স্বাস্থ্যসচেতনতায় রমজান

ইবাদতের জন্য শারীরিক শক্তি-সামর্থ্য প্রয়োজন। তাই প্রয়োজনমতো হালাল খাদ্য গ্রহণ করতে হয়। ভারসাম্যপূর্ণ পুষ্টিকর খাবারের বিষয়টিও লক্ষ রাখতে হয়। ইফতার ও সাহ্‌রির সুন্নাত পালন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রতি যত্নবান থাকতে হবে, যাতে ইবাদতের অসুবিধা না হয়। রাতে তারাবিহর পর হালকা ঘুম উপকারী। এতে তাহাজ্জুদ যথার্থ হয় এবং সাহ্‌রি গ্রহণে সুবিধা হয়। ঘুমের জন্য সাহ্‌রি যেন ছুটে না যায়, প্রয়োজনে দিনেও হালকা ঘুম বা বিশ্রাম নেওয়া যেতে পারে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমার ওপর তোমার শরীরের হক রয়েছে, তোমার চোখের হক রয়েছে, তোমার ওপর তোমার স্ত্রীর হক রয়েছে।’ (বুখারি, খণ্ড: ৩, পৃষ্ঠা: ২৭৫-২৭৬, হাদিস: ১,৮৫১)। 

ইবাদতের অনুকূল হালাল বৈধ উপার্জনের পোশাক ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ সুন্নতি আরামদায়ক লেবাস পোশাকের প্রতি মনোযোগী হতে হবে। যাঁদের নিয়মিত বিভিন্ন ওষুধ সেবন করতে হয়, তাঁরা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ গ্রহণের সময়সূচি নির্ধারণ করে নেবেন। যাঁদের শারীরিক ব্যায়াম বা হাঁটাহাঁটি করতে হয়, তাঁদেরও সেই উপযুক্ত সময় নির্দিষ্ট করে নিতে হবে। যাঁদের শরীর বেশি ভারী, তাঁরা অতিরিক্ত ওজন কমানোর জন্য রমজানের এই সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন। নিয়মিত ও পরিমিত আহার সুস্বাস্থ্যের নিয়ামক। 

অনেকে অসাবধানতা ও উদাসীনতার কারণে সাহ্‌রি না খেয়েই রোজা পালন করেন, এটা উচিত নয়। কারণ, এতে একদিকে যেমন সাহ্‌রির সুন্নাতের সওয়াব ও বরকত থেকে বঞ্চিত হতে হয়, অপরদিকে এটি স্বাস্থ্যহানিকর এবং কর্তব্যকর্ম আমল ও ইবাদত সম্পাদনে অন্তরায় হতে পারে। অনুরূপ কেউ কেউ যথাসময়ে ইফতার গ্রহণেও অলসতা করেন। এতেও ইফতারের সুন্নাতের সওয়াব না পাওয়া এবং ইবাদতে বিঘ্ন ঘটা ও অসুস্থতার কারণ ঘটতে পারে। 

সাহ্‌রিতে এমন খাবার গ্রহণ করা উচিত, যাতে রোজা পালন সহজ হয় এবং ইবাদতের অসুবিধা না ঘটে। ইফতারিতেও এমন খাবার গ্রহণ করা উচিত, যাতে স্বাস্থ্যও রক্ষা হয় এবং রাতে তারাবিহর নামাজ, তাহাজ্জুদ নামাজ ও অন্যান্য ইবাদতের সহায়ক হয়। একসঙ্গে বেশি পরিমাণে খাবার গ্রহণ না করে রাতে বারবার অল্প অল্প পরিমাণে খাওয়া যেতে পারে। ইফতারের পর থেকে সাহ্‌রি পর্যন্ত পানি ও তরল খাবার বেশি পরিমাণে গ্রহণ করা উচিত। 

রোজা অবস্থায় দিনের বেলায় জরুরি প্রয়োজনে ইনজেকশন ও ইনসুলিন নেওয়া যাবে। এতে রোজার ক্ষতি হবে না। কারণ, এতে খাদ্য গ্রহণের যে উদ্দেশ্য ক্ষুধা নিবারণ ও শক্তি অর্জন, তা হয় না। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, নবীজি (সা.) রোজা অবস্থায় শিঙা লাগিয়েছেন। (বুখারি, খণ্ড: ৩, পৃষ্ঠা: ২৬০, হাদিস: ১,৮১৫)। 

তবে এমন কোনো ইনজেকশন নেওয়া যাবে না, যা দ্বারা খাদ্য গ্রহণের প্রধান দুটি উদ্দেশ্য ক্ষুধা নিবারণ ও শক্তি অর্জন হয়; বরং এমন অসুস্থ অবস্থায় রোজা ছেড়ে দেওয়ারও অনুমতি রয়েছে। যা পরে কাজা আদায় করতে পারবে। (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৮৪)। রোজা অবস্থায় প্রয়োজনে রক্ত দেওয়া এবং নেওয়া যাবে; তবে লক্ষ রাখতে হবে এতে যেন রোজাদারের রোজা ভঙ্গের উপক্রম না হয়। অনুরূপভাবে রক্ত পরীক্ষার জন্য রক্ত নিলেও রোজা ভঙ্গ হবে না। (আল ফিকহুল ইসলামি ওয়া আদিল্লাতুহু)। 

রোজা অবস্থায় বমি হলে রোজা ভাঙবে না। তা খাদ্যবমি হোক বা রক্তবমি। বমির পরিমাণ বেশি হোক বা কম হোক। কারণ, রোজা হলো পানাহার না করার নাম। কারণ, বমি হলে পানাহার করা হয় না, বরং তার বিপরীত হয়। বমি হওয়ার পর রোজা পালনে সক্ষম হলে তা পূর্ণ করবেন, অক্ষম হলে রোজা ছেড়েও দিতে পারবেন। এই রোজা পরে কাজা আদায় করতে হবে। এর জন্য কাফফারা প্রয়োজন হবে না। বমি মুখে আসার পর তা গিলে ফেললে রোজা ভঙ্গ হবে। ইচ্ছাকৃত বমি করলে রোজা ভঙ্গ হবে। এ অবস্থায় কাজা ও কাফফারা উভয় আদায় করতে হবে। অনুরূপভাবে কোনো কারণে অজ্ঞান হলে (যাতে সাধারণত রোজার বিপরীত কিছু ঘটে না) রোজা ভঙ্গ হবে না। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া)। 

রোজা অবস্থায় হাত-পায়ের নখ কাটলে, চুল কাটলে বা কাটালে এবং ক্ষৌরকর্ম করলে বা করালে রোজার ক্ষতি হবে না। এর সঙ্গে রোজা ভঙ্গের কোনো সম্পর্ক নেই। রোজা নষ্ট হয় মূলত পানাহার ও রতিক্রিয়া দ্বারা। তাই রমজানে রোজা অবস্থায় দিনের বেলায় হাত-পায়ের নখ কাটা, চুল কামানো বা কাটা বা অবাঞ্ছিত পশম ছাঁটা বা ওপড়ানো জায়েজ; এতে রোজার কোনো ক্ষতি হবে না। তবে ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নাতের খেলাপ কোনো কাজ সব সময় নিষেধ। বরং তা রমজানের ইবাদতের মাসে আরও বেশি ক্ষতির কারণ। (ফাতাওয়ায়ে শামী)। 

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
[email protected]