জনাব ট্রাম্প, মানুষ বড় না ক্ষমতা বড়?

ট্রাম্প প্রশাসন পরিস্থিতি মেনে নিয়েছে কিন্তু এ পর্যন্ত মারা গেছে ৬৮ হাজারের বেশি মানুষ। ছবি: রয়টার্স
ট্রাম্প প্রশাসন পরিস্থিতি মেনে নিয়েছে কিন্তু এ পর্যন্ত মারা গেছে ৬৮ হাজারের বেশি মানুষ। ছবি: রয়টার্স

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন দম্ভ বোধকরি এতটা দুরবস্থায় পড়েনি। প্রায়ই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গণমাধ্যমের সামনে আসেন হতবিহ্বল এক চেহারা নিয়ে। নানা আশার বাণী শুনিয়ে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করেন। আর ওদিকে করোনায় মৃত মার্কিনদের মৃতদেহ ট্রাকে পচে গলে যাচ্ছে নিজ দেশেই। নিউইয়র্কে অর্ধশতাধিক মানুষের মৃতদেহ পড়েছিল ট্রাকে। দেহগুলো পুড়িয়ে ফেলার কথা ছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষের কেউ না আসায় একটি শেষকৃত্যকারী প্রতিষ্ঠানের ট্রাকে এবং ভবনের ভেতরে ইতস্তত পড়েছিল মৃতদেহগুলো। ইকুয়েডরে রাস্তাঘাট থেকে পচে যাওয়া মৃতদেহ উদ্ধারের সংবাদ পড়েছি। কিন্তু মার্কিনদের ক্ষেত্রে এমন ভাবনা মনে আসা ছিল কঠিন। কারণ যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, আমেরিকানদের জীবন অন্য সবার চেয়ে মূল্যবান। অবস্থা কতটা নাজুক হলে ট্রাকের ভেতর লাশ পড়ে থাকে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প এ অবস্থায় নিজেকে যুদ্ধকালীন প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছেন। এখানে শত্রু হচ্ছে করোনাভাইরাস। ইতিমধ্যেই যুদ্ধে মৃতের সংখ্যা ভিয়েতনামে নিহত মার্কিনদের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে। যেভাবে সংখ্যা বাড়ছে, তাতে কোরিয়া, ভিয়েতনাম, আফগান ও ইরাক যুদ্ধে নিহত মার্কিনদের সংখ্যাও ছাড়িয়ে যেতে পারে। এই যুদ্ধ ২৩০ মিলিয়ন আমেরিকানকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। অভিবাসন বন্ধ করে দিয়েছেন ট্রাম্প। বিভিন্ন দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ব্যবসা–বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়েছে। অদৃশ্য এই শত্রুর মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।

এখনো পৃথিবীর হেন কোনো রাষ্ট্র নেই যারা যুক্তরাষ্ট্রকে জ্ঞান, বিজ্ঞান ও সামরিক শক্তিকে এককভাবে টেক্কা দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বের সর্বাধুনিক গবেষণা কেন্দ্রগুলো অবস্থিত। দুনিয়ার মেধাবী গবেষকদের ব্রেইন ড্রেইন হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে মিশেছে। সম্পদ ও পরিকল্পনা অতীব উচ্চ মানের। কিন্তু করোনা মোকাবিলায় সব ম্লান হয়ে পড়েছে। চীন না হয় এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র। বলপ্রয়োগ করে , গুম করে, তথ্য চাপিয়ে রেখে পরিস্থিতিকে সামাল দিয়েছে। এই পথ অবলম্বন করেছে ইরান বা রাশিয়া। অপেক্ষাকৃত উদারপন্থী দেশ ইতালি, স্পেন ও ফ্রান্সও হাজার হাজার কফিন বহনের পর পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার পথে। জার্মানির সফলতার মডেল নিয়ে সর্বত্রই কথা হচ্ছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের রীতিমতো ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা।

যুক্তরাষ্ট্রের মূল সমস্যা হচ্ছে আসন্ন নির্বাচন। নির্বাচনের বছরে সরকারগুলো অনেক সতর্ক আচরণ করে। বেশ ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়। নির্বাচনের হিসাবনিকাশ মেলাতে গিয়ে অতিমাত্রায় সতর্ক আচরণ করেই ভ্রান্তির খপ্পরে পড়ে। হরহামেশা ভুল চাল প্রয়োগ করে। ট্রাম্প প্রশাসনও একই আচরণ করেছে। কুবলার রস তাঁর বই ‘ডেথ অ্যান্ড ডাইং’–এ দেখিয়েছেন, কোনো রোগের প্রাদুর্ভাব হলে মানুষ প্রথম এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে বা নাকচ করে দেয়। এরপর অন্যকে দোষারোপ করে। পরে পরিস্থিতি মোকাবিলার উদ্যোগ নিতে শুরু করে। কিন্তু বিলম্বিত বোধোদয় বিপর্যয় ঠেকাতে ব্যর্থ হয়। পরবর্তী ধাপে হতাশা ভর করে। সর্বশেষ ধাপে মহামারিকে শিকার করে নেওয়া হয়। সম্প্রতি অধ্যাপক স্লাভো জিজেক তাঁর ‘প্যানডেমিক’ বইয়ে রসের ধারণার প্রয়োগ করে করোনা নিয়ে রাষ্ট্রের আচরণ ব্যাখ্যা করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রও প্রথমে করোনায় সংক্রমিত হওয়ার শঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছে। জানুয়ারির শুরুর দিকে সম্ভাব্য মহামারি সম্পর্কে সিআইএ ১২ বার সতর্ক করে দিলেও ট্রাম্প প্রশাসন পাত্তা দেয়নি। পরিস্থিতি মোকাবিলায় মার্কিন প্রশাসন বরাবরই সর্বাত্মক প্রস্তুতির কথা জানিয়েছে। বরং তাদের হেয় করা হচ্ছে বলে গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন ট্রাম্প। এরপর তারা করোনার ভাইরাস চীন ইচ্ছা করেই ছড়িয়েছে বলে প্রচার শুরু করে। এমনকি ট্রাম্প এমন অভিযোগও করেছেন, তাঁকে নির্বাচনে হারিয়ে দিতেই চীন করোনা ষড়যন্ত্রের আয়োজন করেছেন। চীনবিরোধী মনোভাব গঠনের চেষ্টা করেছে। গড়িমসি কাটিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন যখন কাজ শুরু করে, ততক্ষণে লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়ে গিয়েছে। এখন ট্রাম্প প্রশাসন পরিস্থিতি মেনে নিয়েছে কিন্তু এ পর্যন্ত মারা গেছে ৬৮ হাজারের বেশি মানুষ।

যুক্তরাষ্ট্র পরিকল্পিত করোনা নির্ণয় পদ্ধতি তৈরি করে সারা দেশে প্রয়োগ করতে পারেনি। তাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থাও বেশ দুর্বল। যা সম্ভাব্য মহামারির মানচিত্র তৈরি করতে পারেনি। যে কারণে পূর্বপ্রস্তুতি হিসাবে মহামারিপ্রবণ এলাকায় লক ডাউন বা কোয়ারেন্টিন করে বিস্তার কমানো সম্ভব হয়নি। ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অদক্ষতার কারণে সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনকে (সিডিসি) দায়ী করেছে। এমনকি সিডিসির ল্যাবরেটরিগুলো পুরোপুরি জীবাণুমুক্ত করা হয়নি। সিডিসিকে সরকারি না হয়ে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হলে বন্ধ করে দেওয়া হতো বলে হুমকি দিয়েছিল এফডিএ।

এই প্রশাসনিক ব্যর্থতা আড়াল করতে ট্রাম্প অর্থনৈতিক ইস্যুকে সামনে এনে মনোযোগ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। যেকোনো মূল্যে ব্যবসা–বাণিজ্য পুনরায় চালু করতে চাইছেন। বিভিন্ন শহরে ট্রাম্পের সমর্থকেরা লকডাউনের বিপক্ষে মিছিল করেছে। শুরু থেকেই ট্রাম্পের সমর্থকেরা লকডাউন মেনে চলেননি বলে মার্কিন গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে। তাদের ভ্রমণ ও ব্যবসায়িক বৈঠকগুলো অপরিবর্তিত ছিল। এ ছাড়া ট্রাম্প গভর্নরদের লকডাউন তুলে নেওয়ার জন্য বলেছেন। ট্রাম্প অর্থনীতিকে সচল করার কথা বলে আরও বেশিসংখ্যক মানুষকে ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছেন। কারণ, ট্রাম্প অর্থনীতির স্থবিরতাকে কোনোভাবেই নির্বাচন পর্যন্ত টেনে নিতে চাইছেন না। কারণ এর দুই ধরনের প্রভাব পড়বে নির্বাচনী রাজনীতিতে। প্রথমত, দীর্ঘ সময় ধরে লকডাউন থাকলে নির্বাচন বাতিল হতে পারে বা নির্বাচন হলে অর্থনীতির মন্দাভাব ভোটারদের প্রভাবিত করবে। তাই ট্রাম্পের কাছে জীবন রক্ষার চেয়ে অর্থনীতিই মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকটা এ রকম যে শেষ পর্যন্ত যারা বেঁচে থাকবেন, তাদের ভোট যেন পাওয়া যায়। কার্যত ট্রাম্প করোনাকে এড়িয়ে যাওয়ার নীতি খুব বেশি পরিবর্তন করেননি এবং এটা শুরু থেকে ইচ্ছাকৃতভাবেই করেছেন।

এসব করে হয়তো ট্রাম্প ক্ষমতায় টিকে থাকবেন কিন্তু মার্কিনদের অবস্থান নড়বড়ে হয়ে যাবে। এখনই মার্কিনদের বৈশ্বিক আধিপত্য ধসে যাবে না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তারা ক্ষয়ে যাবে। এত মৃত্যুর ভার বহন করা অত্যন্ত কঠিন তাদের জন্য।

করোনার পাশাপাশি মার্কিনরা আরও এক ব্যাধিতে আক্রান্ত। এই ব্যাধি মানসিক এবং এর নাম ট্রাম্প সিনড্রোম বা সময়কে অস্বীকার করার প্রবণতা। ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে, শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, বিশ্বের অনেক দেশই ট্রাম্প সিনড্রোমে আক্রান্ত। এরা শুরুতে শিকারই করতে চায়নি যে করোনা তাদের দেশে প্রবেশ করতে পারে বা নিশ্চয়তা দিয়ে বলা হয় শতভাগ প্রস্তুতির কথা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল সবই বাকোয়াজি। পিপিই আছে তো মাস্ক নেই বা বৈজ্ঞানিক মাস্কের বক্সে সাধারণ মাস্ক পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব নাকচ করে দেওয়ার আচরণ রাষ্ট্র, জাতির জন্য বিপজ্জনক। কারণ বাস্তবতাকে অস্বীকার বা নাকচ করে কখনো টিকে থাকা যায় না। ফেলে আসা সময় এমনই সাক্ষী দেয়।

ড. মারুফ মল্লিক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক