এবারের ঈদে ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য কিছু করি

চীনে যখন করোনার সংক্রমণ শুরু হয়েছিল, তখন তারা নববর্ষের আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠার জন্য দীর্ঘ ছুটি কেবল শুরু করেছে। কিন্তু সে উৎসব তারা বাতিল করতে বাধ্য হয় আকস্মিক করোনার হানায়। এবার বিশ্বে খ্রিষ্টীয় নববর্ষের উৎসব হয়নি। ইরানের নওরোজ, বাংলা নববর্ষের আয়োজনই করা যায়নি। বহু ধর্মীয় উৎসবও করোনার থাবায় পালন করেনি দুনিয়ার বিভিন্ন জাতি, ধর্মের মানুষ। পবিত্র কাবা শরিফ বন্ধ রাখা হয়েছিল। বৌদ্ধ পূর্ণিমা পালিত হলো নিতান্ত ঘরোয়া আর অতি অনাড়ম্বরের মধ্যে।

মুসলমানদের বড় উৎসব দুই ঈদ। পবিত্র রমজানের ঈদ এ মাসেই। আশঙ্কা করা হচ্ছে, তখনো হয়তো করোনার ভয়াল থাবায় দেশ কাঁপতে থাকবে। যেসব দেশ করোনা নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছে, সেসব দেশের রেকর্ড তা–ই বলে। বাংলাদেশের জন্য মে মাসই সবচেয়ে দুঃসময়ের বলে দেশি–বিদেশি বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা।

সরকার বলেই দিয়েছে, এমন পরিবেশে এবার ঈদের আনুষ্ঠানিকতা খুব সীমিত করা হবে। লোক চলাচল বন্ধ করতে যাত্রী পরিবহন নিষিদ্ধ থাকবে। যে যেখানে আছে, সেখানেই ঈদ পালন করার জন্য সরকার আগেভাগেই জানিয়ে দিয়েছে। ঈদের জামাত হবে কি না, তা নিয়েও শঙ্কা আছে। পরিস্থিতি বুঝে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে বলে মনে হয়। ঈদ উদ্‌যাপনের বিষয়ে সরকারের এই আগাম বার্তাকে দেশবাসী স্বাগত জানায়।

ঠিক এই মুহূর্তে বাংলাদেশে করোনা–পরিস্থিতি সবচেয়ে উদ্বেগজনক। প্রতিদিন নতুন সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। যদিও প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে জনমনে নানা সন্দেহ আছে। কেননা করোনা শনাক্তে পরীক্ষার হার বাংলাদেশে খুব কম। প্রতি ১০ লাখ জনসংখ্যায় মাত্র ৬৪১ জন। করোনা পরীক্ষায় সবচেয়ে নিচে জিম্বাবুয়ে, ৫১৪ জন। এরপরই বাংলাদেশের অবস্থান। প্রায় ১৭ কোটি মানুষের দেশে এ পর্যন্ত পরীক্ষা করা হয়েছে মাত্র ১ লাখ ৫ হাজার ৫১৩ জন (ওয়ার্ল্ডওমিটার ডট ইনফো, ৬ মে, ২০২০)। সুতরাং বাস্তব চিত্র কতটা প্রতিফলিত হচ্ছে, তা নিয়ে বিস্তর সন্দেহ আছে।

জীবন ও জীবিকার দ্বন্ধে বাংলাদেশে করোনা মোকাবিলায় অনেক ঘাটতি সবার নজরে পড়েছে। আমরা গরিব দেশ। অতিরিক্ত জনভারে ন্যুব্জ। স্বাস্থ্য পরিকাঠামো দুর্বল। জনসচেতনতা প্রশ্নবিদ্ধ। তাই অনেক কিছুই এখানে বেশ এলোমেলো। রোগের ওপর বিষফোঁড়া হলো দুর্নীতি।

কয়েক কোটি মানুষ এখন কর্মহীন। সরকারের লক্ষ–কোটি টাকার প্যাকেজ চাহিদার তুলনায় সত্যিই অপ্রতুল। মানুষকে কাজে ফেরানো জরুরি। আবার তাতে রয়েছে প্রচণ্ড ঝুঁকি। কিছু জরুরি সেবা যেকোনো মূল্যে চালু রাখতেই হবে। তাতেই শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে দোকানপাট খোলার চিন্তাভাবনা নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে। গ্রামীণ অর্থনীতিও স্থবির। বোরো ধান উঠে গেলে গ্রামেও কাজের সুযোগ কমে যাবে।

অন্যান্য দেশের নজির থেকে দেখা যাচ্ছে, সংক্রমণ দৈনিক সর্বোচ্চ সংখ্যায় পৌঁছানোর পর আরও প্রায় দুই সপ্তাহ মৃত্যুর মিছিল ঊর্ধ্বগামী থাকে। সে বিবেচনায় মে মাস সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ।

এমন জটিল পরিস্থিতিতে দেশের সবাই মিলে করোনার বিরুদ্ধে এ লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। আমরা সম্মিলিতভাবে নিশ্চয়ই তা করতে পারি। সরকার যেন লোক চলাচলের ওপর কড়া বিধিনিষেধ আরোপ করে। অতি জরুরি ছাড়া সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঘরে থাকা নিশ্চিত করে। অন্যদিকে পণ্য চলাচলের জন্য পণ্যবাহী বাহন নির্বিঘ্নে চলার ব্যবস্থা করে।

আমরা এবারের ঈদ বিপন্ন মানুষের কল্যাণে উৎসর্গ করতে পারি।

প্রথমত, ঈদে কোনো বাড়তি খরচ না করে সে অর্থ আমরা ভুখা মানুষের জান বাঁচানোর জন্য দিতে পারি। একটা ঈদে আমরা কোনো পোশাক বা অন্য কিছু না কিনি, আমরা অতি সামান্য সেমাই আর স্বল্প পরিমাণ মাংস খেয়ে ঈদ পালন করতে পারি। সংক্রমণের কারণে অতিথি হিসেবে কারও বাড়িতে কেউ যাবে না বলেই আমার বিশ্বাস। আমি অর্থনীতিবিদ বা বিশেষজ্ঞ নই। কিন্তু এটা বুঝি, এতে আমাদের যে বিপুল অর্থ বেঁচে যাবে, তা দিয়ে আমরা সহজেই সব ভুখা মানুষকে বাঁচাতে পারব। দুর্যোগ-দুর্বিপাকের দেশ আমাদের। চিরকাল আমরা আর্তমানবতার সেবা করে এসেছি। এটাই বাঙালির ঐতিহ্য, এটাই বাঙালির গর্ব ও শক্তির মূল উৎস। অতীতে বারবার আমরা তা করেছি। এবার আমরা যেন তা আরও বৃহৎ মাত্রায় করতে পারি।

মানুষের সেবা করার চেয়ে বড় কোনো ইবাদত নেই। ভুখা মানুষদের খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখার এই চেষ্টায় নিশ্চয়ই আল্লাহ খুশি হবেন। আমাদের ইমানের একটি বড় পরীক্ষায় আমরা পাস করে যাব। আল্লাহর নেয়ামতে নিশ্চয়ই তাতে অনেক বেশি বরকত মিলবে।

আমরা সমাজের বিত্তবান মানুষের কাছেও একই আবেদন জানাই। সরকারের কাছে আবেদন করি, মোবাইল ব্যাংকিং সহজ করার ব্যবস্থা করতে। টাকা পাঠানোর মাশুল যেন অপারেটররা অন্তত অর্ধেকে নামিয়ে দেয়, তার ব্যবস্থা করতে। আমরা যে যেখানে আছি, সেখান থেকেই যেন আমাদের চেনাজানা মানুষদের পাশে দাঁড়াতে পারি, কাছে কিংবা দূরের মানুষের কাছে টাকা পাঠাতে পারি।

আসুন, এবারের ঈদ আমরা সবার সঙ্গে ভাগ করে নিই। সবার দুঃখে সমব্যথী হয়ে তাদের পাশে দাঁড়াই। আমার পাশের জনকেই আমি আগে সাহায্য করতে পারি। সেটি লোকদেখানো না হোক। ফটোসেশনের মতো কুৎসিত কিছু যেন না করি।

আমিরুল আলম খান, যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান
[email protected]