অর্থনীতি উদ্ধারে তিন পর্বের পরিকল্পনা চাই

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসের প্রভাবজনিত কারণে যে অর্থনৈতিক মন্দা, তা সমগ্র বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত। এটি শুধু বাংলাদেশের একার বিষয় নয় এবং একক কোনো খাতের সমস্যাও নয়। এ কারণে এই মহামারির অর্থনৈতিক ক্ষতি কেবল এই সময়ের নয়, এই ক্ষতি সুদূরপ্রসারী। এই কারণে করোনার অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবিলায় আগামী তিন বছরের জন্য পরিকল্পনা নেওয়া দরকার।

তিন ধাপে পরিকল্পনা নিতে হবে:
১. প্রতিরোধ পর্যায় (২০২০-এর জুন মাস থেকে শুরু করে ২০২১-এর জুন মাস পর্যন্ত)
২. উত্তরণ পর্যায় (২০২১-২২ অর্থবছর) এবং
৩. প্রগতি পর্যায় (২০২২-২৩ অর্থবছর)।

প্রতিরোধ পর্যায়ে করণীয়
এই সময়ের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, অর্থনৈতিক ক্ষতি যতটা সম্ভব কমানো, শিল্প-কলকারখানা ব্যবসা-বাণিজ্য বাঁচিয়ে রাখা এবং মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমিয়ে জীবন ও জীবিকার সংস্থান করা। এ কথা মানতে হবে যে যত দিন পর্যন্ত কোভিড-১৯ ভাইরাসের প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কৃত না হয়, অথবা কার্যকর কোনো ওষুধ সহজলভ্য না হয়, তত দিন পর্যন্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বা জীবনযাত্রা কোনো কিছুই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে না। সেটি কবে ঘটবে, তা সুনির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। কিন্তু মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে তাদের কর্মসংস্থান থাকতে হবে, জীবিকা থাকতে হবে। অনিশ্চিত অবস্থার মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখা যাবে না। এ কারণে প্রতিরোধের এই পর্যায়ে পরিকল্পনা মাফিক এগোতে হবে, যাতে স্বাস্থ্যঝুঁকি যথাসম্ভব কম রেখে ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু করা যায়। এ ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো নেওয়া যেতে পারে।

ক. ব্যাপকভাবে করোনা টেস্টের সুযোগ বাড়ানো দেশের বিভিন্ন এলাকায়,
খ. সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে করোনা-সংশ্লিষ্ট চিকিৎসাসুবিধা বাড়ানো। এ ক্ষেত্রে অক্সিজেন-সুবিধা চালু করা সবচেয়ে জরুরি। বিভিন্ন হাসপাতালে পর্যাপ্ত পিপিই, মাস্ক, অক্সিজেন-সুবিধা ব্যাপকভাবে বাড়াতে অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। যত বেশিসংখ্যক রোগীকে চিকিৎসা দেওয়ার সুযোগ থাকবে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড খুলে দেওয়ার স্বাস্থ্যঝুঁকি তত বেশি মোকাবিলা করা যাবে।
গ. বিভিন্ন কলকারখানা, অফিস-আদালতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানোর জন্য কর্মক্ষেত্রে কী ধরনের ব্যবস্থা থাকতে হবে, সে অনুযায়ী আলাদা দিকনির্দেশনা দিতে হবে। বিভিন্ন সেক্টরকে তাদের উপযোগী নিজস্ব কর্মপরিকল্পনা করতে হবে।
ঘ. হতদরিদ্র, দরিদ্র, নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য খাদ্য সহায়তা চালু রাখতে হবে এবং নগদ সহায়তা দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে যাতে অপচয় না হয়, সেই প্রচেষ্টা থাকতে হবে। ইতিমধ্যে সরকারের কাছে যেসব তালিকা আছে, সেগুলো ব্যবহার করে নগদ সহায়তা দিতে হবে ব্যাপকভাবে। যেমন, ২০১৯ সালে যে তাঁতশুমারি হয়েছে, তাতে দেশের তাঁতিদের তালিকা পরিসংখ্যান ব্যুরোর কাছে আছে। আবার সামাজিক নিরাপত্তা খাতের সুবিধাভোগীদের তালিকা তো আছেই। মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে এই টাকা ট্রান্সফার করা যায়। সে ক্ষেত্রে সুবিধাভোগীদের ন্যাশনাল আইডি অথবা বার্থ সার্টিফিকেট দিয়ে শনাক্ত করা যেতে পারে। কোনো ব্যক্তি অনলাইন বা মোবাইলে সাহায্যের জন্য আবেদন করার পর স্থানীয় প্রশাসন সে ব্যক্তির অবস্থা সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিতে পারবে। দেশের বিভিন্ন স্থানের এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের সুবিধাও এ ক্ষেত্রে কাজে লাগানো যেতে পারে। ১০০ দিনের কর্মসংস্থান কর্মসূচির মতো সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ দিতে হবে। সব কর্মসূচির আওতায় জরুরি সরবরাহ চেইন ঠিক রাখাসহ নানা রকম জরুরি স্বপ্রণোদিত (ভলান্টারি) কাজে কর্মসংস্থান তৈরির বরাদ্দ থাকতে হবে।
ঙ. কৃষিক্ষেত্রে স্বাস্থ্যঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম বলে কৃষি উৎপাদনের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে কৃষিপণ্যের সরবরাহ চেইন ঠিক রাখতে সবচেয়ে জোর দিতে হবে কৃষকদের কাছে উন্নত বীজ, সার, কীটনাশক ওষুধ ঠিক সময়ে পৌঁছানো এবং কৃষির চূড়ান্ত পণ্য বাজারজাতকরণে পরিবহনসুবিধা দেওয়ার ওপরে। চাল, ডাল, পেঁয়াজ ইত্যাদি কৃষিশস্যের পাশাপাশি মুরগি, ডিম, গবাদিপশু, ডেইরি প্রভৃতি পণ্যের সাপ্লাই চেইন ঠিক রাখতে হবে।
চ. বাংলাদেশ প্রায় ৯৮ ভাগ শিল্প ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান হলো কুটিরশিল্প এবং অতিক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান। গ্রামাঞ্চলের কুটিরশিল্পগুলোয় তুলনামূলকভাবে স্বাস্থ্যঝুঁকি কম। তাই কুটিরশিল্পের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সর্বপ্রথম শুরু করা যায়। সে জন্য এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে সহজে কাঁচামাল সরবরাহের সুবিধা এবং তাদের পণ্য বিপণনের জন্য নিরাপদ সাপ্লাই চেইন ও পরিবহন-সুবিধা দিতে হবে। তারপর ধীরে ধীরে অন্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলতে হবে। অতিক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের যেসব অনানুষ্ঠানিক উদ্যোক্তা সরকার ঘোষিত প্রণোদনা থেকে ব্যাংকের মাধ্যমে প্রণোদনা নিতে পারবে না, সেসব অতিক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান জন্য একটা তহবিল রাখতে হবে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য যেমন ১০০ কোটি টাকার তহবিল দেওয়া হয়েছিল, সেভাবে অতিক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানের জন্য অন্তত ১০০০ কোটি টাকার একটি তহবিল রাখা, যেখান থেকে বিভিন্ন ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঋণ নেওয়া সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশন, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক, আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প ইত্যাদির সহায়তা নেওয়া যেতে পারে।
রপ্তানিনির্ভর শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর চালু থাকা নির্ভর করবে বিদেশের বাজারে আমাদের পণ্যের চাহিদা কতটুকু, তার ওপরে। আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ও ক্রেতারা যেন আমাদের পণ্যের অর্ডার বাতিল না করেন এবং অর্ডারকৃত পণ্যের মূল্য ঠিকমতো পরিশোধ করেন, সেই ব্যাপারে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। তৈরি পোশাক খাতের ক্ষেত্রে এটি বিশেষভাবে প্রযোজ্য।

