করোনাকালে জনপ্রতিনিধিদের সন্ধানে

করোনা সংকটের কারণে ভারতের জনপ্রতিনিধিদের নির্ধারিত বেতন-ভাতা থেকে আগামী এক বছরের জন্য ৩০ শতাংশ হারে কেটে নেওয়া হবে বলে দেশটির সরকার একটি অধ্যাদেশ জারি করেছে। এই জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে আছেন রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য, স্পিকার, লোকসভা ও রাজ্যসভার সদস্য। ভারতের সাংসদেরা মাসে এক লাখ রুপি বেতন ও ৭০ হাজার রুপি ভাতা পেয়ে থাকেন। জনপ্রতিনিধিদের বেতন-ভাতা যে ৩০ শতাংশ কমানো হলো, তা ব্যবহার করা হবে করোনা-আক্রান্ত ব্যক্তিদের সহায়তায়। 

বাংলাদেশেও সাংসদেরা বেতন-ভাতা সব মিলিয়ে ১ লাখ ৭১ হাজার টাকার মতো পান। আমাদের মন্ত্রী-সাংসদেরা কথায় কথায় ভারতের উদাহরণ দেন। কিন্তু করোনা আক্রান্ত মানুষের সহায়তায় আমাদের জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে এ রকম কোনো ঘোষণা আসেনি। 

পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ স্পিকারের নেতৃত্বে করোনাসংক্রান্ত সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটি ত্রাণ কার্যক্রম তদারকির জন্য ১১ দফা নীতিমালা তৈরি করেছে। তারা মনে করে, সরকারের দেওয়া ত্রাণসামগ্রী ও নগদ অর্থ বিতরণে যাতে কোনো অনিয়ম না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে এই নীতিমালা। 

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ এ রকম কোনো উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা যায়নি। যদিও এক দিন নিয়ম রক্ষার অধিবেশন বসেছিল। করোনা সংকটে কাজ হারানো গরিব মানুষকে নগদ টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত পাকিস্তান নেয় শুরুতেই। আমরা নিয়েছি মাত্র কদিন আগে। করোনা সংকট শুরু হওয়ার পর সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ভিডিও ও টেলিকনফারেন্স করেছে। কিন্তু ত্রাণসামগ্রী বিতরণে অনেক অনিয়ম, দুর্নীতি হওয়ার পরও সংসদীয় কমিটি বসার প্রয়োজন বোধ করেনি। 

জাতীয় সংসদের ৩৫০ জন সদস্যই আমাদের একমাত্র জনপ্রতিনিধি নন। এর বাইরে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন সংস্থায় ৬০ হাজারের বেশি জনপ্রতিনিধি আছেন এবং জনগণের করের অর্থেই তাঁদের বেতন-ভাতা হয়। করোনা দুর্যোগে তাঁদের অনেককেই বিপন্ন মানুষের পাশে পাওয়া যায়নি। 

 স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, এই দুর্যোগের সময়ে জনপ্রতিনিধিদের সক্রিয় ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না কেন? তিনি বলেন, সরকারের ক্ষমতাকাঠামোটাই এমন যে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের খুব বেশি ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই। অন্যদিকে জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ববোধেরও ঘাটতি আছে। বাংলাদেশে আরেকটি সমস্যা হলো জাতীয় সংসদে যাঁরা নির্বাচিত হয়ে আসেন, তাঁদের বেশির ভাগ ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা। করোনা সংকট শুরুর সময় যাঁরা ঢাকায় ছিলেন, তাঁদের পক্ষে এলাকায় যাওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে এলাকার মানুষ তাঁদের দেখা পাননি। 

বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি জনপ্রতিনিধি ইউনিয়ন পরিষদে। মোট ৪ হাজার ৫৭৩টি ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিটিতে চেয়ারম্যানসহ ১৩ জন করে সদস্য আছেন। এর সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৯ হাজার ৪৪৯। উপজেলার সংখ্যা ৪৯২, যার প্রতিটিতে একজন নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও দুজন ভাইস চেয়ারম্যান থাকেন। এ ছাড়া ৬৪টি জেলা পরিষদ, ৩২৯টি পৌরসভা ও ১১টি সিটি করপোরেশনও পরিচালিত হচ্ছে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে। 

