দায়ী ধনী দেশগুলো, দায়িত্বও তাদের নিতে হবে

কানাডার উত্তর মেরু এবং সাইবেরিয়া ও অ্যান্টার্কটিকায় ছত্রাক গোত্রীয় এমন সব অণুজীবের সন্ধান মিলেছে, যেগুলো পার্মাফ্রস্টেও টিকে থাকতে পারে। পার্মাফ্রস্ট অবস্থাটি মইনাস ২৩ ডিগ্রি হতে মাইনাস ৬৮ ডিগ্রি পর্যন্ত। অণুজীবগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে এক্সট্রেমোফাইলস। সমুদ্রপৃষ্ঠের চার কিলোমিটার গভীরে লবণের ঘনত্ব সমুদ্রজলের স্বাভাবিক ঘনত্বের দশ গুণ বেশি। প্রাণের টিকে থাকার মতো অক্সিজেনও নেই। সিসিলের সমুদ্রতটের কাছে ব্রাইন লেকে এ রকম প্রতিকূল পরিবেশেও এক্সট্রেমোফাইলস মিলেছে। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে বরফ গলছে। দৃশ্যমান হয়ে উঠছে একাধিক ঐতিহাসিক দুর্যোগে বরফের নিচে চাপাপড়া প্রাণিজগতের ধ্বংসাবশেষ। সেগুলোতে ভর করে এক্সট্রেমোফাইলসদের বিস্তার ঘটার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।

গত বছরের মার্চের ২১ তারিখে বিবিসিতে সংবাদ হয়েছিল যে হিমালয় পর্বতেও বরফ গলছে। ফলে জায়গায় জায়গায় ভীতিকর সব দৃশ্য তৈরি হচ্ছে। বেরিয়ে আসছে মৃত মানুষের লাশ ও হাড়গোড়। গুয়াতেমালায় বছর কয়েক আগে উদ্ধার হয়েছে পাঁচ শ বছর আগের একটি ইনকা মমি। ‘দ্য মেইডেন’ নামে পরিচিত মমিটির ফুসফুসে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হয়েছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক, নৃবিজ্ঞানী ও রোগতত্ত্ববিদেরা এই আশায় একটি গবেষণা চালাচ্ছেন যে ১৯২০ সালের স্প্যানিশ ফ্লুতে কেন এক কোটির বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল, সেই রহস্যের সুরাহা মিলবে। ২০১৮ সালে সাইবেরিয়ার ফার্মাফ্রস্টে একটি মৃত পাখি মিলল। দেখে মনে হয় গতকালই মরেছে। কিন্তু পাখিটি আসলে মরেছে ৪৬ হাজার বছর আগে।

২০১৭ সালে বিবিসির সাংবাদিক জেসমিন ফক্স-স্কেলি একটি প্রতিবেদনে লিখেছিলেন যে হিমশৈলের নিচে চাপা পড়েছিল অসুখবিসুখ; এখন তারা জেগে উঠছে। শত শত বছর বরফচাপা অণুজীবগুলো বরফগলা উষ্ণতা পেয়ে বিধ্বংসী হয়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে লোকালয়ে। তিনি প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করলেন, ২০১৬ সালে সাইবেরিয়ান তুন্দ্রার ইয়ামাল উপদ্বীপে একটি ১২ বছরের কিশোরের এনথ্রাক্স সংক্রমণে মৃত্যু এবং ২০ জনের হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ার ঘটনা।

জেসমিন ফক্স-স্কেলির উদাহরণটি থেকে অনুমান করা মোটেই অসংগত নয় যে পার্মাফ্রস্টে চাপা পড়া অণুজীবগুলো আবারও হয়তো লোকালয়ে হামলে পড়বে। শুরু হবে প্রাণহরণের তাণ্ডব। করোনাও যে সে রকম একটি নমুনা অণুজীব নয়, সে কথা জোর দিয়ে বলার জো নেই। লক্ষণীয় যে উত্তর গোলার্ধের দেশগুলোই করোনায় বেশি আক্রান্ত। ইতালিতে অবস্থা এতটাই ভয়াবহ হয়ে পড়েছিল যে একসময় ঘোষণা করতে হয়েছিল ৮০ বছর এবং তার ওপরের বয়সীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হবে না। কম বয়সীদের জীবন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণে তারা সেবা পাবে। কারণ, সম্পদ সীমিত। ওষুধপাতি ও সেবা-অনুষঙ্গী সরঞ্জামের দারুণ অভাব। ধনী দেশগুলোরও পিছু হটার এ রকম দৃশ্য অতীতের চিকিৎসাসেবার ইতিহাসে বিরল।