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

ছ. কোনোভাবেই যেন কেউ মাস্ক ছাড়া চলাচল না করে, সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ কঠোরতা থাকতে হবে, গণপরিবহনের সংখ্যা বাড়াতে হবে। অফিস-আদালত সপ্তাহে চার দিন করা যেতে পারে। এক দিন বাড়িতে বসে অফিসের কাজ করা হবে।
জ. এই পর্যায়ে দেশের জনগণকে ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ করতে হবে তারা যেন সম্ভাব্য সব ক্ষেত্রে দেশীয় পণ্য ব্যবহার করেন। সরকারের বিভিন্ন ক্রয়ের ক্ষেত্রেও যেমন, আসবাব, স্টেশনারি, খাদ্যসামগ্রী ইত্যাদিতে দেশীয় পণ্য ক্রয় করতে হবে।
ঝ. সরকার ঘোষিত বিভিন্ন প্রণোদনা স্বল্পতম সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে। বিভিন্ন ছোট ও মাঝারি শিল্পকে মনিটরিংয়ে রাখতে হবে, যেন তারা খেলাপি না হয়ে যায়। মনে রাখতে হবে, বিভিন্ন শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের জন্য ঘোষিত প্রণোদনা, এমনকি কৃষিতে ঘোষিত প্রণোদনা ঠিকভাবে কাজে লাগবে, যদি পণ্য উৎপাদন করে তা বিক্রি করা যায়। কাজেই পণ্যের কাঁচামাল ও চূড়ান্ত পণ্যের সাপ্লাই চেইন ঠিক না করলে প্রণোদনার অর্থ নিয়ে অনেকের ঋণখেলাপি হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের জন্য সরকার ঘোষিত ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার ৫ শতাংশ যেহেতু নারীদের জন্য বরাদ্দ অর্থাৎ এই ১০০০ কোটি টাকা নারীরা যেন সহজে পেতে পারেন, সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। একাধিক গ্যারান্টর এবং নানা কাগজপত্রের জন্য নারীদের অহেতুক চাপ দেওয়া যাবে না।
ঞ. অনলাইন কেনাকাটা ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করতে হবে এবং এ-সংক্রান্ত বড় প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলছে যেসব প্রতিষ্ঠান, তাদের সর্বাত্মক সহায়তা দিতে হবে।
ট. সরকারের বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প অব্যাহত রাখতে হবে, যাতে সেখানে মানুষের কর্মসংস্থান হয়। গ্রামাঞ্চলের রাস্তাঘাটের উন্নয়নসহ অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পগুলো রাখতে হবে, তবে এসব ক্ষেত্রে কর্মীরা যেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে অংশ নেয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। নানা রকমের ট্রেনিং, বিদেশ ভ্রমণ, সেমিনার আয়োজন ইত্যাদিতে বরাদ্দ কম রাখতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে যেহেতু তেলের মূল্য একেবারেই কম, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের নিকট বিভিন্ন সরকারি ব্যাংকের যে পাওনা আছে, সেগুলো পরিশোধের আংশিক হলেও উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে সরকারের পাবলিক-ডেবট-জিডিপি রেশিও (public debt GDP ratio) কমে। তা ছাড়া পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের নিকট থেকে অর্থ ফেরত পাওয়া গেলে সেই অর্থ অন্য কাজে লাগানো যাবে।
ঠ. ইন্টারনেটের মাধ্যমে পড়াশোনা, অফিসের বিভিন্ন মিটিং করা, অনলাইনের কেনাকাটা এসব বিবেচনায় ইন্টারনেটের ওপর থেকে ভ্যাট ট্যাক্স কমিয়ে দিতে হবে এবং এতৎসংক্রান্ত পণ্যের ওপর ট্যাক্স কমাতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে স্মার্টফোন থাকাটা সবার জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে খুব সস্তায় স্মার্টফোন সুলভ করার ক্ষেত্রে ট্যাক্স সুবিধা দিতে হবে।
ড. সার্বিকভাবে বিপুলসংখ্যক জনগণের দায়িত্ব নিতে সরকারের পাশাপাশি বিত্তশালীদের এগিয়ে আসতে হবে। খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০১৬ অনুযায়ী এ দেশের ৫০ শতাংশ বা অর্ধেক জনসংখ্যার সম্মিলিত আয় জাতীয় আয়ের ১৯ দশমিক ২৪ শতাংশ। অন্যদিকে দেশের বিত্তবান ৫ শতাংশের আয় মোট জাতীয় আয়ের ২৭ দশমিক ৮৯ ভাগ। অর্থাৎ জাতীয় আয়ে দেশের ৮ কোটি মানুষের অংশের চেয়েও বিত্তবান সাড়ে ৮২ লাখ মানুষের অংশ বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে নানা আলোচনা-পর্যালোচনা তেই বাংলাদেশের এই আয়বৈষম্যের চিত্র উঠে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ওয়েল্থ এক্স (Wealth-X) এর ২০১৯ সালের ওয়ার্ল্ড আলট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশের অতিধনীদের সংখ্যা দ্রুতগতিতে বেড়েছে। ধনীদের সংখ্যা বাড়ার হারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান পৃথিবীতে তৃতীয় বলে ওই রিপোর্ট উল্লেখ করেছিল। আমাদের অর্থনীতির সংকটে এই বিত্তশালীদের অংশগ্রহণ দরকার। দেশের মোট ৮৭ হাজার ২২৩ টি গ্রামের দরিদ্র ব্যক্তিদের পাশে সরকারের সঙ্গে সঙ্গে দেশের সর্বোচ্চ আয়সম্পন্ন পাঁচ ভাগ মানুষ অর্থাৎ বিত্তবান ৮২ লাখ ৫৫ হাজার ব্যক্তি যদি এগিয়ে আসেন, তাহলে এ দেশে কোনো মানুষ না খেয়ে থাকবে না।


২. উত্তরণ পর্যায়ে করণীয়
এই উত্তরণ পর্যায় শুরু হবে তখন, যখন ভাইরাসের প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কার হয়ে যাবে, অথবা কার্যকর ওষুধ পাওয়া যাবে। আশা করা যায় জুলাই ২০২১ থেকে উত্তরণ পর্যায় শুরু করা যাবে। তবে যদি প্রতিষেধক, ওষুধ কোনোটাই তত দিনে বাজারে না আসে, তাহলে প্রতিরোধপর্বই চলতে থাকবে। উত্তরণ পর্যায় শুরু হলে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে।
১. উত্তরণ পর্যায় শুরু হলে প্রথম কাজ হবে করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক যেন সবাইকে দেওয়া যায়, সেই অর্থের সংস্থান করা।
২. সরকারের প্রণোদনা যেসব প্রতিষ্ঠান নিয়েছে তাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা। নতুন উদ্যোক্তা ও ব্যবসাকে উৎসাহিত করা। বিভিন্ন শিল্পে কর্মরতদের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য উপযোগী প্রশিক্ষণ কর্মসূচি উৎসাহিত করা। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তারা যেন ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ পেতে পারে, সে জন্য গ্যারান্টরসহ বিভিন্ন কাগজপত্রের ব্যাপারে নিয়মকানুন সহজ করা এবং নারী উদ্যোক্তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যবসার ঋণ প্রাপ্তিতে গুরুত্ব দেওয়া।
৩. কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য সরবরাহের গুরুত্ব অব্যাহত রাখতে হবে। এই পর্বে স্বল্পমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী বিক্রির ব্যবস্থা সারা দেশে চালু রাখতে হবে। নানা রকম কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রির সুযোগ বাড়তে পারে, সেই সুযোগটা নিতে হবে।
৪. বাংলাদেশের পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো।
৫. এই পর্বে সাপ্তাহিক অফিস ৬ দিন করা যেতে পারে।
৬. স্বাস্থ্য খাতে নানা রকম কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের জন্য করপোরেটগুলোকে উৎসাহিত করা।
৭. উত্তরণ পর্যায়েও দেশীয় পণ্য ব্যবহারকে উৎসাহিত করতে হবে। এমনকি দেশের ধনীরা তাদের ছুটিতে যেন জন্য বিদেশে না গিয়ে দেশীয় বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্রে গমন করেন, তাতে উৎসাহ দিতে হবে।
৯. সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোসহ অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়নে গতি সঞ্চার করতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে অনানুষ্ঠানিক কর্মসূচির নানা প্রকল্প চালু রাখতে হবে।


৩. প্রগতি পর্যায়ে করণীয়
প্রগতি পর্যায়ে অর্থনীতিকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এই পর্বে মূল করণীয়গুলো নিম্নরূপ।
১. এই পর্বের প্রধান মনোযোগ হবে মেগা প্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন।
২. দক্ষ জনশক্তির জন্য প্রশিক্ষণ বাড়ানো।
৩. অনলাইন প্রযুক্তি এবং মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের ব্যবহার বাড়ানোর মাধ্যমে বাজার ব্যবস্থার সম্প্রসারণ করা, যাতে গ্রামের উৎপাদিত পণ্য শহরের বাজারে বিক্রয় হতে পারে।
৪. স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা। এসব খাতের অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে বিনিয়োগ করা। বিভিন্ন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য উপকরণ সুলভ করতে হবে।
৫. বিভিন্ন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি অর্জনে লক্ষ্যমাত্রায় যেন পিছিয়ে না পড়ি, সে জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সহযোগিতা প্রাপ্তির চেষ্টা করা।
৬. রপ্তানির জন্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রপ্তানির ব্যাপারে উদ্যোক্তাদের প্রতি প্রয়োজনীয় সহযোগিতা বাড়াতে হবে। ওষুধ শিল্পের রপ্তানির পরিমাণ বাড়ানোর ব্যাপারেও পদক্ষেপ নিতে হবে।
৭. নানা ধরনের কারিগরি উন্নয়নকে উৎসাহিত করতে হবে। কৃষি, শিল্প, বিভিন্ন সম্ভাব্য ক্ষেত্রে দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কম খরচে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। যেমন ধান কাটা মাড়াই এসব ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন খাদ্যশস্যের অপচয় রোধে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।
বিভিন্ন পর্যায়ে উদ্ভূত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নানা ধরনের কর্মসূচি নিতে হবে। সব পর্যায়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে থাকতে হবে। নারী ও শিশু নির্যাতন, শিশু শ্রম প্রভৃতির বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে। সর্বোপরি দেশের সীমিত সম্পদ সুষ্ঠুভাবে ব্যবহারের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিতে হবে। সব পর্যায়ে দেশি পণ্য ব্যবহারের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে এবং একটি মানবিক সমাজ গড়ে তোলায় মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।


ড. নাজনীন আহমেদ: সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)