আমাদেরও চিকিৎসা গবেষণায় গুরুত্ব দিতে হবে

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

১৯৫০ দশকের প্রথম দিকে আমাদের শৈশবে অনেকের ঘরের দেয়ালে দেখেছি বিভিন্ন মনীষী ও কৃতী ব্যক্তিদের বাঁধানো ছবি টাঙানো। আমাদের বিভিন্ন ঘরে সে রকম বাঁধানো ছবি ছিল। রামমোহন রায়, স্যার সৈয়দ আহমদ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, নবাব সলিমুল্লাহ, মহাত্মা গান্ধী, মুহম্মদ আলী জিন্নাহ, জগদীশচন্দ্র বসু, সুভাষ বসু প্রমুখ। এই সব অতি খ্যাতিমানের বাইরে একটি ছবি ছিল, যার নিচে লেখা: স্যার ডাক্তার ব্রহ্মচারী। পরে জেনেছি, তাঁর নাম উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী। আমার আব্বা তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। আব্বার কাছে তাঁর প্রধান পরিচয় ছিল ডাক্তার ব্রহ্মচারী কালাজ্বরের ওষুধ ‘ইউরিয়া স্টিবামাইন’-এর আবিষ্কারক।

বহু বছর পরে আমি গবেষণা করতে গিয়ে জানতে পারি, ডা. ব্রহ্মচারী ছিলেন নবাব সলিমুল্লাহর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং নবাব বাহাদুরের শেষনিশ্বাস ত্যাগ করার সময় রাত দুইটায় কলকাতার চৌরঙ্গীর বাসভবনে তাঁর শয্যার পাশে ছিলেন। ডা. ব্রহ্মচারী ছিলেন কবি নজরুলেরও চিকিৎসক। প্রতি দুই-তিন দিন বাদ দিয়ে চেম্বার থেকে বাড়ি ফেরার সময় কবিকে দেখে যেতেন।

একসময় বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া ও কালাজ্বরে অসংখ্য মানুষ মারা যেত। করোনাভাইরাসের মতো কয়েক দিনের মধ্যেই মৃত্যু হতো না, বছরখানেক ধুঁকে ধুঁকে মারা যেত। শরীর শুকিয়ে কাঠি, কিন্তু পেটের ভেতর প্লীহা ও লিভার বড় হতে হতে একটা কলসের মতো হয়ে যেত। রক্তশূন্যতায় শরীর ফ্যাকাশে হয়ে মারা যেত।

ডা. ব্রহ্মচারী ছিলেন অন্য রকম জ্ঞানসাধক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলকাতা মেডিকেল কলেজ, দুটোরই একই সঙ্গে ছাত্র ছিলেন। গণিত অনার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। কেমিস্ট্রি মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। মেডিসিন ও সার্জারি দুটোতেই এমবি এবং প্রথম। তারপর চিকিৎসাবিজ্ঞানে ইউরোপের সর্বোচ্চ ডিগ্রি ছিল একাধিক। অ্যানাটমি ও ফিজিওলজিতেও পিএইচডি। যা হোক, চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই জাহাজ কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উঁচু পদে যোগদান না করে নবাব সলিমুল্লাহর আহ্বানে ঢাকা মেডিকেল স্কুলে (পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) যোগদান করেন। রোগীদের ওয়ার্ডে রাউন্ড দিয়ে রাত ১০টা পর্যন্ত পড়ে থাকতেন প্যাথলজির ল্যাবরেটরিতে। শুধু কালাজ্বর নয়, ব্ল্যাক ওয়াটার ফিবারেরও ওষুধ তিনি আবিষ্কার করেন। তাঁর ট্রিটিজ অব কালাজ্বর গ্রন্থটি আমি দেখেছি।

দুই যুগ ঢাকায় থাকার পর ১৯২০ দশকের শেষ দিকে ডা. ব্রহ্মচারী কলকাতায় গিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ব্রহ্মচারী রিসার্চ ইনস্টিটিউট এবং দেশি ওষুধ নিয়ে গবেষণা করেন। ভিআইপি রোগীরা তাঁর কাছে ভিড় করতেন। টাকার জন্য তিনি ডাক্তারি করতেন না। নবাব সলিমুল্লাহ বা কবি নজরুলের কাছ থেকে কোনো দিন একটি পয়সাও নেননি। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এ পর্যন্ত যাঁরা নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, আমার অনধিকারী ধারণা এবং বদ্ধমূল ধারণা, তাঁদের কারও থেকে চিকিৎসাশাস্ত্রে ডা. ব্রহ্মচারীর অবদান কম নয়। তাঁর প্রধান ‘অযোগ্যতা’ তিনি বাঙালি এবং ভারতীয়।

