সব হাসপাতালেই কোভিডের চিকিৎসাই সমাধান

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

আলাদা করে কোভিড হাসপাতাল ধারণার যুক্তিগ্রাহ্যতা কখনোই ছিল না এবং এগুলো চালিয়ে যাওয়ার যুক্তিগুলো আবার ভেবে দেখার সময় এসেছে। আলাদা করে করোনাভাইরাস হাসপাতাল খুলে যা হয়েছে, তাতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য অসাধারণ একটা চিকিৎসার আয়োজন করা হয়েছে তা তো নয়ই, বরং দেশের সাধারণ স্বাস্থ্যব্যবস্থাটাই অনেকটা তালগোল পাকিয়ে ফেলা হয়েছে।

সম্প্রতি সরকারের একজন অতিরিক্ত সচিবসহ অনেকগুলো মৃত্যু জনমনে ব্যাপক প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। যারা কোভিড আক্রন্ত নয়, তাদের জন্য জরুরি চিকিৎসার কী ব্যবস্থা আছে এই সময়ে? যে অতিরিক্ত সচিবের কথা বললাম, তাঁর মূল উপসর্গ ছিল শ্বাসকষ্ট। তাঁর চিকিৎসক মেয়ে ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন, বাবার লক্ষণগুলো উচ্চরক্তচাপজনিত কারণে ফুসফুসে পানি আসার জন্য হয়েছে। তারপরও রাতজুড়ে আটটা হাসপাতাল ঘুরেও বাবাকে কোথাও ভর্তি করাতে পারেননি।

প্রথমেই শুরু করি এই সাধারণ উপসর্গটা দিয়ে: শ্বাসকষ্ট। শ্বাসকষ্ট কেন হয়? এমন কোনো জরুরি গুরুতর মেডিকেল বা সার্জিক্যাল পরিস্থিতি নেই যার উপসর্গ শ্বাসকষ্ট না! কারও হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে, এর উপসর্গ শ্বাসকষ্ট। হার্ট ফেইলিউর রোগীর উপসর্গ শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা রোগীর উপসর্গ শ্বাসকষ্ট। সিওপিডি, নিউমোনিয়া, কিডনি, ফুসফুসের বা হার্টের যেকোনো রোগ—সবকিছুরই উপসর্গ শ্বাসকষ্ট হতে পারে।

এখন দেশে যা হচ্ছে, তা হলো শ্বাসকষ্ট নিয়ে কোনো রোগী কোনো হাসপাতালে গেলে, তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, ‘এখানে না এখানে না, কোভিড হাসপাতালে যান।’ কোভিড হাসপাতালের নাম শুনেই রোগীর হৃদয় হিম হয়ে যাচ্ছে। রোগী আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে, রোগীর পরিবার প্যানিকড হয়ে যাচ্ছে। রাতবিরাতে সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে রোগী ছুটে চলছে কোভিড হাসপাতালের পথে। কোভিড হাসপাতালের চিকিৎসক রোগী দেখে বলে, ‘আরে, এত কোভিড না, অন্য হাসপাতালে নিয়ে যান রোগীকে। টেস্ট করে নিয়ে আসেন!’ রোগী মাঝ রাতে টেস্ট কই পাবে? রোগী আবার ছুটে চলে আরেক হাসপাতালের দিকে। সেখানেও একই কথা, আমরা শ্বাসকষ্টের রোগী ভর্তি করি না। জলের মাছ ডাঙায় ফেললে অক্সিজেনের জন্য যেভাবে দাপায়, এই রোগীও এভাবেই একটু বাতাসের জন্য দাপাতে দাপাতে শহরময় ছুটতে থাকে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে। কিন্তু এটা তো কোভিডকাল। রোগীর বুকের পাঁজর হাঁপরের মতো উঠতে নামতে থাকে, নীল হয়ে যায় হাত–মুখ, কোথাও চিকিৎসা নেই! এটা করোনাকাল! হায় হায়, শ্বাসকষ্টের রোগী!

নগরবাসী শেষ রাতে উঠে সাহরি করে, ফজরের আজান আর সুবহে সাদিকের আভা অন্ধকার রাতের বিদায় বার্তা নিয়ে আসে। সিএনজির ইঞ্জিন গর্জে চলে পথ থেকে পথে। কিন্তু রোগীর বুকের পাঁজর আর হাঁপরের মতো ওঠানামা করছে না, বিশ্রান্ত হয়ে থেমে গেছে বুকের ওঠানামা—কোনো এক সময়, হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল ছোটার পথে!

আমরা যখন প্রথম চীন থেকে আসা রিপোর্টগুলো পড়লাম, তখন জানলাম যে কোভিড রোগীর ৯০ শতাংশের বেশি জনের জ্বর থাকবে, ৮০ শতাংশের ওপর রোগীর শুকনো কাশি থাকবে। আর থাকবে গায়ে ব্যথা, দুর্বলতা ইত্যাদি থাকবে অধিকাংশ রোগীর! আর রোগী গুরুতর হয়ে গেলে শ্বাসকষ্ট হবে।

এখন সেই ধারণা থেকে আমরা সরে আসছি। সম্প্রতি নিউইয়র্ক থেকে পাওয়া কিছু রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, মাত্র এক–চতুর্থাংশ মানুষের জ্বর হচ্ছে। মানুষ অনেক নুতন উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হচ্ছে। ডায়রিয়া, পেটেব্যথা, বমি ভাব, বুকব্যথা, মাথাব্যথা, পিঠব্যথা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিচ্ছে কোভিডের কারণে।

একজন রোগী পেটব্যথা নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হলো। দশ–বারোজন নার্স ওয়ার্ড বয় আর চিকিৎসক রোগীকে দেখলেন আর করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে গেলেন! বুকে ব্যথা নিয়ে কেউ হার্ট ইনস্টিটিউটে গেলেন। দুদিন পর জ্বর আসার পর কোনো এক চৌকস চিকিৎসক সন্দেহ করলেন এবং চেক করে কোভিড পজিটিভ পেলেন। শিশু হাসপাতালে ডায়রিয়া নিয়ে এক বালক ভর্তি হলো। এই করোনাকালে চিকিৎসক বা অন্যান্য সেবাদানকারীরা কী করবেন? রোগীটিকে ভর্তি করবেন নাকি পাঠিয়ে দেবেন কোভিড হাসপাতালে?

করোনাভাইরাসের কারণে আজ বেশ কিছু রোগীর স্ট্রোক হচ্ছে বা স্ট্রোক ধরনের উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। এরা তো স্ট্রোক সিম্পটম নিয়ে স্ট্রোক হাসপাতালে যাবে। এই সময়ে দেশের নিউরোলজিসহ বিশেষায়িত হাসপাতালসহ অন্য সব হাসপাতালের পলিসিই হওয়া উচিত একটা বড় অংশ রোগীকে প্রথম থেকেই করোনাভাইরাসে সংক্রমিত সন্দেহ করে নেগেটিভ প্রমাণ করা। এবং নেগেটিভ না আসা পর্যন্ত রোগীকে কোভিড রোগী হিসেবে আইসোলেশন রাখা।

রোগী হাসপাতালে চলেই এসেছে, ভর্তি আছে, তার টেস্ট পজিটিভ এসেছে, তাকে এখন যদি কোভিড হাসপাতালে পাঠাতে হয়; তাহলে ট্রান্সপোর্ট সিস্টেমসহ আমরা আরেক সেট চিকিৎসক-নার্সকে সংক্রমণের ঝুঁকিতে ফেলছি। আর কোভিড হাসপাতালে বেড খালি নাও থাকতে পারে! তখন এই রোগী কই যাবে?

এখন আমরা কোভিড আর নন–কোভিড হাসপাতালের বিভাজন করতে গিয়ে একটা বেকায়দায় পড়ে যাচ্ছি। আর এই প্যাঁচে পড়ে শুধু সাধারণ মানুষেরাই ভুগছে না, দেশের চিকিৎসক-নার্সদেরও ঝুঁকিতে ফেলছি! এটা কোভিড হাসপাতাল না, এমন এক আনুমানিক নিরাপত্তার ধারণা তৈরি করে আর যথেষ্ট পরিমাণ পিপিই নিশ্চিত না করে, অনিশ্চয়তা আর বিশ্বাসহীনতার একটা পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। এর শিকার কোভিড ও নন–কোভিড রোগীরা তো বটেই, তবে নার্স আর চিকিৎসক সমাজও এর শিকার!

কোভিড হাসপাতালগুলোর কথা নাই–বা বললাম। নামে কোভিড হাতপাতাল, অথচ এখনো এদের বেশ কয়টিতে অনেক জরুরি রক্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। সিটি স্ক্যানার বা এমনকি পোর্টেবল এক্স–রের ব্যবস্থা নেই অনেকখানে। পর্যাপ্ত অক্সিজেন নেই, রোগীর তুলনায় বেড অপ্রতুল। যাদের কোনো সিম্পটম নেই, শুধু কোভিড পজিটিভ বিধায় হাসপাতালে ভর্তি করে রাখা হয়েছে।

কোভিড হাসপাতাল আর কোভিড আইসোলেশন সেন্টার মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। কাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হবে আর কাকে পজিটিভ সত্ত্বেও নিজ বাড়িতে আইসোলেশনে থাকতে বলা হবে, সে ব্যাপারে কোনো পরিষ্কার নির্দেশনা রয়েছে কি? যদি লক্ষণ ও গুরুত্বনির্বিশেষে সব কোভিড পজিটিভ রোগীকে ভর্তি করে কোভিড হাসপাতালের বেড ভরিয়ে ফেলেন, তাহলে তো পরে যার প্রয়োজন সে জায়গা পাবে না! যদি কোভিডের উপসর্গবিহীন পজিটিভ রোগীকে যদি বাড়িতে বা সমাজে পাঠিয়ে দিতে সমস্যা থাকে, তাহলে কোভিড আইসোলেশন সেন্টার খুলুন—যেভাবে খোলা হয়েছিল আশকোনা হজ ক্যাম্পে!

এই ব্যাপারে তো কোনোই সন্দেহ নেই যে বিশ্বের বাকি দেশগুলোর মতো বাংলাদেশের কমিউনিটিতেও করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। আগামী ছয় মাস থেকে এক বছর যেকোনো হাসপাতালে যেকোনো রোগীই করোনাভাইরাসে সংক্রমিত থাকতে পারে, সে যে কারণেই হাসপাতালে যাক না কেন!

এই ব্যাপারটা মাথায় রেখে উচিত হবে তথাকথিত কোভিড হাসপাতালগুলোকে আগের পর্যায়ে ফিরিয়ে নিয়ে দেশের সব হাসপাতালেই কোভিড রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স থেকে শুরু করে সব চিকিৎসাকেন্দ্রেই একটা কোভিড আইসোলেশন ইউনিটের ব্যবস্থা করা, পর্যাপ্ত পিপিইর ব্যবস্থা করা আর অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করা।

আবারও বলছি, আলাদা করে কোনো কোভিড হাসপাতালের দরকার নেই। সব হাসপাতালেই কোভিড চিকিৎসার অনুমতি দিন। প্রয়োজনে কিছু কোভিডমুক্ত হাসপাতাল থাকতে পারে যেমন ক্যানসার হাসপাতাল বা হার্ট বা কিডনি ইনস্টিটিউট!

যত দিন আমরা এই কোভিড আর নন-কোভিড রোগীদের আলাদা করার দুঃসাধ্য চেষ্টা করে যাব, তত দিনই মানুষ জীবন বাঁচানোর তীব্র তাগিদে নিয়ে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটতে থাকবে। আর তাতে করে প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুগুলো বন্ধ করতে আমরা ব্যর্থ হব, যেমনটা হয়েছিল সরকারের ওই দুর্ভাগা অতিরিক্ত সচিবের বেলায়।

রুমী আহমেদ খান: বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার অরল্যান্ডো রিজিওনাল মেডিকেল সেন্টারে কর্মরত এবং ট্রেনিং প্রোগ্রামের পরিচালক। মেডিসিনের (রেসপিরেটরি ও আইসিইউ) সহযোগী অধ্যাপক।