দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির ৭৫ বছর

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির পর থেকেই ৮ মে জার্মানিসহ ইউরোপের অনেক দেশে মুক্তি দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। এ বছর নাৎসি স্বৈরাচারের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার ৭৫ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান সাড়ম্বরে করার কথা থাকলেও, বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের কারণে তা বাতিল হয়েছে। সেই অনুষ্ঠান নিয়ে কথা বা বিতর্ক নয়, বিতর্ক হচ্ছে ফ্যাসিবাদের উত্থান এবং পতন আর তার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে।

অতীত ইতিহাসকে পাশে ঠেলে দিয়ে, ভবিষ্যতের সিঁড়ি রচনা করা যায় না। তাই ঘুরেফিরে জার্মান জাতির সেই নির্মোহ সত্য ইতিহাসকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেই কারণেই স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে, ৭৫ বছর আগের সেই মানবতাবিরোধী বিশ্বযুদ্ধ কোনো সামান্য যুদ্ধ ছিল না। এই যুদ্ধ অ্যাডলফ হিটলার ও তাঁর গুটিকয় সমর্থক যুদ্ধবাজ জার্মানের কাজ ছিল না। এর পিছনে ছিল অ্যাডলফ হিটলারের বিশাল ফ্যাসিবাদী সমর্থকগোষ্ঠী।

জার্মানি ফ্যাসিবাদের পতন সম্ভব হয়েছিল মূলত বাইরের শক্তিগুলোর রণকৌশলের মাধ্যমে। যদিও জার্মানিতে ফ্যাসিবাদবিরোধী স্বল্পসংখ্যক প্রতিবাদী গোষ্ঠী ছিল, কিন্তু তাদের সংখ্যা ও শক্তি ছিল খুবই নগণ্য।

১৯৪৫ সালের ১ মে বার্লিনের পতন ঘটাতে চেয়েছিল সোভিয়েত জেনারেল গিওরগিজ সুকোভ ও জেনারেল ইভান কুনিয়েভ। হিটলারের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত মিত্রশক্তির শরিকগুলোকে পিছু ফেলে তাই সর্বাগ্রে বার্লিনের পতন ঘটাতে চেয়েছিল সোভিয়েত লালফৌজ। এই বীরত্বগাথা দেখাতে গিয়ে তারা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হলেও, ফ্যাসিবাদের হাত গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। তাদের নেতৃত্বে সোভিয়েত সেনাদল বার্লিনের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেলেও হিটলারের বার্লিন আত্মরক্ষার যুদ্ধকৌশল তাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে সোভিয়েত লালফৌজের প্রচণ্ড চাপের মুখে, নাৎসি বাহিনীর সেই প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত পরাস্ত হয়, আর ১৯৪৫ সালের ৮ মে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।

যুদ্ধের শেষ দিকে হিটলার বার্লিন গেটের দক্ষিণে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে ভিলহেলম স্ট্রাসে এবং ফস স্ট্রাসের কোনায় অবস্থিত চ্যান্সেলর অফিসের পেছনে, বিশাল বাগানের নিচে ভূগর্ভস্থ বাংকারে আশ্রয় নেন। ১৯৪৫ সালের ২৯ মে বাংকারে বসে হিটলারের নারী সহকারী গেট্রাউট ইউঙ্কে রাতভর হিটলারের ব্যক্ত করা বিষয়গুলো দলিলে লিখেছিলেন। সেখানে তিনি অ্যাডমিরাল ডোয়েনিভসকে সেনাপ্রধান ও চ্যান্সেলর পদে যোসেফ গোয়েবেলকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। আরও অনেক কিছু লেখার পর দলিলের শেষে হিটলার পরাজয়ের লজ্জার চেয়ে সদ্য বিবাহিত স্ত্রী ইভা ব্রাউনসহ স্বেচ্ছামৃত্যুর কথা এবং আত্মহত্যা শেষে তাঁদের দেহ পুড়িয়ে ফেলার কথা লিখেছিলেন। দলিল লেখা শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই হিটলারের বাংকারে খবর আসে, সোভিয়েত লালফৌজ হিটলারের বাংকার থেকে মাত্র ৫০০ মিটার দূরবর্তী পস্টডামার প্লাজ এলাকায় গোলাবর্ষণ করছে। ৩০ এপ্রিল বেলা তিনটার একটু আগে বাংকারের কর্মচারী ও ঘনিষ্ঠ পার্শ্বচরদের কাছ থেকে হিটলার বিদায় নেন। এর পরপরই বাংকারে হিটলারের বসার ঘরের সোফায় ইভা ব্রাউন বিষাক্ত ক্যাপসুল গ্রহণ করেন, আর হিটলার মাথায় নিজে গুলি করে আত্মহনন করেন। বিশ্বজুড়ে সমাপ্তি ঘটে মনুষ্যসৃষ্ট এক পৈশাচিক অধ্যায়ের।

ইউরোপে বা জার্মানিতে ৮ মে মুক্তি দিবস বলে পরিচিত, কিন্তু ঐতিহাসিকেরা বলছেন, এটা জার্মান জাতির মুক্তির দিন নয়। দিনটি হলো বিশ্ব মানবিকতার মুক্তির দিন। আর জার্মান জাতির আত্মোপলব্ধির দিন।

সম্প্রতি জার্মানির দ্য জাইট পত্রিকার একটি অনলাইন জরিপে দেখা যাচ্ছে, ৫৩ শতাংশ জার্মান এখনো মনে করেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য জার্মান জাতিকে এককভাবে দায়ী করা সঠিক নয়। এই যুদ্ধ ও গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল কিছু অপরাধী প্রকৃতির মানুষের কারণেই। কিন্তু ইতিহাস বলে, জার্মানিতে নাৎসিবাদ বা হিটলার উড়ে এসে জুড়ে বসেননি। হিটলারের নাৎসি দল ১৯৩৩ সালে ক্ষমতায় বসেছিল এক–তৃতীয়াংশ জার্মানের ভোটের রায়ে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরই জার্মান জাতির বিভক্তি, তারও ৪৫ বছর পর পুনরায় ঐক্যবদ্ধ, পাশাপাশি প্রতিবেশীদের বিশ্বস্ততা অর্জন করে ইউরোপীয় ঐক্যের জন্য প্রচেষ্টা, এই সবকিছুই সম্ভব হয়েছে সৎ আর স্বচ্ছ রাজনীতির কারণে। গত ৭৫ বছর জার্মান জাতি বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে ক্রমেই সতর্কতার সঙ্গে এগিয়ে গেছে।

বিগত বছরগুলোতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যতম সহযোগী দেশ হিসেবে মহাদেশীয় ঐক্যে জার্মানি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। ইউরোপীয় দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে শিল্প, শিক্ষা, সংস্কৃতি, অভিবাসন, কর্মসংস্থান, শ্রমিক, পরিবহন, সামাজিক ভাতা, মুদ্রা ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ ও মানবধিকার, বৈদেশিক নীতি—সব বিষয়ে একটি অভিন্ন সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করছে।

যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপীয় সমাজব্যবস্থা দেখে ষাটের দশকে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বিখ্যাত জার্মান সাহিত্যিক পল টমাস ম্যান বলেছিলেন, ইতিহাস ভুলে নয়, ইতিহাসের সত্যটাকে মূল্যায়ন করে ইতিহাসের পুরোনো খোলস থেকে জার্মানদের আর ইউরোপীয়দের বেরিয়ে আসার বিষয়টিই মুখ্য। মানবিকতা আর প্রতিবেশীদের সহানুভূতি আদায় করেই জার্মান ও ইউরোপীয় জাতিগুলোকে এগোতে হবে।

নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও জার্মান জাতি তাদের বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী অতীত উপলব্ধি থেকে প্রতিবেশীদের সঙ্গে নিয়ে সামনে এগোতে পারছে, এটাই জার্মান জাতির বড় কৃতিত্ব।

সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি
[email protected]