অর্থনীতিতে মনোযোগ ও স্বাস্থ্য খাতে চোখ রাখতে হবে

কোভিড-১৯ মহামারির শুরুর দিকে চিন্তা ছিল, স্বাস্থ্য খাতের দিকে আমরা মনোযোগ দেব আর অর্থনীতির দিকে চোখ রাখব। কিন্তু দেড় মাস পরই মনে হয়েছে আগে অর্থনীতির দিকে মনোযোগ দিতে হবে, আর চোখ রাখতে হবে স্বাস্থ্য খাতের দিকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটা বেশি জরুরি। কারণ, এ দেশের বিপুল জনগোষ্ঠী এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে।

 বড় ভয় হচ্ছে কোভিডের প্রাথমিক ধাক্কায় নতুন করে ৮০ লাখ থেকে আড়াই কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে পারে। যারা ইতিমধ্যে দারিদ্র্যের মধ্যে আছে তাদের অধিকাংশই চরম দারিদ্র্যের কাতারে চলে আসবে। ফলে এ আশঙ্কাও হচ্ছে যে চরম অপুষ্টি, প্রবল অনাহার ও প্রকট অভাবে পড়বে অনেক মানুষ। আরও দুই মাস অবরুদ্ধ অবস্থা চললে ব্যাপক অনাহার ঠেকানো যাবে না।

 এ ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে অবরুদ্ধ অবস্থা পর্যায়ক্রমে শিথিল করার উদ্যোগটি ভালো হয়েছে। বোরো ধান কাটার সময়ে শ্রমিক চলাচলে বাধা না দেওয়া এবং পোশাক খাত সীমিতভাবে খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তও ইতিবাচক।

 বাজারকে চলতে দিতে হবে

 বাজারব্যবস্থাকে অস্বীকার করে শুধু রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের ওপর নির্ভর করে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যাবে না। এ কথা জোর দিয়ে বলতে চাইছি, কারণ আমরা চীনের মতো আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র নই। ভিয়েতনাম বা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো স্মার্ট দেশও নই।

 তাই ঝুঁকি নিয়ে হলেও বাজারব্যবস্থাকে চলতে দিতে হবে। অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো যেমন কৃষি, রপ্তানিমুখী শিল্প, জরুরি সেবা সচল করার পাশাপাশি নিশ্চিত করতে হবে এসব খাতে স্বাস্থ্যসুরক্ষা।

 রেলওয়েসহ পরিবহনকর্মী, পোশাকশিল্পের শ্রমিক, কৃষিশ্রমিকদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করোনার পরীক্ষা করাতে হবে। স্বাস্থ্যবিধির ওপর জোর দিতেই হবে। মনে রাখতে হবে, পাশ্চাত্যের লকডাউন মডেল এ দেশে হুবহু প্রয়োগ করা যাবে না। জনঘনত্ব ও সংস্কৃতির কারণে ‌সামাজিক দূরত্বের গৎবাঁধা ছকও এ দেশে চলবে না। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে নতুন যেসব ওষুধ ও পরীক্ষা পদ্ধতির খবর পাওয়া যাচ্ছে, তা অবিলম্বে উৎপাদন শুরু করা দরকার। শুধু পিসিআর আমদানি করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে না।

 সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা

 জাতিসংঘের এশীয় ও প্রশান্ত-মহাসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশনের (ইউএনএসকাপ) প্রতিবেদন বলছে, সেসব দেশই করোনা মোকাবিলায় ভালো করতে পেরেছে, যেখানে সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থা আছে। ভারতের কেরালা রাজ্য, কিউবা, শ্রীলঙ্কা, নিউজিল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো (সুইডেন ছাড়া) সে জন্যই ভালো করতে পেরেছে। এসব দেশে করোনার কারণে মৃত্যু কম হয়েছে। অথচ আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছরেও সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা চালু করতে পারিনি।

স্বাস্থ্য খাতে বেসরকারীকরণের ওপর অতিরিক্ত জোর দিতে গিয়ে আমরা সব নাগরিকের জন্য জরুরি ও ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবাও চালু করতে পারিনি। বাড়াতে পারিনি জনস্বাস্থ্যে সরকারি বিনিয়োগ; জিডিপির তুলনায় বরং তা কমছে। আগে ধনী লোকেরা চিকিৎসার জন্য যেতেন, এখন সেটা সম্ভব হচ্ছে না। এখন মনে হয় সবাই বুঝতে পারছে সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা শক্তিশালী করা ছাড়া বর্তমানে তো নয়ই, ভবিষ্যতেও স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলা করা যাবে না।

 ত্রুটিপূর্ণ সুরক্ষা কর্মসূচি

 গরিব মানুষের কথা চিন্তা করে সরকার আগে থেকেই সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি করেছে। বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় ভাতা দেওয়া হয়। কিন্তু পদ্ধতিটা ত্রুটিপূর্ণ। সে কারণে ৫০ শতাংশ বরাদ্দ চলে যায় এমন লোকদের হাতে, যারা দারিদ্র্যসীমার মধ্যেই পড়ে না। শহর এলাকায় বস্তিবাসীরা আছেন চরম বিপদে। কোয়ালিশন ফর দা আরবান পুওরের সঙ্গে আলোচনা করে বস্তিবাসীর জন্য আলাদা বরাদ্দ দেওয়া উচিত।

 আর বিভিন্ন ধরনের ভাতা দেওয়া হয় কার্যত ছয় মাস পরপর। আর যারা দারিদ্র্যসীমার কিছুটা ওপরে রয়েছে, তাদের জন্য কোনো কর্মসূচিই নেই। তাদের অনেকেই কোভিডের কারণে দরিদ্র হয়ে গেছে বা যাচ্ছে। ভারতের আধার কার্ডের মতো আমাদের কোনো কার্ড নেই। থাকলে আমরা জানতে পারতাম কে কোন ধরনের ভাতা পায়।