দেশগুলোর পিছু হটার কারণ কী? নতুন করে ভাবতে হবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে। কারণ বিশ্ব উষ্ণায়ন ও পরিবেশদূষণের মূল দায় ধনী দেশগুলোর। বিশ্ব উষ্ণায়নে সম্মিলিতভাবে ধনী দেশগুলো ও ধনী হতে চলা দেশগুলোর দায় ৭২ শতাংশ। শুধু চীন ও যুক্তরাষ্ট্রেরই দায় ৪২ শতাংশ। চীনের পরই বিশ্ব পরিবেশদূষণে যুক্তরাষ্ট্রের স্থান। চীন ও যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শক্তিধর এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানে সেরা উৎকর্ষ সাধনকারী দুটি দেশ। তবুও করোনার তাণ্ডবের কাছে যুক্তরাষ্ট্র অসহায় হয়ে পড়েছে। চীন শুরুর দিন হতেই শক্ত হাতে মোকাবিলা না করে ট্রাম্পের মতো করে ভাবলে দেশটির দশাও হতো যুক্তরাষ্ট্রের মতোই। কানাডার মতো কল্যাণরাষ্ট্র প্রথম দিন থেকেই সর্বাত্মক প্রস্তুতি ও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পরও প্রতিদিনই সংক্রমণ ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে।

যুক্তরাষ্ট্র ২০১৭ সালের ১ জুন জলবায়ুবিষয়ক ‘প্যারিস চুক্তি’ (২০১৫) থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করার ঘোষণা দিয়েছে। বিশ্ব পরিবেশদূষণ এবং উষ্ণতা বৃদ্ধিকে ট্রাম্প প্রশাসন বাস্তব ঘটনা মনে করে না। উষ্ণতা রোধের সম্ভাব্য ক্ষতিতে যে তার দেশও ভুগবে, সে কথাটিও ট্রাম্প মানেন না। চুক্তির দিন থেকে তিন বছরের আগে কোনো দেশ একপক্ষীয় সিদ্ধান্তে নিজেকে প্রত্যাহার করার প্রক্রিয়াই শুরু করতে পারে না। সেই হিসাবে ২০১৯ সালের নভেম্বরের ৪ তারিখ ছিল প্যারিস চুক্তির তিন বছর পূর্ণতার দিন। ট্রাম্প প্রশাসন প্রক্রিয়াটি শুরু করলেও মার্কিন আইন অনুযায়ী এ বছরের যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পরদিনই শুধু সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে পারবেন।

বিশ্বায়ন মানুষের ভোগবাদিতাকে আকাশচুম্বী করেছে। টিভি, ফ্রিজ, মাইক্রোওয়েভের মতো টোটকা ঘরোয়া ভোগ্যপণ্য হতে শুরু করে বিশালাকৃতির শিল্প-সরঞ্জামগুলো পরিবেশকে দ্রুত উত্তপ্ত করে তুলছে। যানবাহন ছাড়াও ইট-সিমেন্ট-স্টিলের বহুতল এক্সপ্রেসওয়ে, ব্রিজ, স্কাইস্ক্র্যাপার বায়ুমণ্ডলের উত্তাপ বাড়াচ্ছে। ভোগবাদিতার সহজ চিহ্ন একব্যবহারি প্লাস্টিক। প্রশান্ত মহাসাগরে শুধু প্লাস্টিকজাত আবর্জনার বিস্তৃতি আমেরিকা মহাদেশের চেয়ে বেশি। পরিবেশবাদীরা একে বলছেন অষ্টম মহাদেশ। প্লাস্টিকেরও উৎপাদন ও ব্যবহারে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রই শীর্ষে।

বিশ্বের বেশির ভাগ ধনী দেশই শাসিত হচ্ছে উগ্র ডানপন্থী অথবা চরমপন্থী সরকারদের দ্বারা। তারা মনে করে, বিশ্বের উষ্ণায়ন আসলে কল্পকথা। তাদের অভিযোগ—বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ও পরিবেশবাদীরা বিজ্ঞানসম্মত গালগল্প বানিয়েছে। দুনিয়ার মানুষের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তারা মনে করে, মানুষ প্রযুক্তিতে এতটাই উন্নত হয়েছে যে এসব সমস্যা সমাধানে বেগ পেতে হবে না। চীন ও যুক্তরাষ্ট্র হয়তো একসময় ঠিকই বুঝবে। কিন্তু তত দিনে সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়তে পারে।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আবারো আলোচনায় উঠে আসবেন ম্যালথাস। যিনি বলেছিলেন সামাজিক জনমিতিক অর্থনীতির কথা। জনসংখ্যা বাড়ে। তারা প্রকৃতির ওপর, প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের আরও প্রবৃদ্ধি ও বিস্তার ঘটায়। প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর অত্যাচার যখন প্রকৃতি আর সইতে পারে না, তখনই রোগ, শোক, খরা, দুর্ভিক্ষ হয়ে প্রকৃতি নিজেকে ভারসাম্যে ফেরাবে। সেসব উদাহরণ আমরা নিত্যই দেখছি। করোনার গৃহবন্দিত্বকালে অপরূপ রূপে হাজির হচ্ছে প্রাণ ও প্রকৃতি। করোনার রোগ–পর্বের আগ্রাসনের পর তাহলে ম্যালথাসকে মনে না করেই বা উপায় কী?