বিস্ময়কর ঘটনা হলো করোনা সংকটকালে দেশের প্রধান তিনটি সিটি করপোরেশনের কার্যত ‘মেয়রশূন্য’ পরিস্থিতি। ঢাকা উত্তরের মেয়র দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন গতকাল বুধবার আর ঢাকা দক্ষিণের মেয়র দায়িত্ব নেবেন ১৭ মে। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি শপথ নিলেও আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে দায়িত্ব নিতে পারেননি। ঢাকা দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে বিদায়ী দুই মেয়র নতুন নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পাননি, এই দুর্যোগ মোকাবিলায় তাঁদের সক্রিয় দেখা যায়নি। চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচন শেষ মুহূর্তে স্থগিত করা হয়েছে করোনার কারণে। 

করোনা সংকট শুরু হওয়ার পরই বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছিল জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা নিয়ে। কয়েকটি জায়গায় বিক্ষোভও হয়েছে। বেশির ভাগই সক্রিয় নন অথবা ঢাকায় স্বেচ্ছাবন্দী। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গুলজারিলাল নন্দ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন শেষে দিল্লি ছেড়ে তাঁর নিজের বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন। কেননা দিল্লিতে তাঁর থাকার কোনো জায়গা ছিল না। আর আমাদের দেশে উপজেলা পরিষদ কিংবা ছোট পৌরসভার প্রধানেরাও স্থায়ীভাবে ঢাকায় থাকেন। অস্থায়ীভাবে নির্বাচনী এলাকায় যান। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর সেটিরও আর প্রয়োজন হচ্ছে না। 

একটি পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন দল থেকে নির্বাচিত অনেক সাংসদকে তাঁদের নির্বাচনী এলাকার জনসাধারণ এই সংকটের সময় পাশে পাচ্ছেন না। কিছু সাংসদের উদ্যোগ থাকলেও তা চোখে পড়ার মতো নয়। এসব নিয়ে সাধারণ মানুষের বিক্ষোভের ঘটনাও ঘটছে। রংপুর-৩ আসনের সাংসদ সাদ এরশাদের বাসভবন ঘেরাও করে রেখেছিলেন ত্রাণপ্রত্যাশীরা। তাঁরা রংপুর মহানগরীর দর্শনা এলাকায় পল্লী নিবাস ভবনের সামনের মহাসড়ক অবরোধ করেন। রংপুর মহানগরের অনেকেই একাধিক ফেসবুক গ্রুপে ‘একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি’ শিরোনামে সাদ এরশাদের খোঁজ চেয়েছেন। (কালের কণ্ঠ, ১৬ এপ্রিল ২০২০) 

এ বিষয়ে সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম। তিনি বলেন, দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন করে স্থানীয় সরকারকে আরও অকার্যকর ও দুর্নীতিগ্রস্ত করা হয়েছে। এর জনপ্রতিনিধিরা আর জনগণের কাছে দায়বদ্ধ নন। দায়বদ্ধ দলের কাছে। বেশির ভাগ নির্বাচিত প্রতিনিধি যোগ্যতা বা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আসেননি। এসেছেন দল ও প্রশাসনের আনুকূল্যে। ফলে নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানগুলো গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে। 

প্রথম আলোতে কয়েক দিন আগে লেখক-গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছিলেন, ‘এমপি সাহেবরা কি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেছেন’। শুধু এমপি সাহেবেরা নন, স্থানীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের বড় অংশও ভূতলবাসী হয়েছেন। তবে ব্যতিক্রম আছে, সাংসদ ও জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে কেউ কেউ এলাকায় গিয়ে সাধ্যমতো ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেছেন। অনেক প্রবীণ সাংসদ এলাকায় না যেতে পারলেও স্থানীয় নেতা-কর্মীদের মাধ্যমে ত্রাণসামগ্রী বিতরণের ব্যবস্থা করেছেন। 

 এই সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় জনপ্রতিনিধিদের পাশাপাশি আরেক শ্রেণির প্রতিনিধি আছেন, যাঁরা গরিবের চাল-তেল চুরিতে ব্যস্ত। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, করোনা দুর্যোগের সময় অভাবী মানুষের চাল আত্মসাৎসহ বিভিন্ন অপরাধে ৫০ জনপ্রতিনিধিকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এঁদের ৩৫ জনই আওয়ামী লীগ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। পাঁচজন ছাড়া অন্য কারও বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। (প্রথম আলো, ১২ মে ২০২০) 

 সিলেট অঞ্চলের একজন সাংসদের বিরুদ্ধে ত্রাণসামগ্রী বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ আনায় তিনি ছাত্রলীগের তিন নেতার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। তাঁদের মধ্যে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুরান ঢাকায় ত্রাণসামগ্রীর দাবিতে মিছিল করার কারণে সরকার সমর্থক শ্রমিক লীগের এক নেতাকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। 

 ত্রাণসামগ্রীর দাবিতে ওএমএস ও ত্রাণের চাল চুরির ঘটনায় খাদ্য মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি ১৭ এপ্রিল প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এতে বলা হয়, তালিকা তৈরিতে স্বচ্ছতা, ওজনে কম দেওয়া, তালিকা অনুযায়ী বিতরণ না করার মতো অনিয়ম পাওয়া গেছে। 

 উপজেলা পর্যায়ের খাদ্যসহায়তা কমিটির উপদেষ্টা হলেন সাংসদেরা। এ ছাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যানও সম্পৃক্ত আছেন। ইউনিয়ন পর্যায়ে ইউপি চেয়ারম্যানরা কমিটির সভাপতি। সঙ্গে থাকেন ইউপি সদস্যরা। ফলে ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম-দুর্নীতি হলে তার দায় কেউ এড়াতে পারেন না। 

 কমিটির প্রধান ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মজিবর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘আমাদের মনে হয়েছে, যাঁদের সরাসরি তদারক করার কথা ছিল, তাঁরা হয়তো করোনার কারণে তদারক করেননি, সশরীরে থাকেননি, তালিকার লোক চাল পেল কি না, কারা পেল, চাল কোথায় গেল, তাঁরা এসব কিছুই দেখেননি বা তদারক করেননি।’ 

এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে সরকারের বরাদ্দের চুরি হওয়া ২ হাজার ১৭৪ বস্তা চাল উদ্ধার হয়েছে। প্রতি বস্তায় ৫০ কেজি করে চাল থাকে। আওয়ামী লীগ নেতা ও চেয়ারম্যান-মেম্বারসহ গ্রেপ্তার হয়েছেন ২৮ জন। এই প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী ৬৪ জেলার ত্রাণ কার্যক্রম তদারকির দায়িত্ব দিয়েছেন ৬৪ জন সচিবকে। এতে মনে হয়, সরকারপ্রধানও সাংসদদের ওপর ভরসা করতে পারছেন না। 

আমাদের দেশে জনপ্রতিনিধিরা জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছেন, এ রকম নজির কম। তবে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে তাঁরা এলে একধরনের ভয় ও জবাবদিহির মধ্যে থাকেন। সম্প্রতি যেসব নির্বাচন হয়েছে, তাতে প্রার্থী বা ভোটার কারও তেমন ভূমিকা ছিল না। সরকারি কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাই ছিলেন মূল ভূমিকায়। ফলে একটি নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানে জনগণের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের যে মানসিক ও আত্মিক বন্ধন থাকে, সেটি অনুপস্থিত। সব ক্ষেত্রে না হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটা সত্য। করোনা সংকট সেই অপ্রিয় সত্যই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। 

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]