 কোভিড আসার পর মোদি সরকার তিন মাসের জন্য এক হাজার রুপি করে নগদ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। সে অনুযায়ী দরিদ্র মানুষেরাও নগদ সহায়তা পাচ্ছে। লকডাউনের কারণে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ রাজস্থানে গিয়ে আটকা পড়লেও সহায়তা পেতে তার সমস্যা হচ্ছে না। আবার কেউ কিছুই পাচ্ছে না, কেউ পাচ্ছে দুই থেকে তিনবার—এমন সমস্যাও হচ্ছে না। ভারতের সব সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিই আধার কার্ডের সঙ্গে যুক্ত। আমাদেরও সে পথে যেতে হবে। জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গেই এর একটা ব্যবস্থা করা যায়।

 প্রণোদনা কি যথেষ্ট

 সরকার একটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, যার আকার মোটামুটি খারাপ নয়। তবে শিল্প খাতের বেশির ভাগ প্রণোদনাই নগদ সহায়তা নয়, সুদের হারে ছাড় হিসেবে এসেছে। বিশ্বের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, প্রণোদনার আকার হওয়া উচিত অন্তত জিডিপির ৫ শতাংশ। যা ঘোষণা করা হয়েছে, তা থেকে বৃহৎ ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থ নিতে পারবে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে ক্ষুদ্র ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের লোকজনের, যারা ব্যাংক হিসাবও সংরক্ষণ করে না। ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প মালিকের কোথায় কী ব্যাংক হিসাব রয়েছে, তা জানা গেলে সরকারের ঘোষিত প্রণোদনা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ছাড়া সহজেই পৌঁছে দেওয়া যেত।

 বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দারিদ্র্যবিষয়ক একটি তথ্যভান্ডার তৈরি করেছে। এখনো প্রকাশিত না হলেও বিবিএসের এই তথ্য ব্যবহার করে এখন সুফল পাওয়া যেতে পারে। এই ফাঁকে তথ্যগুলো হালানাগাদও করতে হবে। কারণ, কোভিডের কারণে অনেকের অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে।

 তিনটি বিষয়ে জোর চাই

 আধুনিক রাষ্ট্র গড়ার ক্ষেত্রে তিনটি বিষয়ে জোর দেওয়ার কথা বলা হয়। দক্ষ বাজারব্যবস্থা গড়ে তোলা, রাষ্ট্রযন্ত্রকে আরও মানবিক করা এবং প্রযুক্তিনির্ভর উন্নয়ন। বাজার অর্থনীতি আমরা করেছি, কিন্তু বাকি দুটোতে পিছিয়ে আছি।

 রাষ্ট্রকে আরও মানবিক করতে হলে ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্য ও সুরক্ষাব্যবস্থা’ মাঠপর্যায়ে চালু করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, যা নেই এ দেশে। এরপর আসি প্রযুক্তির প্রসঙ্গে। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ যেকোনো আধুনিক প্রযুক্তি সাগ্রহে গ্রহণ করে। সেটা যেমন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে, তেমনি ফসলের মৌসুমে ধান কাটার যন্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে। কিন্তু ইন্টারনেট প্রযুক্তি তাদের কাছে সেভাবে পৌঁছাতে পারেনি। এ কারণে লকডাউনের সময় ধনীর ছেলেমেয়েরা অনলাইনে কোচিং করেছে কিন্তু গরিবের ছেলেমেয়েরা তা করতে পারেনি। করোনা এই বৈষম্যকে আরও প্রকট করে তুলেছে।

অর্থায়নের চিন্তা

 প্রশ্ন আসতে পারে, টাকা আসবে কোথা থেকে? আমি এই প্রশ্নটিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি না। আমরা এত দিন মোটামুটিভাবে ঘাটতি মেটানোর ক্ষেত্রে একটি রাজস্ব শৃঙ্খলা মেনে আসছি। এটা আমাদের শক্তির দিক। এখন বিপদের এই বছরে একটু বেশি ঘাটতি-অর্থায়ন করে হলেও সাধারণ মানুষকে বাঁচাতে হবে। মূল্যস্ফীতির ওপর যাতে বেশি চাপ না পড়ে, সেটাও দেখতে হবে।

 ফসল ভালো হলে, রপ্তানিশিল্প চালু হলে, সীমিত পরিসরে ক্ষুদ্র ব্যবসা সেবা খাত কাজ করা শুরু করলে মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি থেকে অনেকটাই রক্ষা পাওয়া যাবে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমেছে, সেটাও এ ক্ষেত্রে সাহায্য করবে। তবে মধ্য মেয়াদে কর রাজস্বব্যবস্থা ঢেলে সাজাতেই হবে। পাশাপাশি দরকার বিত্তবানদের কাছ থেকে ধারাবাহিকভাবে পর্যাপ্ত সম্পদ কর নেওয়া।

 এদিকে আবার প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয়ের একটা নেতিবাচক চিত্রের আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে।

 চাই অবাধ তথ্যপ্রবাহ

 সবশেষে বলব, গণতন্ত্র থাকলে যেমন দুর্ভিক্ষ বা বড় ধরনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়া যায়, তেমনি বড় ধরনের বিপর্যয় এলে গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে হয়। এ জন্য করোনা সম্পর্কে যেমন অবাধ তথ্যপ্রবাহ চাই, গণমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতা চাই, তেমনি চাই সব দল ও মত নিয়ে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে করোনা মোকাবিলায় জরুরি ত্রাণ কমিটি গঠন ও ত্রাণ বিতরণের উদ্যোগ।

 বিনায়ক সেন: অর্থনীতিবিদ ও প্রাবন্ধিক