজা হলো একটি রোজার পরিবর্তে একটি রোজা আর কাফফারা হলো ৬০টি। এরূপ ওজর ছাড়া যে কয়টা রোজা রেখে ভাঙবে, ততটির প্রতিটির পরিবর্তে একটি করে কাজা এবং একই রমজান মাসের জন্য তার সঙ্গে যুক্ত হবে একটি কাফফারা। অর্থাৎ একটি রোজা যৌক্তিক কারণ ছাড়া ভাঙলে তার জন্য কাজা ও কাফফারা হবে ৬১টি রোজা, ২টি ভাঙলে হবে ৬২টি রোজা, ৩টি ভাঙলে হবে ৬৩টি রোজা। অনুরূপ ৩০টি ভাঙলে হবে ৯০টি রোজা।

রোজার কাফফারা ৬০টি রোজা একত্রে ধারাবাহিকতা রক্ষা করে আদায় করতে হয়। কারও যদি কাজা, কাফফারাসহ মোট ৬১ বা তার বেশি হয়, তবে কমপক্ষে ৬১টি রোজা একটানা আদায় করতে হবে। কাফফারার রোজার মধ্যে বিরতি হলে বা ভাঙলে আরেকটি কাফফারা ওয়াজিব হয়ে যাবে। অর্থাৎ ৬১টি রোজা পূর্ণ হওয়ার আগে বিরতি হলে পুনরায় নতুন করে ১ থেকে শুরু করে ৬১টি পূর্ণ করতে হবে। যে রোজাগুলো রাখা হলো তা নফল হিসেবে পরিগণিত হবে। কোনো গ্রহণযোগ্য ওজর বা আপদের কারণে ভাঙতে হলে তা ক্ষমার যোগ্য। নারীদের বিশেষ বিরতির সময় বাদ দিয়ে ধারাবাহিকভাবে আদায় করতে হবে।

শিশু নাবালেগ অবস্থায় রোজা রাখা ফরজ নয়, তবু তারা নিজেদের আগ্রহে ও বড়দের উৎসাহে রোজা রাখে। এ অবস্থায় তারা যদি রোজা রেখে কখনো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় যেকোনোভাবে রোজা ভেঙে ফেলে, তাহলে তাদের এই রোজার কাজা বা কাফফারা কোনোটিই প্রয়োজন হবে না। তারপরও যদি তারা বড়দের সঙ্গে কাজা রোজা রাখতে শুরু করে এবং তা আবার ভেঙে ফেলে, তারও কাজা লাগবে না। (আল হিদায়া)।

ফিদইয়া, সদকাতুল ফিতর ও কাফফারা তাদের দেওয়া যাবে, যাদের জাকাত তথা ফরজ ও ওয়াজিব সদকা প্রদান করা যায়। যথা ‘ফকির, মিসকিন, সদকা কর্মী, অনুরক্ত ব্যক্তি ও নওমুসলিম, ক্রীতদাস, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, আল্লাহর পথে জিহাদ ও বিপদগ্রস্ত বিদেশি মুসাফির।’ (সুরা ৯ তাওবাহ, আয়াত ৬০)।

মানবতার মহান বন্ধু মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) কাফফারা আদায়ের অসাধারণ এক সমাধান দিলেন। ‘একদা রমাদানে এক সাহাবি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে বলল, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.)! আমি নিজেকে ধ্বংস করে ফেলেছি, আমি রোজা পালন অবস্থায় স্ত্রী সহবাস করে ফেলেছি।’ রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে বললেন, ‘তুমি একজন দাসকে মুক্ত করে দাও।’ সে বলল, ‘এমন সক্ষমতা আমার নেই।’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তবে এর বদলে ২ মাস তথা ৬০ দিন রোজা রাখো।’ লোকটি বলল, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.)! এমন শারীরিক সক্ষমতা আমার নেই।’ তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তবে তুমি ৬০ জন মিসকিনকে খাওয়াবে।’ লোকটি বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! এ রকম আর্থিক সচ্ছলতা তো আমার নেই।’ তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে অপেক্ষা করতে বললেন। এর কিছুক্ষণের মধ্যে একজন সাহাবি রাসুল (সা.)-কে এক ঝুড়ি খেজুর হাদিয়া দিলেন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) ওই লোকটিকে ডেকে বললেন, ‘এগুলো নিয়ে গরিবদের মধ্যে সদকা করে দাও।’ লোকটি বলল, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.), অত্র এলাকায় আমার চেয়ে গরিব আর কে আছে?’ এ কথা শুনে রাসুলে করিম (সা.) স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি হাসলেন, যাতে তার দাঁত প্রকাশিত হলো। তিনি (সা.) বললেন, ‘আচ্ছা, তবে খেজুরগুলো তুমিই তোমার পরিবার নিয়ে খাও।’ সুবহানাল্লাহ! (বুখারি, হাদিস ১৩৩৭, মুসলিম, হাদিস ১১১১)।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
smusmangonee@gmail,com