চিকিৎসাশাস্ত্রে ভারতবর্ষ ও চীনের মানুষ তিন হাজার বছর আগে ইউরোপের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিল। আমেরিকার তো নামগন্ধই ছিল না। অসুস্থতা মানুষের জীবনের অংশ। প্রাকৃতিক উপায়েই কীভাবে রোগমুক্ত থাকা যায় এবং রোগাক্রান্ত হওয়ার পর কী উপায়ে তা থেকে নিরাময় লাভ করা সম্ভব, তা নিয়ে এ দেশের মানুষ গবেষণা করেছে। এই উপমহাদেশের আয়ুর্বেদ অতি প্রাচীন চিকিৎসাব্যবস্থা। চীনের ছিল কনফুসিয়াস-পূর্ব সময় থেকেই নিজস্ব চিকিৎসাব্যবস্থা। তাওবাদ, আকুপাংচার চীনের নিজস্ব চিকিৎসাবিধি। প্রাক্‌-মধ্যযুগে আরব চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা সবচেয়ে এগিয়ে ছিলেন। ইবনে সিনার কানুন শব্দটা প্রতিদিন উচ্চারিত। সংক্রামক রোগের মহামারির সময় ‘আইসোলেশন’ কী জিনিস, তা বাঙালি শত বছর আগেই জানত। তখন পৃথিবীতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ছিল না।

চীনে করোনার প্রাদুর্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে এই ভাইরাস প্রতিরোধের ভ্যাকসিন আবিষ্কার এবং করোনা রোগীর চিকিৎসার ওষুধ উদ্ভাবন নিয়ে বিভিন্ন দেশে গবেষণা শুরু হয়। আমেরিকা, ইতালি, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানির বিজ্ঞানীরা অক্লান্ত কাজ করছেন। ইসরায়েল দাবি
করেছে, তারা অ্যান্টিবডি আবিষ্কার করেছে। ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং বড় বড় ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান গবেষণা চালাচ্ছে, এর মধ্যেই অনেকটা সফলও হয়েছে।

বিশ্বখ্যাত ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি এসকেএফ করোনা রোগীর ওষুধ তৈরিতে বাংলাদেশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। এসকেএফের কর্মকর্তারা নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে রেমিভির নামের একটি ইনজেকশন বাজারে ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, যা মানুষের মধ্যে বিপুল আশার সঞ্চার করেছে। নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের রোগীদের মধ্যে প্রয়োগে ওষুধটি যদি কাঙ্ক্ষিত ফল দেয়, তবে তা হবে করোনাকালের আশীর্বাদ। ওষুধটির জেনেরিক নাম রেমডেসিভির (Remdesivir)।

ওষুধশিল্পে আমাদের অগ্রগতি অসামান্য। বাংলাদেশের ওষুধের মান ভালো। বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। আমাদের মেধাবী বিজ্ঞানী রয়েছেন। শুধু পশ্চিমাদের অনুকরণ নয়, নিজেদেরও উদ্ভাবনের ক্ষমতা রয়েছে। গবেষণাকাজের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা গেলে চিকিৎসাবিজ্ঞানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বড় অবদান রাখার মতো সুযোগ্য মানুষ আমাদের আছে।

চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানির ভূমিকা প্রধান। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বিপুল অর্থের প্রয়োজন। অনুৎপাদনশীল খাতে সরকার অঢেল অর্থ ব্যয় করে। তাতে জীবনযাত্রা কিছুটা আরামদায়ক হয় বটে, কিন্তু জাতি এগিয়ে যায় না। পশ্চিম এগিয়ে গেছে বৈজ্ঞানিক গবেষণা দ্বারা, শুধু অবকাঠামো বানিয়ে নয়। করোনা আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে কৃষিবিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিজ্ঞান গবেষণায় সর্বোচ্চ মনোযোগ না দিলে বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব নয়।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক