বাংলাদেশ কি হার্ড ইমিউনিটির পথে

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা সবাই কমবেশি বিভ্রান্ত। একদিকে নিরাপদে বাসায় না থাকলে সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে, অন্যদিকে বাসায় থাকলেও দারিদ্র্যের জন্য এই ঝুঁকিগুলো কমবেশি রয়ে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের হিসাবমতে, দৈনিক ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি দুই মাস ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে নিতে হয়েছে। স্বাস্থ্য খাত, শিক্ষা খাত, শিল্প খাতসহ বাংলাদেশের আর্থসামাজিক খাতগুলোও আজ সংক্রমিত এবং বিপর্যস্ত। এরই ধারাবাহিকতায় চলমান লকডাউন শিথিল কিংবা তুলে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলেই মনে হয়।

১০ মে দেশব্যাপী দোকানপাটসহ মার্কেট সীমিত আকারে খুলে দেওয়া হয়েছে। ওই দিনই ঢাকাসহ সারা দেশের রাস্তাঘাট এবং মার্কেটগুলোতে উপচে পড়া ভিড় পরিলক্ষিত হয়েছে। বাংলাদেশ ধীরে ধীরে স্বরূপে প্রত্যাবর্তন করছে। বাইরে প্রচুর জনসমাগম। আবার ওই একই সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। সংক্রমণ এবং মৃত্যু সামনের দিনগুলোতে বাড়তে থাকবে—এমন আশঙ্কাই বেশি। কারণ, লকডাউন শিথিল কিংবা তুলে নেওয়ার এই প্রক্রিয়া থেকে সরে আসার কোনো ইঙ্গিত নেই।

বাংলাদেশের বর্তমান স্বাস্থ্য খাত মূলত নন–কমিউনিকেবল বা অসংক্রামক ব্যাধির ওপরেই বিশেষভাবে গড়ে উঠেছে। গত ১২ বছরে বাংলাদেশে যেসব রোগের কারণে মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি ছিল, তার প্রথম ১০টিই হলো অসংক্রামক ব্যাধি। যেগুলোকে লাইফস্টাইল বা জীবনযাপনের সঙ্গে সম্পর্কিত রোগও বলা হয়। যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদ্‌রোগ, ফুসফুস ও কিডনিজনিত রোগ, স্থূলতা বা অপুষ্টিসহ আরও অনেক। কোভিড-১৯–এর সংক্রমণ বাংলাদেশের জন্য তাই একটি নতুন বাস্তবতা ও অভিজ্ঞতা। কারণ, এর আগে ইবোলা, মার্স এবং সার্স বাংলাদেশে বিস্তার করেনি। বিদ্যমান স্বাস্থ্য খাত এবং ভাইরাসটির ব্যতিক্রমী শক্তি, প্রতিরোধের পুরো প্রক্রিয়াটিকে টালমাটাল করে দিয়েছে।

একদিকে অর্থনীতি আর অন্যদিকে ভাইরাসটির দাপট বাংলাদেশকে একটি নতুন আবর্তনের ভেতর দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সার্বিক পরিস্থিতি মূল্যায়নে, বাংলাদেশ হার্ড ইমিউনিটির দিকেই যাচ্ছে বলে মনে হয়। হার্ড ইমিউনিটি বলতে সাধারণভাবে বোঝায়, একটি অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী (৭০ থেকে ৯০ শতাংশ) যখন একটি সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী হয়, সেই পরিস্থিতিকে বোঝানো হয়। মূলত সংক্রমণ, সংক্রমণ থেকে সুস্থ হওয়া এবং টিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে হার্ড ইমিউনিটিতে পৌঁছানো যায়। সে ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ইমিউনিটির ব্যক্তিদের মধ্যে সংক্রামক ব্যাধিটির ছড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। কারণ, সংক্রমিত করার কোনো ক্যারিয়ার কিংবা বাহক তখন আর থাকে না। কিন্তু এই হার্ড ইমিউনিটি অর্জন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। আইসিডিডিআরবির ইমিউনোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ফেরদৌসী কাদরীর বক্তব্য অনুযায়ী, হার্ড ইমিউনিটি খুব সহজে ডেভেলপ করে না, এর জন্য দুই বছরের বেশি সময় লাগতে পারে।

বাংলাদেশের জন্য বিষয়টি আরও জটিল। দীর্ঘদিন লকডাউনে অভ্যস্ত জনগোষ্ঠী, অপুষ্টি এবং অন্যান্য রোগের কারণে লকডাউন–পরবর্তী এই সময়ে করোনা সংক্রমণ ও অন্যান্য সংক্রমণে মৃত্যুঝুঁকি বেশি থাকবে। সে ক্ষেত্রে আক্রান্তদের টেস্ট এবং চিকিৎসায় হাসপাতালগুলোর বিদ্যমান অপর্যাপ্ত সক্ষমতা আরও হ্রাস পাবে। সবচেয়ে বড় বিষয়, কোভিড-১৯ ভাইরাসটি হার্ড ইমিউনিটির জন্য কীভাবে কাজ করবে, কত সময় নেবে, পুনরায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কতটুকু, আরও অনেক বিষয় এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান পরিস্থিতিতে, রেকর্ডসংখ্যক করোনা সংক্রমণের পরও এই রোগ প্রতিরোধের খুব কাছাকাছি হওয়ার যথেষ্ট ঘটনা ঘটেনি। এখন পর্যন্ত সেখানে সংক্রমণ ও মৃত্যুহার বেশি।

লকডাউনে না গিয়ে হার্ড ইমিউনিটি কিংবা জনগণকে স্বেচ্ছায় করোনা প্রতিরোধে সংক্রমিত হওয়ার পদ্ধতি অবলম্বন করেছিল সুইডেন। যার চড়া মূল্য দিতে হয়েছে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান এই দেশটিকে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই রাজধানী স্টকহোম হার্ড ইমিউনিটিতে পৌঁছাবে—দেশটির তরফে এমন দাবি করা হলেও তার প্রতিফলন এখনো দেখা যায়নি। বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ থেকে সুস্থ হওয়ার হার তুলনামূলক কম। টেস্টের সংখ্যা বাড়লেও তা এখন পর্যন্ত পর্যাপ্ত নয়। সুতরাং মোট আক্রান্তের সঠিক সংখ্যা জানা যাচ্ছে না। পাশাপাশি অপ্রস্তুত স্বাস্থ্য খাতসহ অন্য অনেক বিষয় বাংলাদেশের জন্য হার্ড ইমিউনিটিকে নিঃসন্দেহে কঠিন করে তুলবে। সত্যি বলতে কোভিড-১৯–এর টিকা ছাড়া বাংলাদেশের জন্য সার্বিক করোনা প্রতিরোধ দুঃসাধ্য। হার্ড ইমিউনিটি বাংলাদেশের জন্য গ্রহণযোগ্য ধারণা নয়। দেশব্যাপী এখনো যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা এই ধারণাকে আরও শক্তিশালী করে।

সুতরাং বর্তমান পরিস্থিতিতে সংক্রমণ প্রতিরোধের পাশাপাশি আরও কয়েকটি বিষয় নজর দেওয়া দরকার। টেস্টের সংখ্যা বাড়ানো এবং চিকিৎসা নিশ্চিত করা। প্রয়োজনে অ্যান্টিবডি টেস্ট শুরু করা যেতে পারে। হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথের এপিডেমিওলজির অধ্যাপক ক্যারোলিন বাকি বলেন, অ্যান্টিবডি টেস্টের মাধ্যমে জনগণের কোন অংশ সংক্রমিত এবং কোন অংশ ইতিমধ্যে ইমিউনিটি লাভ করেছে, তা নির্ণয় করা যাবে। ক্যালিফোর্নিয়া ও নিউইয়র্কে ব্যাপকভাবে অ্যান্টিবডি টেস্ট শুরু হয়েছে। দ্বিতীয়ত, পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ এবং শিশুদের আরও কয়েক মাস অবশ্যই ঘরে নিরাপদে থাকতে হবে। এবং দুই মাস ধরে মেনে চলা স্বাস্থ্যবিধিগুলোকে জীবনের অংশ মনে করা এবং চর্চায় রাখতে হবে। তাহলেই হয়তো অনেক কম মূল্যে আমরা সার্বিক ইমিউনিটি কিংবা হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করতে পারব।

ড. মো. তাজউদ্দিন সিকদার: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের সভাপতি এবং সহযোগী অধ্যাপক