সদকাতুল ফিতর সমাজকল্যাণমূলক ইবাদত

ইসলামের যাবতীয় বিধান মানবতার কল্যাণে নিবেদিত। সমাজের দুস্থ, অসহায় ও হতদরিদ্ররাও যেন রমজান শেষে ঈদের আনন্দে শামিল হতে পারে, এ জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ফিতরা বা সদকাতুল ফিতর নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যা ঈদের নামাজের আগে প্রদান করতে হয়। একে জাকাতুল ফিতরও বলা হয়। ঈদের দিন সকালে যিনি নিসাব পরিমাণ সম্পদের (সাড়ে সাত ভরি সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা বা সমমূল্যের ব্যবসাপণ্যের) মালিক থাকবেন, তাঁর নিজের ও পরিবারের ছোট-বড় সবার পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করা তার প্রতি ওয়াজিব।

নিসাব রুপার হিসাবে বর্তমান বাজারমূল্যে এটি ৫০ হাজার টাকা প্রায়। যাঁরা নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক নন, তাঁদের জন্যও ফিতরা আদায় করা সুন্নাত ও নফল ইবাদত। একে অন্যের ফিতরা আদায় করতে পারবেন। সুবিধার জন্য রমজানেও ফিতরা আদায় করা যায়। যাঁদের জাকাত দেওয়া যায়, ফিতরাও তাঁদের দেওয়া যায়।

ফিতরা নির্ধারিত খাদ্যসামগ্রী বা তার মূল্যে টাকায়ও আদায় করা যায় এবং অন্য কোনো বস্তু কিনেও দেওয়া যায়। পিতা-মাতা ও ঊর্ধ্বতন এবং ছেলেমেয়ে ও অধস্তন এবং যাঁর ভরণপোষণের দায়িত্ব রয়েছে (যেমন স্ত্রী), তাঁদের ওয়াজিব ফিতরা ও জাকাত প্রদান করা যায় না।

মুজতাহিদ ফকিহগণের মতে, যেখানে যা প্রধান খাদ্য তা দ্বারা আদায় করা শ্রেয়। মুজতাহিদ ইমামগণের মতে, যেসব খাদ্যবস্তু সহজে সংরক্ষণযোগ্য, সহজে বিনিময়যোগ্য ও বাজারমূল্য স্থিতিশীল থাকে; সেসব খাদ্যদ্রব্য দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করা যায়।

বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণনা করেন, নবী (সা.)-এর জমানায় আমরা সদকাতুল ফিতর দিতাম এক সা (সাড়ে তিন কেজি প্রায়) খাদ্যবস্তু। তিনি বলেন, তখন আমাদের খাদ্য ছিল যব, কিশমিশ, পনির ও খেজুর। (বুখারি, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা: ২০৪)।

তিনি আরও বলেন, আমরা সদকাতুল ফিতর আদায় করতাম এক সা খাদ্যবস্তু, যেমন এক সা যব, এক সা খেজুর, এক সা পনির, এক সা কিশমিশ। (বুখারি, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা: ২০৫)। রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন আমাদের মাঝে ছিলেন, তখন আমরা ছোট-বড়, মুক্ত ক্রীতদাস সবার পক্ষ থেকে সদকাতুল ফিতর আদায় করতাম এক সা খাদ্য অর্থাৎ এক সা পনির বা এক সা যব বা এক সা খেজুর অথবা এক সা কিশমিশ। আমরা এভাবেই আদায় করতে ছিলাম।

একবার হজরত মুআবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান (রা.) হজ বা ওমরাহ্‌ উপলক্ষে মদিনায় এলেন। তিনি জনগণের উদ্দেশে মিম্বরে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিলেন। তখন তিনি আলোচনা করলেন সে বিষয় যে (ফিতরা) বিষয়ে মানুষ প্রশ্ন করেছে। তিনি বললেন, আমি দেখছি শামের দুই মুদ (নিসফ সা বা পৌনে দুই কেজি) আটা সমান হয় (মূল্যমান হিসাবে) এক সা (সাড়ে তিন কেজি) খেজুরের। অতঃপর মানুষ (সাহাবায়ে কিরাম ও তাবিয়ীগণ) এই মত গ্রহণ করলেন। (মুসলিম, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা: ৩১৭-৩১৮)।

হাসান বসরি (র.) বর্ণনা করেন, আলী (রা.) বললেন, ‘আল্লাহ যখন তোমাদের প্রাচুর্য দিয়েছেন, তোমরাও উদার হও, গমও এক সা দাও।’ (নাসায়ি, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা: ২৬৮-২৭০)।

হজরত ইমাম আযম আবু হানিফা (র.)–এর মতে, অধিক মূল্যের দ্রব্য দ্বারা ফিতরা আদায় করা উত্তম; অর্থাৎ যা দ্বারা আদায় করলে গরিবদের বেশি উপকার হয়, সেটাই উত্তম ফিতরা। অন্য ইমামগণের মতও অনুরূপ। এ ছাড়া সদকার ক্ষেত্রে ফকিহগণের ঐকমত্য হলো, ‘যা গরিবদের জন্য বেশি উপকারী।’(আল মুগনি, খণ্ড: ৪, পৃষ্ঠা: ২১৯; আওজাযুল মাসালিক শরহে মুআত্তা মালিক, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা: ১২৮)।

বিভিন্ন দামের খাদ্যবস্তুর মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যের খেজুর বা উন্নত মানের চাল অথবা তৎমূল্যে আদায় করা উত্তম। ধনীরা সর্বোচ্চ এবং সাধারণেরা মাঝামাঝি মূল্যে আদায় করাই শ্রেয়। ইনসাফ হলো, যাঁরা যে চালের ভাত খান বা যাঁরা যে খেজুর দ্বারা ইফতার করেন, তাঁরা সে সমমানের বা সমমূল্যে ফিতরা আদায় করবেন।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তাই উত্তম দাতার নিকট যা সর্বোৎকৃষ্ট এবং যার মূল্যমান সবচেয়ে বেশি।’(বুখারি, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা: ১৮৮)।

বর্তমানে ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বেফাকুল মাদরিস ও হাইআতুল উলইয়াসহ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ২০১০ সাল থেকে এ নিয়মই অনুসরণ করছে।        

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
[email protected]