প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন গ্যারেট হার্ডিনও। তাঁর বিখ্যাত ‘ট্র্যাজেডি অব দ্য কমন্স’ (সাধারণ্যের করুণতম পরিণতি) নামের দুই পৃষ্ঠার লেখা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি পঠিত হয়েছে। প্রকৃতির ধারণক্ষমতার (ক্যারিইং ক্যাপাসিটি) সীমাবদ্ধতা নিয়ে বলা তাঁর কথাগুলো ধনী দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি পঠিত হলেও সেসব দেশের সাম্প্রতিক সরকারগুলো তেমন আমলে নেয়নি। নিলে ভোগবাদ এতটা মারাত্মক রূপ নিত না। হার্ডিন দেখিয়েছিলেন—যে ঘাসের জমিতে মাত্র দশটি গরুর জন্য ঘাস আছে, সেখানে পনেরোটি গরু নামালে কী ধরনের বিপর্যয় হয়! যদিও মনে হয় সব কটি গরুই খেয়েছে, আসলেই কোনোটিই পেট পুরে খেতে পাবে না। যেহেতু সীমিত সম্পদ ভাগাভাগি করে খাবে, কোনো গরুই পর্যাপ্ত পুষ্টি পাবে না। ফলে সব কটিই দুর্বল হয়ে পড়বে। দুর্বলতা তাদের রোগপ্রতিরোধের শক্তি কমাবে। সে ক্ষেত্রে সব কটি গরুরই রোগাক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়বে। রোগ হলে এবং রোগটি দুষ্ট প্রকৃতির হলে সব কটি গরুই মরবে। অধিকসংখ্যক গরুর ঘাস খাওয়া মাঠের ধারণক্ষমতা অতিক্রম করবে। ঘাস উজাড় হবে। এ রকম উজাড়ীকরণের যে রকম ফল, মানবসমাজের মাত্রাতিরিক্ত ভোগবাদিতার ফলও সে রকমই। আধুনিক ভোগবাদও মানুষের দ্বারা প্রকৃতির সীমিত সম্পদে অতিরিক্ত ভাগ বসানোর ও উজাড়ীকরণের মতোই।

বিশ্ব উষ্ণায়ন মানুষের ভোগবাদিতার ফসল। গ্রেটা থুনবার্গের মতো কৈশোরপ্রাপ্ত বালিকা সত্যটি বুঝলেও ট্রাম্প অথবা চিন পিং আমলে নেন না। তাঁদের মতো রাজনীতিচিন্তার কুশীলবেরাও আমলে নেন না। ফল হাতে হাতে মিলছে। একসময়ের বিলুপ্তপ্রাপ্ত ম্যালেরিয়াও আবার স্বমূর্তিতে ফিরে আসছে আফ্রিকায়। জলবসন্তও ফের নতুন চেহারায় ফিরে আসার পথে। এরই মধ্যে গত দুই দশকে মানুষেরা পরিচিত হলো সার্স, মার্স, চিকুনগুনিয়া, বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু, জিকা ইত্যাদি নতুন নতুন অণুজীবের সংক্রমণ ও ভয়াবহতার সঙ্গে! করোনা যে গতিতে বিশ্বভ্রমণ করছে, সময়ই বলে দেবে শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধে মানুষ কতটা পেরে উঠবে। তবে বরফের নিচে ঘাপটি মেরে থাকা অণুজীবগুলো উষ্ণায়নের পিঠে চড়ে যাতে আগামী দিনের ঘাতক হয়ে উঠতে না পারে, সে জন্য সারা বিশ্বের ব্যাপক অগ্রিম প্রস্তুতি দরকার। ধনী দেশগুলোই যেহেতু এসব বিপর্যয়ের মূল ক্রীড়নক, তাই তাদেরই গুরুদায়িত্বটি পালন করতে হবে।

আমাদের প্রত্যাশা, ধনী দেশগুলো এই সত্যটিকেই আমলে নেবে যে করোনাই শেষ আঘাত নয়, আরও আঘাত আসন্ন। সে জন্য অর্থনীতিই শুধু নয়, মানবনীতি এবং টেকসই সুরক্ষানীতির প্রয়োজনকেই বেশি বেশি আমলে নিতে হবে। ধনী দেশগুলোকেই বেশির ভাগ দায়িত্ব নিতে হবে।

হেলাল মহিউদ্দীন: অধ্যাপক, পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোসিওলজি এবং গবেষক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি।