দৃষ্টি ও চিন্তার বদ্ধতা কাটানোর পথ দেখাচ্ছে করোনা

বর্তমান পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার প্রধান খুঁটি চারটি: যুদ্ধ-সমরাস্ত্র, জীবাশ্ম জ্বালানি, আর্থিক খাত ও কৃষিতে বিষের বাণিজ্য। এই চারটি ক্ষেত্রেই গুরু হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যে বিশ্বের সবচেয়ে পরাক্রমশালী। সারা বিশ্বে যুদ্ধ, গোয়েন্দা নজরদারি এবং পারমাণবিক-রাসায়নিক-জৈব অস্ত্র গবেষণা ও মজুতের যে ভয়ংকর চিত্র, তার পেছনের প্রধান শক্তি হচ্ছে এই দেশ। এত পরাক্রমশালী হওয়া সত্ত্বেও করোনাভাইরাসের আক্রমণে দেশটি এককভাবে সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত।

বাংলাদেশের মতো অনেক দেশের সরকারই বলতে পারে, যেখানে এত পরাক্রমশালী যুক্তরাষ্ট্র পারল না, সেখানে আমাদের আর দোষ কী? এত উন্নত দেশ যদি না পারে, অনুন্নত বাংলাদেশ কীভাবে পারবে? আসলে করোনাভাইরাসের এই ভয়ংকর বৈশ্বিক সংকট আমাদের উন্নয়নের সংজ্ঞা নতুনভাবে ভাবতে চাপ দেয়; দৃষ্টি ও চিন্তার বদ্ধতা কাটানোর পথ দেখায়। দেখায় যে পেশির জোর, অস্ত্র আর অর্থের দাপট, বহুতল ভবন, জৌলুশ থাকা মানেই উন্নয়ন নয়। কোনো দেশে সম্পদ কম থাকতে পারে, জৌলুশ না থাকতে পারে, কিন্তু যদি সে দেশের নাগরিকদের খাদ্য, চিকিৎসা, জীবনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকে, মর্যাদা থাকে, গুরুত্ব থাকে, যদি সেখানে প্রাণ-প্রকৃতির সুরক্ষা থাকে, তাহলে সেই দেশই উন্নত।

মানুষের জগতে রোগ-দুর্যোগ নানা মাত্রায় আসতেই পারে। কিন্তু তাতে কোন দেশের নাগরিকেরা কতটা বিপর্যস্ত হবেন, তা নির্ভর করে ওই দেশ কোন দর্শন দ্বারা পরিচালিত, সেখানে কী এবং কারা গুরুত্বপূর্ণ তার ওপর। বেশি সম্পদ, কম সম্পদ যে নির্ধারক নয়, তা করোনা-বিপর্যয়কালে মহাপরাক্রমশালী যুক্তরাষ্ট্র আর ক্ষুদ্র কিউবার অবস্থা তুলনা করলেই স্পষ্ট হয়। কিউবা এত কম সম্পদ নিয়েও তার প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপত্তা দিতে পেরেছে। শুধু তা-ই নয়, তারা করোনা-সহায়তার জন্য ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার ২২টি দেশে চিকিৎসক ও চিকিৎসা সরঞ্জাম পাঠিয়েছে। অথচ বিপুল সম্পদ থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকেরা নৈরাজ্যিক পরিস্থিতির শিকার। কেন? কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ ও সক্ষমতা তার নাগরিকদের চেয়ে বেশি বৃহৎ একচেটিয়া পুঁজির জন্য, সাম্রাজ্যবাদ ব্যবস্থাপনার জন্য, যুদ্ধের জন্য, ধ্বংসের জন্য। করোনাকালেও সে দেশের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দম্ভের সঙ্গে বলেন, ‘আমাদের সামরিক বাহিনী বিশ্বের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।’ তিনি বলতে পারেন না ‘আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা বিশ্বের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।’

তাই নিউইয়র্ক বিশ্বের প্রধান বাণিজ্যিক শহর হলেও সেখানে দারিদ্র্য কেন্দ্রীভূত, আর করোনায় তাদের মধ্যেই বেশি অকালমৃত্যু। যুক্তরাষ্ট্রে মাথাপিছু চিকিৎসা ব্যয় পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হলেও মুনাফামুখী ব্যক্তি ব্যবসা, বৃহৎ বিমা এবং ওষুধ কোম্পানিগুলোই তার বড় অংশ খেয়ে ফেলে। মার্কিন তথ্যচিত্রনির্মাতা মাইকেল মুরের তথ্যচিত্র সিকো এই পরিস্থিতি তুলে ধরেছে বিস্তৃতভাবে। ব্যবস্থাটাই এমন যে ব্যয় বিশাল হলেও সে দেশে কয়েক কোটি নাগরিকের চিকিৎসা-নিরাপত্তা নেই। চিকিৎসাব্যবস্থা, চিকিৎসা-গবেষণা কতিপয় গোষ্ঠীর মুনাফা বৃদ্ধির লক্ষ্য দ্বারা পরিচালিত। ফলে পৃথিবীকে ধ্বংস করার জন্য যাবতীয় অস্ত্র জোগান দেওয়া তাদের জন্য হাতের তুড়ি হলেও প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসামগ্রী, গবেষণা অপ্রতুল। ডাকাতি করে নিয়ে আসতে হয় চিকিৎসা সরঞ্জাম; ভেন্টিলেটর-আইসিইউ যথেষ্ট নেই, চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের অভাব। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনে সারা পৃথিবী ক্ষতবিক্ষত, একই প্রক্রিয়ায় যে সে দেশের নাগরিকেরাও বিপর্যস্ত, এটা আরও স্পষ্ট করেছে করোনা মহামারি।

বিপরীতে কিউবা ছয় দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাত্মক আগ্রাসন ও অবরোধের মধ্যে আছে। শক্তি-সামর্থ্য, অর্থনীতির আকার, সম্পদ—কোনো দিক থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কিউবার তুলনা হয় না। সম্পদের দিক থেকে বাংলাদেশের চেয়েও দুর্বল এই দেশ। অথচ এ রকম প্রবল চাপে থেকেও প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক চাহিদা পূরণ করছে রাষ্ট্র। দিয়েছে প্রয়োজনীয় খাবার, আশ্রয় এবং সর্বোত্তম চিকিৎসা। ফলে কিউবার নাগরিকেরা করোনা মহামারির প্রথম থেকেই নিরাপদ অবস্থানে আছে। তাদের খাদ্যের ও আশ্রয়ের সংকট নেই, স্বাস্থ্যসেবা খাত শক্তিশালী, তাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতাও অনেক বেশি। কিউবার সঙ্গে চীন ও ভিয়েতনামের তফাত হলো, শেষের দুই দেশে বেশ কিছু বাজারমুখী সংস্কার, ব্যক্তিমালিকানাকরণ হয়েছে। তাদের সর্বজন স্বাস্থ্যসেবা (পাবলিক হেলথ কেয়ার) ব্যবস্থা থাকলেও সব নাগরিকের জন্য কিউবার মতো খাদ্য ও চিকিৎসার নিশ্চিত ব্যবস্থা এখন আর নেই। তবে ভিয়েতনামে শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা থাকায় দেশটি করোনা মহামারি খুব দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার কারণে এশিয়ায় দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ান ভালো করেছে। করোনাসংকট মোকাবিলায় সাফল্যের জন্য ভারতের রাজ্য কেরালার নামও উল্লেখযোগ্য।

কিছু লোকের হাতে ক্ষমতা ও সম্পদের কেন্দ্রীভবন, মুনাফার সর্বোচ্চকরণ পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্য হলেও ইউরোপের বেশ কিছু দেশে সর্বজন শিক্ষা ও সর্বজন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা রয়েছে। এগুলো সম্ভব হয়েছে সেসব দেশের মানুষের সংগ্রাম ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার প্রভাবে। এই শর্ত দুর্বল হয়ে যাওয়ায় ১৯৮০-এর দশক থেকে যেসব দেশ স্বাস্থ্য ও শিক্ষার বাজারমুখী সংস্কারের দিকে গেছে, সেসব দেশে পরিস্থিতি জনবৈরী হয়েছে। যুক্তরাজ্যে করোনাকালে বিপর্যয় এর অন্যতম উদাহরণ। ইতালিও স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক ব্যয় হ্রাসের নেতিবাচক প্রভাবের শিকার হয়েছে।

করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক সংকট আরও স্পষ্টভাবে আমাদের জানাল যে স্বাস্থ্যসেবা কোনোভাবে বেচাকেনার বিষয় হতে পারে না, ব্যক্তিগত মুনাফার ক্ষেত্র হতে পারে না, স্বাস্থ্যসেবা প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার। রাষ্ট্রের দায়িত্ব সর্বজনের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। বাংলাদেশে চিকিৎসা খাতে জিডিপি অনেক বেড়েছে; কারণ, বাণিজ্যিক হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অনেক বিনিয়োগ হয়েছে। সেগুলোর জৌলুশ অনেক বেশি, খুবই ব্যয়বহুল, পাঁচ তারকা হোটেলের মতো থাকার ব্যবস্থাও আছে। কিন্তু যখন আমরা করোনায় বিপর্যস্ত, তখন এই বাণিজ্যিক হাসপাতালগুলোর অধিকাংশই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে; কারণ, এখানে লাভের বিষয়টি নিশ্চিত নয়।

যদি এ রকম পরিস্থিতি থাকত যে ঢাকা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত সর্বজন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা কাজ করছে, গ্রামপর্যায়েও পর্যাপ্তসংখ্যক চিকিৎসক-নার্স, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, চিকিৎসা সরঞ্জাম আছে, যদি চিকিৎসা-বিষয়ক গবেষণায় বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো যৌথভাবে এগিয়ে থাকত, তাহলে বাংলাদেশের মানুষ আজ অনেক নিরাপদ থাকতেন। এখন বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর হুমকির মুখে বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষকে থাকতে হতো না।

খেয়াল করতে হবে, যে উন্নয়নের ধারায় আমাদের বন শেষ হয়ে যায়, বায়ু-নদী দূষিত হয়, প্রাণ-প্রকৃতির বিনাশ হয়, সর্বজনের সম্পদের ওপর কতিপয় গোষ্ঠী দখল কায়েম করে, সম্পদ লুণ্ঠন ও পাচার অবাধ হয়, সম্পদের কেন্দ্রীভবন ও বৈষম্য বাড়ে, গণতন্ত্র বিপন্ন হয়, যে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় শিক্ষা, চিকিৎসা হয় ব্যবসার সামগ্রী, তা কখনোই মানুষের নিরাপদ জীবন ও প্রকৃত উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে না। করোনাকালে তাই উন্নয়ন দর্শনে মৌলিক পরিবর্তন আনার সামাজিক চৈতন্য জোরদার করতে হবে। নিছক জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং অন্ধ মুনাফামুখী তৎপরতা নয়, জনগণের জীবন, গণতান্ত্রিক অধিকার ও নিরাপত্তাকেই উন্নয়নের প্রধান শর্ত হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।

এ জন্য জরুরি ভিত্তিতে যেসব কাজ শুরু করা অত্যাবশ্যক সেগুলো হলো:

১. সুন্দরবনসহ প্রাণ-প্রকৃতিবিনাশী সব কয়লাভিত্তিক এবং পারমাণবিক প্রকল্প অবিলম্বে বন্ধ করে পরিবেশবান্ধব, সুলভ, স্বনির্ভর পথে বিদ্যুৎ উৎপাদন। অপ্রয়োজনীয় ক্ষতিকর প্রকল্প বাতিল করে তার জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ জরুরি ত্রাণ, চিকিৎসা ও জাতীয় সক্ষমতা বিকাশে ব্যয়। ২. দেশের পুরো স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে ব্যক্তি খাতের ব্যবসার মুনাফামুখী অন্ধত্ব থেকে মুক্ত করে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত অভিন্ন রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নির্মাণ। ৩. কৃষি খাত এবং পাটসহ পরিবেশবান্ধব শিল্প খাতের প্রতি প্রধান গুরুত্ব প্রদান। এবং ৪. সব নাগরিকের জন্য সামাজিক নিরাপত্তাবলয় নিশ্চিত করা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ।

আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সর্বজনকথা পত্রিকার সম্পাদক
[email protected]