করোনা-বিহ্বলতায় জীবিকার পাল্লা ভারী

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

ডিম আগে না মুরগি—এ এক চিরকালীন অমীমাংসিত বিতর্ক। অনেকটা সে রকমই করোনাক্রান্ত বিশ্বে জীবন না জীবিকা কোনটা প্রধান বিচার্য, সেই বিতর্ক সবাইকে বিচলিত ও ব্যস্ত রেখেছে। এ বিতর্কে ভারতীয় নীতিনির্ধারকেরাও বিহ্বল।

মার্চ মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তিন সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণা করে বলেছিলেন, ‘জান হ্যায় তো জাহান হ্যায়’। মানে আগে প্রাণ বাঁচুক। তারপর পৃথিবী। পৃথিবী বলতে রুজি-রোজগার বা জীবিকা। প্রাণে না-বাঁচলে জীবিকা যে অর্থহীন! একুশ দিন পর তিনি আরও দুই সপ্তাহের জন্য লকডাউন বাড়ানোর ঘোষণা দিয়ে বললেন, ‘জান হ্যায়, জাহান ভি’। অর্থাৎ, জীবন ও জীবিকা দুটোই বাঁচাতে হবে। নীতিনির্ধারকেরা এখন বলছেন, করোনাকে নিয়েই বাঁচতে হবে। সহাবস্থান। এটাই হতে চলেছে বিশ্বব্যাপী ‘নিউ নর্মাল’।

নিউ নর্মালের এই বোধোদয় ত্বরান্বিত করেন কোটি কোটি পরিযায়ী কৃষিশ্রমিক ও নির্মাণশ্রমিক। লকডাউনে তাঁদের হাহাকার সরকারের ব্যর্থতা প্রকট করার পাশাপাশি টনকও নড়িয়ে দেয়। কোটি কোটি শ্রমিকের হাল কী হবে না ভেবেই যে সরকার জীবন রক্ষাকে প্রাধান্য দিয়েছিল, সে–ই নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়। করোনার পরীক্ষা, চিকিৎসা, আইসোলেশন, ভেন্টিলেটর, প্রতিষেধক, পিপিই, পরিকাঠামোসংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলোর পেছনে আদৌ ভাবনাচিন্তা ও প্রস্তুতি ছিল না।

শাসকগোষ্ঠী আজ কৃতিত্ব দাবি করছে। বাস্তব কিন্তু ভিন্ন। গোটা ফেব্রুয়ারিজুড়ে সরকারি মননে ছিল শুধুই মার্কিন প্রেসিডেন্টের সফর। দিল্লি-দাঙ্গাও তখনই। মার্চ মাসের বেশিটা জুড়ে চলল কংগ্রেসকে হটিয়ে মধ্যপ্রদেশ দখল-পর্ব! করোনা বিষয়ে শুধু কিছু ফ্লাইট বাতিল, পর্যটকদের তাপমাত্রা মাপা ও সন্দেহভাজনদের একটি মাত্র আইসোলেশন কেন্দ্রে পাঠানো। অথচ জানুয়ারিতে প্রথম সংক্রমণ দেখা দেওয়ামাত্র কেরালা সরকার বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট করেনি। আজ করোনা মোকাবিলায় কেরালাই সেরা মডেল।

ভারতীয় সরকারি বিশেষজ্ঞরা বুঝিয়েছিলেন, পাঁচ সপ্তাহের লকডাউন অবস্থা সামলে দেবে। মে মাসটা ভালোয় ভালোয় কাটলে দুশ্চিন্তা কমবে। তাঁরাই এখন বলছেন, জুন থেকে আগস্ট নাকি আরও মারাত্মক হবে!

ভাবছি, যাঁদের উদ্দেশে ‘ঘরে থাকো ঘরে থাকো’ বলে যাঁরা চিল চিৎকার করছেন, তাঁরা ওইভাবে ঘরে থাকার যন্ত্রণা কোনো দিন ভোগ করেছেন কি না! দশ বাই বারোর একটা ঘুপচিতে যাঁদের সংসার, তাঁদের কাছে ‘সামাজিক দূরত্বের’ বার্তা পরিহাস ছাড়া কিছু নয়। দিনান্তের রোজগারে যাঁদের ভাতের হাঁড়ি চুলায় ওঠে, এক হপ্তা কর্মহীন থাকা তাঁদের পক্ষে সম্ভব? সরকারি আতশকাচে এঁরা অধরা বলে এই জনবহুল দেশে করোনা মোকাবিলায় এক ধাঁচের ছকে গড়ে ওঠে। মুড়ি ও মুড়কির এক জাত! ফলে যা হওয়ার তাই ঘটছে।

এই নিবন্ধ লেখার সময় জানা গেল, সংক্রমণ দ্বিগুণ হচ্ছে কম সময়ে। ১২ দিনে সংখ্যা দ্বিগুণ হচ্ছিল, এখন হচ্ছে ১০ দশমিক ২৫ দিনে! মানে, কম সময়ে বেশি মানুষ সংক্রমিত হচ্ছেন। এই তথ্য গ্রামীণ কৃষি ও শিল্প উন্মুক্ত হওয়া, নিরন্ন ও কপর্দকহীন পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরার অনুমতি দেওয়া, সরকারি ও বেসরকারি অফিস খোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর। ইতিমধ্যে বেসরকারি যান চলাচলও শুরু হয়েছে। ৭০ শতাংশ বেশি দাম দিয়ে মদ কিনতে উদ্বেল জনতাকে সামলাতে পুলিশ হিমশিম খাচ্ছে। বহু টালবাহানা শেষে ঘরে ফিরছেন পরিযায়ী শ্রমিক, আটক পড়ুয়া-পর্যটক ও প্রবাসী ভারতীয়রা। সংক্রমণের আশঙ্কা বাড়ার ঝুঁকি সত্ত্বেও খুলছে রোজগারের পথ।

গরিবদের জন্য বিনা মূল্যে অথবা সস্তায় খাবার কেন্দ্র–রাজ্য দুই তরফই চালু রেখেছে। কিন্তু ভারতের মতো বিশাল দেশে তা সবার কাছে পৌঁছায় না। তা ছাড়া ‘দুর্নীতি রুখিবে কে’? কারও সর্বনাশই তো কারও না কারও পৌষ মাস! করোনা–কাণ্ডেও সেই ছবি অমলিন! তবে আমি চমৎকৃত সাধারণ, অতি সাধারণ মানুষের মহানুভবতা ও মানবিকতায়। পাড়ায়–মহল্লায় অন্নদাতা রূপে এঁরা আবির্ভূত! এলাকার নিরন্নদের মুখে দুবেলা খাবার তুলে দিতে এঁরা দিনরাত এক করে দিচ্ছেন! সাধ্যমতো সাহায্যের ডালি নিয়ে দাঁড়াচ্ছেন অতি সাধারণ মানুষজন! জীব-প্রেমে ঈশ্বরসেবার এই সব খবর চোখে জল এনে দেয়। সেলিব্রিটি এঁরাই। এঁরাই সালাম পাওয়ার যোগ্য।

ভারতে লকডাউন সত্ত্বেও সংক্রমণের দীর্ঘ উল্লম্ফন অবশ্যই চিন্তার, যদিও আশা জোগাচ্ছে বেশির ভাগ মানুষের সুস্থ হয়ে ওঠার প্রবণতা। এখন ৯০ শতাংশ সুস্থ হচ্ছেন, মৃত্যু ঘটছে ১০ শতাংশের। কিছুদিন আগেও এই পরিসংখ্যান ছিল ৮০: ২০। অর্থনীতিবিদদের অধিকাংশ তাই কাজকারবার শুরু করার পক্ষে। নইলে তাঁরা ভাবছেন, করোনার হাত থেকে বাঁচলেও অনাহারে মৃত্যু অনিবার্য।

সৃষ্টি হচ্ছে নতুন বিতর্কও। কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী নির্মাণশিল্পের চাপে পরিযায়ী শ্রমিকদের ট্রেন বাতিল করেছেন। তাঁদের তিনি রাজ্যে ধরে রাখতে চান। অথচ শ্রমিকেরা বলছেন, ঘরে ফিরব, বকেয়া মেটাও। এ যেন নব্য কৃতদাসপ্রথা! শিল্পের চাহিদা না শ্রমিকদের ইচ্ছা প্রাধান্য কোনটার? প্রধানমন্ত্রীর হুকুম সত্ত্বেও বেতন কাটা, ভাড়াটে উচ্ছেদ আকছার ঘটছে। কারও শাস্তি হয়েছে শোনা যায়নি!

বাড়ছে রাজনৈতিক আক্রমণও। পরিযায়ী শ্রমিকদের কাছ থেকে ট্রেনের ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ এনেছেন সোনিয়া গান্ধী। রাহুলের দাবি, অবিলম্বে সাধারণের ব্যাংক খাতায় সাড়ে ৭ হাজার করে টাকা ফেলা হোক। প্রধানমন্ত্রীকে তিনি গণতন্ত্রী হতে, মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে নিরন্তর পরামর্শ করতে ও কাজের স্টাইল বদলাতে বলেছেন। রাজনীতি চলছে সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা চাপা নিয়েও। এসবের মধ্যেই নিষেধাজ্ঞার বজ্র আঁটুনি শিথিল হচ্ছে।

বিল গেটসের পরামর্শ পৃথিবী কানে তোলেনি। পাঁচ বছর আগেই তিনি বলেছিলেন, ভবিষ্যতের লড়াই ভাইরাসের বিরুদ্ধে। যুদ্ধের জন্য যেমন সেনাবাহিনী, ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়তে তেমনই সর্বস্তরীয় বাহিনী গড়তে হবে। অতি দ্রুত আইসোলেশন কেন্দ্র ও ‘ডেডিকেটেড’ হাসপাতাল তৈরির ব্যবস্থা রাখতে হবে। করোনার অভিজ্ঞতায় শিক্ষিত হতে না পারলে ভবিষ্যৎ রেয়াত করবে না।

প্রশ্ন হলো, আমরা শিখব কি?

জীবন ও জীবিকার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার খেলায় পাল্লাটা ক্রমে জীবিকার দিকেই ঝুঁকছে। পার্থক্য শুধু যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস প্রদেশের লেফটেন্যান্ট গভর্নর ডন প্যাট্রিকের মতো ঠোঁটকাটা ও ভণিতাহীন-সাহসী হয়ে অনেকেই বলতে পারবেন না, ‘লকডাউনে দেশের অর্থনীতি লাটে উঠবে। আমরা যাঁরা সত্তরোর্ধ্ব, চলুন কাজে যাই। জীবিকা শুরু করি। মরলে মরব। কিন্তু আমেরিকার অর্থনীতি শেষ হতে দেব না।’

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি