পরিত্রাণে এই ক্ষতি মেনে নিতে হবে

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

বর্তমান করোনাভাইরাস সংক্রমণের মোকাবিলায় দুনিয়াজুড়ে চলছে প্রাণিকুলের টিকে থাকার লড়াই। মানুষ ছাড়াও এই ভাইরাসের উপস্থিতি ইতিমধ্যে পাওয়া গেছে বাঘ ও পোষা বিড়ালের দেহে। ফলে সামনে আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে, আমরা জানি না। ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী আক্রান্ত হয়েছে ৩৯ লাখের বেশি মানুষ, মারা গেছেন ২ লাখ ৭০ হাজারের বেশি। এমন দুর্বিপাকের কালে এর মোকাবিলায় চিকিৎসাবিজ্ঞানের সব মহলে চলছে নিরন্তর প্রচেষ্টা, দেশগুলো হিমশিম খাচ্ছে তাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা যথাযথ টিকিয়ে রাখতে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই তাদের জনগণ সে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার এমন রূপ দেখে ভড়কে গেছে। সেখানে মৃত্যুর সংখ্যা এখন পর্যন্ত অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক বেশি, ফেব্রুয়ারির ২৯ থেকে শুরু হয়ে ৫ মে তারিখে এসে এই দুই মাসের সামান্য বেশি সময়ে সে দেশে মৃত্যুর সংখ্যা ৭৬ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আর শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, এই মরণঘাতী ব্যাধি থাবা দিয়েছে চীন থেকে শুরু হয়ে পূর্ব এশিয়ার দেশ ছুঁয়ে ইউরোপ পর্যন্ত। ধনী বা দরিদ্র দেশ কেউই করোনাভাইরাসের আগ্রাসী অত্যাচার থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি। এর অবসান কবে হবে, তা জানতে জীববিজ্ঞানী ও গবেষকেরা অবিরাম গবেষণা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

যেহেতু অসুখটি খুবই ছোঁয়াচে ও খুব দ্রুত অন্যকে সংক্রমিত করে, ফলে পরিস্থিতি যাতে আরও খারাপের দিকে না যায়, সে কারণে সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, যাতে দেশের মানুষ সংক্রমণের ঝুঁকি এড়িয়ে চলতে পারে। সেসব পরামর্শের অন্যতম হলো ‘ঘরে থাকা’, যা পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ‘লকডাউন’ নামে পরিচিত হয়েছে। মানুষকে বলা হয়েছে সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে সে যেন ঘরে থাকে ও সম্ভাব্য আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে যাওয়ার কোনো সুযোগ যেন তার কাজ বা জীবনযাপনের মাধ্যমে না ঘটে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতগুলোকে ছুটি দেওয়া হয়েছে, যাতে মানুষের পারস্পরিক সংযোগ না ঘটে। কলকারখানা, বাজার ও দোকানপাট খোলা রাখার নিয়ম করে দেওয়া হয়েছে, সবাইকে বলা হয়েছে সেই নিয়ম সঠিকভাবে অনুসরণ করতে। এমনকি গাড়ি চলাচল সীমিত করে গণপরিবহন বন্ধ রাখা হয়েছে। বুদ্ধি দেওয়া হয়েছে যাঁদের পক্ষে সম্ভব ও উপযুক্ত, তাঁরা যেন বাসায় বসে অফিসের প্রয়োজনীয় কাজ করেন ও এ রকম কাজের ক্ষেত্রে যাঁদের ইন্টারনেট ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে, তাঁরা যেন তার যথাযথ প্রয়োগ করেন। অনেকেই ইন্টারনেট ব্যবহার করে বাসা থেকে কাজ করছেন, বিশেষ করে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবায় ইন্টারনেট ব্যবহার আমাদের দেশে এখন এই বিপদের দিনে অত্যাবশ্যকীয় সেবায় পরিণত হয়েছে, জনপ্রিয়ও হতে চলেছে।

কিন্তু বাংলাদেশের জন্য আসন্ন সংক্রামক বিপদের আশঙ্কা এখনো কাটেনি। ফলে এই নিয়ম ও পরামর্শগুলো মেনে যদি দেশের মানুষ ঘরে থাকে, আক্রান্ত না হয়ে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা তখন বাড়বে। কিন্তু বাদ সেধেছে ‘অর্থনীতি’ নামের একটি শব্দ। দেশের মানুষ বেঁচে থাকল কিন্তু কাজকর্ম বন্ধ করে ঘরে বসে থাকলে এই অর্থনীতিবাবুর দশা কী হবে? শিল্পোৎপাদন ও বাজারের ওপর নির্ভর করে আমাদের যে আর্থিক ক্রিয়াকর্ম, সেখানে একটি স্থবিরতা এসেছে, এই নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। এটা স্বাভাবিক, আর্থিক ক্রিয়া না থাকলে ও হাতে টাকা না থাকলে দেশের মানুষ অনিশ্চয়তায় থাকবে; কী খাবে, পরবে ও সন্তানের ভবিষ্যৎ কী হবে? এসব নানারকম চিন্তা তাদের আচ্ছন্ন করে রাখবে আর এসব ভাবনা সামনে এসে পড়াই সংগত।

কিন্তু একটি বাস্তবতা আমাদের বুঝতে হবে, এই ভাইরাসের আক্রমণ শুরু হয়েছে মাত্র মাস তিনেক, এর ব্যাপ্তি কত দূর হবে, আমরা জানি না। সরকার দেশের মানুষকে এই মর্মে আশ্বস্ত করেছে যে দেশে খাদ্যাভাব হবে না। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা কাটাতে সরকার ইতিমধ্যে নানামুখী খাতে প্রায় লক্ষ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। প্রধানমন্ত্রী দেশের জনগণকে জানিয়েছেন তিনি তিনটি ধাপে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদের পরিকল্পনা করে রেখেছেন, যাতে সবাইকে নিয়েই এই অবনত পরিস্থিতির মোকাবিলা করে সংক্রমণ শেষে আবার সোজা হয়ে আমরা জীবনধারা শুরু করতে পারি।

আমাদের এ-ও মনে রাখতে হবে, এই ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে যা যা ঘটছে, পৃথিবীর ছোট-বড় কোনো দেশই কিন্তু তা থেকে মুক্ত নয়। এর আগ্রাসী আক্রমণের কারণে একটি যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়েছে, যে কারণে এখনকার এই পরিস্থিতিকে কেউ কেউ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করছেন। এ রকম একটি যুদ্ধাবস্থায় এখন মানব সমাজের টিকে থাকার প্রশ্নই বড় হয়ে উঠেছে। বলা হচ্ছে, জীবনের এমন সংকটে গোটা পৃথিবীর মানুষ একসঙ্গে কখনো পড়েনি, যেখানে শত্রুকে দেখা যায় না আর অদৃশ্য সেই শত্রুকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে শুধু বুদ্ধি সচেতনতার অস্ত্র দিয়ে।

আমরা যদি বেঁচে থাকি নিশ্চয়ই আবার উঠে দাঁড়াতে পারব, অন্তত মানবসভ্যতার ইতিহাস তাই-ই বলে। জমিজমা-টাকাপয়সা আর বিলাসিতার যা যায় যাক, সব ক্ষতি আমাদের মেনে নিতে হবে। ফলে টাকাপয়সা আর ধনদৌলতের চিন্তা না করে আমাদের একটি সুযোগের সদ্ব্যবহার করা দরকার, সে হলো সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখতে সম্মিলিত যুদ্ধে অংশ নেওয়া। এমন একটি অভিন্ন লড়াইয়ে একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ বিশ্বের মানুষ একসঙ্গে পেয়েছে খুবই কম। আমাদের শুধু মাথায় রাখতে হবে শিশুদের আমরা কী বলছি, তাদের সত্য বোঝার বাস্তবতার মধ্যে আমরা রাখছি কি না, কেন সে ঘরের বাইরে যেতে পারছে না, তা সে কতখানি উপলব্ধি করতে পারছে। আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে, তাদের আমরা সবটুকু বোঝাতে পারছি কি না যে এ রকম একটি পরিস্থিতির জন্য মানুষ দায়ী নয়। এই ভাইরাস একটি অতিপ্রাকৃত দানব সমতুল্য বটে, তবে প্রাকৃতিক। আমাদের কিন্তু বুঝতে হবে, যে শিশু এমন একটি পরিস্থিতি দেখছে তার মূল্যায়ন একদিন সে-ই করবে। তখন যেন আমাদের কোনো ভুল তার হাতে ধরা না পড়ে অর্থাৎ আমরা যেন এখন কোনো ভুল না করি। আমাদের মাথায় রাখতে হবে আমরা যে পৃথিবী রেখে যাচ্ছি, তা আমাদের জন্য আমাদের মতো আর থাকবে না। সে হবে আজকের শিশুদের জন্য এক নতুন পৃথিবী। হয়তো সে পৃথিবীতে আর করমর্দন বা আলিঙ্গন থাকবে না। মানুষ আর কখনো প্রিয়জনের গা ঘেঁষে বসবে না কিন্তু সে পৃথিবীকে সে সাজিয়ে নেবে নিজের মতো করেই।

আমরা জানি না করোনা-উত্তর নতুন পৃথিবীতে অর্থনৈতিক বৈষম্য আর থাকবে কি না, কিন্তু এখন সময় হয়েছে সে বৈষম্যমুক্ত সমাজের স্বপ্নে আমরা যেন কোনো বিভক্তির অবকাশ না রাখি। মানুষে, সমাজে আর রাষ্ট্রে কোনো বিভাজন যেন না থাকে, সে চিন্তা করে আমাদের এখন প্রথম উপায় হলো পরামর্শ অনুধাবন করে সেগুলো অনুসরণ করা। ‘ঘরে থেকে’ বিনা পয়সায় এমন চিকিৎসা পরামর্শই আমাদের জন্য এনে দিতে পারে একটি নতুন শোষণহীন সমাজব্যবস্থার সভ্যতা। আমাদের তাই ধৈর্য ধরে সে ভাবনাই ভাবতে হবে।

রেজা সেলিম: পরিচালক, আমাদের গ্রাম গবেষণা প্রকল্প
rezasalimag@gmail. com