হাফেজদের সাহায্যে কিছু করা হবে না?

মহামারি করোনা ঠেকাতে এবার মসজিদে খতম তারাবিহ বন্ধ আছে। যদিও ৭ মে দুপুর থেকে মসজিদ উন্মুক্ত করে দেওয়ার ঘোষণা এসেছে। সে ক্ষেত্রে করোনা প্রতিরোধের সব নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে। করোনার ভয়ে তারাবিহর নামাজে মসজিদে মুসল্লির সমাগম খুব একটা হবে না এটাই স্বাভাবিক। এর ফলে হাফেজদের বেকারই থাকতে হচ্ছে। কোনো ধরনের প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায়ও পড়ছেন না তাঁরা। আবার কোরআনের হাফেজ হওয়ায় কারও কাছে লজ্জায় হাত পাততেও পারছে না। তাই পরিবার-পরিজন নিয়ে অনেকেই চবরম বিপদে পড়েছেন। এমতাবস্থায় হাফেজদের জন্য একটি বিশেষ আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করা উচিত।

রমজান মাসে হাফেজরা মসজিদে খতম তারাবিহ পড়ান এবং এর জন্য খুব সামান্যই বেতন পেয়ে থাকেন। বড়জোর ১০,২০, ৩০ হাজার টাকা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও কম, তা-ও আবার শুধুই রমজান মাসের জন্য। সেই টাকা আবার আয় হয় মুসল্লিদের কাছ থেকে। মুসল্লিরা ১০-২০ টাকা ছোট কাঠের বাক্সে রাখেন। মাস শেষে ২৭ রমজান অর্থাৎ লাইলাতুল কদরের রাতে আখেরি মোনাজাতের পর হাফেজ সাহেবদের ওই টাকা দেওয়া হয়। যদিও ইসলামের দৃষ্টিতে কোরআন খতমের বিনিময়ে টাকা নেওয়ার বিধান নেই। কিন্তু তাঁদেরও আছে সংসার, পরিবার, পরিজন। যা হোক, নামাজ শেষে মুসল্লিরা হাফেজদের ধরে কোলাকুলি ও ভবিষ্যতের জন্য দোয়া কামনা করেন। হাফেজরা ভবিষ্যতের জন্য দোয়া করেন এবং ওই সামান্য কয়েকটি টাকা নিয়ে খুশিতে বিদায় নেন। কিন্তু এবার সেই সুযোগটুকুও নেই। তাহলে ঈদের সময় কী তুলে দেবেন তাঁদের সন্তান ও পরিবারের হাতে?

এ দেশের অধিকাংশ হাফেজই অত্যন্ত গরিব পরিবার থেকে আসা। দরিদ্র পিতা-মাতার যখন সন্তানদের সামান্য ভর্তি ও বেতনের টাকা দিয়ে নিজ এলাকার স্কুলে পড়ানোর সামর্থ্য থাকে না, তখনই দূরের কোথাও বিনা মূল্যের মাদ্রাসায় পাঠিয়ে দেন। নিষ্পাপ শিশুগুলো মা-বাবার আদরবঞ্চিত হয়ে দূরের ওই মাদ্রাসায় পড়ে থাকে। হাফেজ হওয়ার এ প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হতে সাধারণত ৩ থেকে ৬ বছর লাগে। কোরআন মুখস্থের সঙ্গে সঙ্গে সঠিক উচ্চারণরীতিও শেখানো হয়। এই কয়েকটি বছর তারা খুবই মানবেতর জীবন যাপন করে কাটায়। যেমন নিম্নমানের খাবার, গাদাগাদি করে থাকা ইত্যাদি।

এভাবে অনেকটা মা-বাবার অজান্তেই কেউ হয়ে ওঠেন কোরআনের হাফেজ, কেউ হয়ে ওঠেন যুক্তিবাদী মাওলানা। এরপরই এঁরা গ্রাম-গঞ্জে ও শহরে ছড়িয়ে পড়েন কাজের সন্ধানে। আর কাজ মানেই মসজিদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া। অর্থাৎ সামান্য বেতনে ইমাম অথবা মুয়াজ্জিন হওয়া। অনেকে এটুকুও জোগাড় করতে না পারলে মানুষের বাসায় গিয়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের আরবি এবং ইসলামি শিক্ষা তথা নামাজ-কালাম, দোয়া-দরুদ, আদব-কায়দা প্রভৃতি শেখানোর কাজটি করে থাকেন। এই কাজটির পারিশ্রমিক আরও করুণ। সাধারণ শিক্ষা কিংবা নাচ ও গানের শিক্ষকের পারিশ্রমিকের চার ভাগের-এক ভাগেরও কম।

হাফেজরাও এখন দেশের উন্নয়নে অনেক ভূমিকা রাখছেন। গণতান্ত্রিক ধারায় এখন অনেক কোরআনের হাফেজ ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার, চেয়ারম্যান ও বিভিন্ন সংগঠনের সদস্য হয়ে গ্রাম উন্নয়নে ভূমিকা রাখছেন। গ্রামের লোকেরা সামাজিক ও পারিবারিক সমস্যা সমাধানের জন্য অনেক সময় হাফেজ এবং ইমামদের শরণাপন্ন হয়ে থাকেন। মৃত্যুবার্ষিকী কিংবা অন্য কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে প্রায়ই কোরআন খতমের আয়োজন করা হয় এই হাফেজদের মাধ্যমেই। মসজিদভিত্তিক প্রাথমিক শিক্ষায়ও এঁদের ভূমিকা অনেক। সাধারণত এঁরা খুব মেধাবী হন। অত্যন্ত অল্প বয়সে পুরো কোরআন শরিফ মুখস্থ করে ফেলেন। বিদেশেও তাঁদের অনেক সুনাম আছে। আন্তর্জাতিক কিরাত প্রতিযোগিতায় বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের খুদে হাফেজরা শীর্ষস্থান অধিকার করে আসছে। অনেকেই বৃত্তি নিয়ে মক্কা, মদিনা, মিসরসহ আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রিও অর্জন করছেন। প্রতিবছর রমজান মাসে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে খুদে হাফেজদের কোরআন প্রতিযোগিতা দেখে সবাই মুগ্ধ হয়। দৈব চয়নের মাধ্যম কোরআন শরিফের মধ্য থেকে ছোট্ট একটি আয়াত পড়ে থাকেন মডারেটর। নিষ্পাপ ওই খুদে হাফেজ সেটা শুনেই সুরেলা কণ্ঠে তিলাওয়াত শুরু করে। টিভির সামনে বসা সারা বিশ্বের অগণিত রোজাদার তা শোনেন, দেখেন এবং চোখের পানি ফেলতে ফেলতে দুই হাত তুলে খুদে হাফেজদের জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করেন।

আরবি ‘হাফিজ’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ রক্ষক। তবে হাফিজ বলতে বোঝানো হয় যাঁর পুরো কোরআন ৩০ পাড়া মুখস্থ আছে। মুসলমান সমাজে হাফেজরা খুবই সম্মানিত হলেও তাঁদের জন্য আমাদের সমাজে স্থায়ীভাবে কাজ বা চাকরির তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই এই হাফেজদের রমজান উপলক্ষে কিছুটা সম্মান করা উচিত। এমতাবস্থায় পবিত্র ঈদের আগেই হাফেজরা এ ধরনের একটি আর্থিক সুযোগ পেলে খুবই উপকৃত এবং কৃতার্থ হবেন।

অধ্যাপক ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার: পরিচালক (আইআইটি) এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।