ব্রিগেডিয়ার ক্লেরের চিঠির জবাব ও একজন মুক্তিযোদ্ধার জবানবন্দি

গত ০৪ মে তারিখে দৈনিক ‘সমকাল’-এর পঞ্চম পৃষ্ঠায় দেশের বরেণ্য অভিনেতা ও নাট্য নির্দেশক আলী যাকেরের একটি ছোট্ট সাক্ষাৎকার পড়লাম। বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা এই নাট্যকার আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ইংরেজিতে সংবাদ পড়তেন। রণাঙ্গনের খবরাখবর দিয়ে আন্তর্জাতিক দুনিয়ার কাছে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্যগাথা সামনে আনতেন। আমাদের প্রিয় নূর ভাইয়ের (আসাদুজ্জামান নূর) কাছ থেকে জানলাম, আলী যাকের শুধু ইংরেজি খবরই পড়তেন না, তিনি রণাঙ্গনে গিয়ে সংবাদ সংগ্রহও করতেন।

আমার এ লেখাটি জনাব আলী যাকেরকে নিয়ে নয়। সাক্ষাৎকারের তাঁর কয়েকটি কথার রেশ ধরে আমার এ লেখাটি টেনে নেব ভাবছি। তাঁর কাছে ‘সমকাল’-এর সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল, ‘কেমন আছেন? বাসায় সময় কাটাচ্ছেন কীভাবে?’ কোভিড-১৯-এর এই দুঃসময়ে সবার সামনেই এই প্রশ্নটি রাখা হয়। উত্তরে আলী যাকের বললেন, ‘এই তো চলে যাচ্ছে। দিনের বেশির ভাগ সময় ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিই। এ ছাড়া বই পড়ি, সিনেমা দেখি।’ জনাব আলী যাকেরের যথেষ্ট বয়স হয়েছে। এ বয়সে বিশ্রাম নেওয়া খুবই প্রয়োজন। তবে তাঁর মতো সদা কর্মব্যস্ত একজন মানুষ অন্য সময় বিশ্রাম নেওয়ার সময় পান কি না, বলা মুশকিল। তিনি বলেছেন, তিনি সিনেমা দেখেন ও বই পড়েন। দুটি কর্মই একজন প্রবীণ সৃজনশীল মানুষের অখণ্ড অবসরের সাথি। আমার বিচারক জীবনের অবসর পর্বটি শুরু হতে এখনো বেশ কিছু সময় বাকি। আমাদের অবসরজীবন কেমন হবে, জানি না। তবে ওই জীবনের স্বাদ বুঝি আমরা সবাই কম-বেশি এখনই অনুভব করতে পারছি।

বর্তমান দুঃসময়ে ঘরে অন্তরীণ থেকে সময়টা কাটছে মূলত বই পড়ে ও কিছু লেখালেখি করে। লেখালেখিটা দুটো ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ। প্রথমটি আমার আদালতের কার্যক্রম থেকে উদ্ভূত সিদ্ধান্ত ও আদেশ লেখা। সেগুলো সংশোধন ও চূড়ান্ত করা প্রভৃতি। কাজটি মূলত আইন অনুশীলননির্ভর। আর দ্বিতীয়টি হলো, অন্য যেসব ভাবনা মাথায় ঘোরাঘুরি করে সেটি লেখার মধ্যে বন্দী করে রাখি। সেই সঙ্গে মনে হয় লেখার মধ্যে অনুনাদিত আমার ভাবনাগুলো অন্যরা জানুক। পত্রিকার পাঠকেরাই আমার এসব লেখার অনুপ্রাণন।

আইনি বিষয় ও ভাবনার বাইরে যেসব বিষয় আমার ভাবনায় নিরন্তর ঘুরে বেড়ায় তা হলো, আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, মানবতা, আমার পিতার আদর্শ প্রভৃতি।

স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি। বঙ্গবন্ধুকে জীবনে এক-দুবার দেখেছি। তখন আমার বয়স খুব কম। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে তো সশরীরে দেখার প্রশ্নই ওঠে না। বঙ্গবন্ধুর কৈশোর ও যৌবনেই রবীন্দ্রনাথ বার্ধক্যে। বঙ্গবন্ধু ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখতে গিয়ে আমার খুব ভয় হয়, পাছে কোথাও কোনো ভুল লিখে ফেলি কি না? কারণ এই দুজনের জীবন ও আদর্শ বাঙালি জাতির মানসে নিবিড়ভাবে প্রোথিত। তাঁদের দর্শন, জীবনী ও কর্মকাণ্ড নিয়ে দেশে-বিদেশে প্রচুর গবেষণা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। এ দুজনকে নিয়ে লিখতে গেলে যে পরিমাণ লেখাপড়া থাকা দরকার, আমার সে রকম কিছুই নেই।

শুরুতেই বলেছি, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে একটানা লকডাউনে বাসাতেই অন্তরীণ। বই পড়ে সময় কাটাতে হচ্ছে। সেদিন হাতের কাছে একটি বই পেলাম ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা জেনারেল লে. জেনারেল জে এফ আর জ্যাকবের লেখা। বইটির নাম, ‘সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা: একটি জাতির জন্ম’। জেনারেল জ্যাকব ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ভারতের ইস্টার্ন আর্মির চিফ-অব-স্টাফ ছিলেন। তাঁর এই বইটির অনুবাদ করেছেন আনিসুর রহমান মাহমুদ। বইটি পড়তে পড়তে একটি ঘটনায় এসে থমকে গেলাম। মনে হচ্ছিল বইটিতে লেখা এই ঘটনার কথা তো আমি শুনেছি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এক মামলায়। নিজের স্মৃতিকে একটু শাণিত করতেই মনে পড়ে এটি কামারুজ্জামানের মামলায় প্রসিকিউশন পক্ষের সাক্ষী জহুরুল হক মুন্সীর সাক্ষ্যের বর্ণনা।

জেনারেল তাঁর বইতে লিখেছেন, ‘এর আগে ব্রিগেডিয়ার ক্লেরের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতানকে বার্তা পাঠান। হার মানতে অস্বীকার করে সুলতান চিঠির উত্তরের সঙ্গে একটি বুলেট পাঠান। সামরিক ইতিহাসে এই চিঠি নিঃসন্দেহে একটি বিশেষ স্থান দাবি করে এবং সে কারণে পরিশিষ্ট ৩-এ এটার প্রতিলিপি দেওয়া হয়েছে। (পৃষ্ঠা-১০২ , সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা)

আমি লেখাটি পড়ার পর পুরোনো ফাইল ঘেঁটে কামারুজ্জামানের মামলার প্রসিকিউশন পক্ষের সাক্ষী জহুরুল হক মুন্সীর সাক্ষ্যটি পড়লাম। শপথ নিয়ে প্রদত্ত সাক্ষীর বিবৃত ঘটনাটি আমরা বিচারকের আসনে বসে শুনেছি এবং তা ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক রেকর্ড করা হয়। ঘটনাটি জানলে আমাদের বহুমাত্রিক মুক্তিযুদ্ধের একটি ছোট্ট দিক পাঠকদের সামনে প্রতিফলিত হবে।

আমি তখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এর চেয়ারম্যান হিসেবে আমার দুই ব্রাদার জাজ মুজিবুর রহমান মিয়া ও শাহিনুর ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে জামায়াতের নেতা কামারুজ্জামানের বিচার করছিলাম। সাক্ষী জহুরুল হক মুন্সী জামালপুরের রণাঙ্গনে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার উল্লেখ করে নিম্নরূপ সাক্ষ্য দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল-২-এর সামনে:

(সাক্ষ্যের প্রাসঙ্গিক অংশটুকু শুধু তুলে ধরা হলো)

‘আমার নাম মো. জহুরুল হক মুন্সী বীর প্রতীক। আমার বাবার নাম মৃত আব্দুল গফুর মিয়া। আমার জন্ম তারিখ ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৫০ সাল। আমার গ্রাম: খামারিয়া পাড়া, থানা: শ্রীবর্দী, জেলা: শেরপুর। ১৯৭১ সালে ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা স্বেচ্ছাসেবক গঠন করি এবং ফায়ার ডিফেন্স গঠন করি যাতে বিমান আক্রমণ হলে আমরা বাঁচতে পারি।…৯ ডিসেম্বর, ১৯৭১ আমি বেলটিয়া নামক স্থানে অবস্থান করছিলাম তখন ব্রিগেডিয়ার হরদেব সিং ক্লের-এর হাতে লেখা চিঠি নিয়ে জামালপুর পিটিআইতে পাকিস্তানি আর্মিদের ক্যাম্পে আসি এবং সেন্ট্রি পোস্টে আমাকে ধরে এবং আমার বডি সার্চ করে ২০ টাকা এবং একটি চিঠি পায়। আমি চিঠি নিয়ে গিয়েছিলাম সাদা ফ্লাগ উড়িয়ে বাইসাইকেল যোগে। তখন সাদা ফ্লাগটি দিয়ে আমার চোখ বাঁধে এবং কোমরের গামছা দিয়ে আমার হাত-পা বাঁধে এবং আমাকে ওয়াপদা ক্যাম্পের কোয়ার্টার গার্ডে রাখে। তখন একজন বেলুচ আর্মি বলে. ‘ওসকো কেয়া করেগা?’ তখন জানতে পারি, পাকিস্তানি কর্নেল সুলতান খান এবং আল বদর কমান্ডার মো. কামারুজ্জামান ঝিনাই ব্রিজ পরিদর্শন করতে গিয়েছেন। তাঁরা ফিরে না আসা পর্যন্ত আমার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। কিছুক্ষণের মধ্যেই কর্নেল সুলতান খান এবং আলবদর কমান্ডার মো. কামারুজ্জামান ফিরে আসেন। এটা একটা-দেড়টার দিকে হবে। আমি যে সারেন্ডার পত্রটি বহন করে এনেছিলাম সেটি কর্নেল সুলতান খানের কাছে আর্মিরা দেয়। সুলতান খান পত্রটি পড়ে দেখেন এবং তিনি রাগান্বিত হয়ে তাঁর কাঁধে যে এসএমজি ছিল তার ম্যাগাজিন দিয়ে আমার মুখে বাড়ি মারেন। এতে আমার ওপরের পাটির ৪/৫টি দাঁত ভেঙে যায়। এবং আমাকে অশ্লীল গালাগালি করেন এবং আমাকে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখতে নির্দেশ দেন। তখন পাকিস্তানি একজন সেনা এসে আমার পা বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে ‘মোরব্বা’র মতো করে ফেলে এবং হাতের আঙুলে সুচ ঢুকিয়ে নির্যাতন করলে আমি তখন বলি, আমি গ্রামের সাধারণ কৃষক, আমাকে ভয় দেখিয়ে এই চিঠি দিয়ে পাঠিয়েছে, আমি মুক্তিযোদ্ধা না। তখন কর্নেল সুলতান খান হরদেব সিং ক্লের চিঠির জবাব লিখে তা আমাকে ক্লের কাছে পৌঁছে দিতে বলেন। তখন আমি অভিনয় করে বলি, এই চিঠি নিয়ে আমি আর যাব না। ওই খানে গেলে আমাকে মেরে ফেলবে। আমি এখানেই থাকব। ওই ক্যাম্পে বেলা ১১টায় ঢুকেছি, পরে রাত ১১টায় আমাকে সাইকেলসহ ছেড়ে দেয়। সেই সাইকেল নিয়ে এক পায়ে সাইকেল চালিয়ে কোনোমতে আমার বেলটিয়ার ক্যাম্পের উদ্দেশে রওনা হই। পথিমধ্যে রাস্তার দুই পাশের গাছের সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় মানুষের গুলিবিদ্ধ অনেক মৃতদেহ দেখতে পাই। আসামি ডকে শনাক্ত। আমি মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনকারীদের বিচার ও শাস্তি চাই।’

অভিযুক্ত কামরুজ্জামানের বিজ্ঞ কৌঁসুলি সাক্ষীকে তাঁর প্রদত্ত জবানবন্দির ওপর জেরা করেন। প্রতিপক্ষ আইনজীবীর সাজেশন ছিল, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্রের ১০ম খণ্ডে ঘটনাটি ভিন্নভাবে উল্লেখ করা আছে।’ সাক্ষী অবশ্য এ সাজেশনটি অস্বীকার করেন।

আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্রের ১০ম খণ্ডে ৭.৬.১৯৭৩ তারিখে মেজর আব্দুল আজিজের প্রদত্ত সাক্ষাৎকারটি পড়েছি এর প্রাসঙ্গিক অংশটুকু পাঠকদের জন্য নিচে উল্লেখ করা হলো:

‘…নভেম্বর মাসের ১৮ তারিখ ভারতীয় ৯৫তম মাউন্টেন ব্রিগেডের ব্রিগেডিয়ার ফ্লেয়ার, ভারতীয় এবজা সেক্টরের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার সাম সিং এবং ভারতীয় পূর্বাঞ্চলের কমিউনিকেশনের অধিনায়ক মেজর জেনারেল ভগৎ সিং এবং ১১ নং সেক্টরের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক হিসেবে আমার সমন্বয়ে জামালপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা প্রভৃতির সম্ভাব্য হামলার পরিকল্পনা করা হয়েছিল।’

এই যুদ্ধে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো ১০ ডিসেম্বর বিকেল ৪টার সময় পাকিস্তানি বাহিনীর ৩১তম বেলুচ রেজিমেন্টের অধিনায়ককে আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানিয়ে একটি পত্র মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক মুন্সীকে দিয়ে একটি সাদা পতাকা হাতে নিয়ে পাকিস্তানিদের সদর দপ্তরে পাঠানো হয়। উত্তরে পাকিস্তানি অধিনায়ক ৭.৬২ চাইনিজ সাব মেশিনগানের একটি বুলেট একটি কাগজে মুড়ে পাঠিয়ে দেন। তার অর্থ এই যে, যুদ্ধই চূড়ান্ত ফয়সালা করবে। (স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র দশম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪৬২) (পুনর্মুদ্রিত সংখ্যা-২০০৩ সাল)

একটি ঘটনাকে নিয়ে তিনটি বক্তব্য পাশাপাশি রাখলে দেখা যাবে, আদালতে দাঁডিয়ে সাক্ষী জহুরুল হক মুন্সী যা বলে গিয়েছিলেন তা সম্পূর্ণ সত্য। তিনটি বক্তব্যই ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন মানুষ উল্লেখ করেছেন। দীর্ঘ সময়ের আবর্তে মানবস্মৃতি কিছুটা ধূসর হয়, এটি সত্য। কিন্তু তার পরও অনেক অনেক ঘটনার মূল বিষয়টি মানব হৃদয়ে গেঁথে থাকে। কখনো তা হারিয়ে যায় না, স্মৃতিতে অমলিন থেকে যায়। তাই মানুষের স্মৃতি খুব একটা ভুল বলে না। তবে তারিখ বা সময়ের সামান্য হেরফের হতেই পারে। জেনারেল জ্যাকবের বইয়ের পরিশিষ্ট ৩-এ উল্লিখিত পাকিস্তানি লে. কর্নেল সুলতানের দেওয়া চিঠিটা হুবহু নিচে উদ্ধৃত করা হলো:

প্রাপক ব্রিগেডিয়ার এইচ এস ক্লের
ব্রিগেড কমান্ডার
৯৫ মাউন্টেন ব্রিগেড
জামালপুর
০৯১৭৩৫
(সম্ভবত ৯ ডিসেম্বর তারিখ
বোঝাতে গিয়ে মুদ্রণপ্রমাদ হয়েছে)

শ্রদ্ধেয় ব্রিগেডিয়ার,
আশা করি ভাল আছেন। আপনার চিঠির জন্য ধন্যবাদ।
জামালপুরে আমরা সকলে যুদ্ধ শুরুর অপেক্ষায় বসে আছি। এখনো যুদ্ধ শুরুই হয়নি। কাজেই আর কথাবার্তা না বলে যুদ্ধ শুরু করা যাক।
আমার ধারণা, ৪০টি সর্টি খুবই কম। আমাদেরকে কাবু করতে আপনার আরো বেশ কিছু চেয়ে পাঠাতে হবে।
আপনার দূতের সাথে ভাল ব্যবহার করার জন্য আপনার তরফ থেকে কোনো মন্তব্যের প্রয়োজন ছিল না। এতে বোঝা যায়, আমার লোকদের সম্পর্কে আপনি কতটা নিচু ধারণা পোষণ করেন। আশা করি, এখানকার চা তার ভাল লেগেছে। মুক্তিবাহিনীর জন্য আমার ভালবাসা রইল।

পরবর্তীতে যদি দেখা হয়, আশা করছি, আপনার হাতে তখন কলমের পরিবর্তে একটি স্টেন থাকবে, যদিও কলম ব্যবহারেই আপনাকে বেশি পারদর্শী মনে হচ্ছে।
আপনার বিশ্বস্ত,
(কর্নেল সুলতান)
অধিনায়ক, জামালপুর দুর্গ।

আবার ফিরে আসি মুক্তিযোদ্ধা আলী যাকেরের কাছে। আলী যাকেররা যে যুদ্ধটিতে সক্রিয় অংশ নিয়ে দেশ মাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করেছিলেন, প্রতিষ্ঠিত করেছেন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ, সেই যুদ্ধে জহুরুল হক মুন্সীও সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। আমার মতো কিশোর মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেনি সত্য, কিন্তু হৃদয়ে এর চেতনাকে সব সময়ই লালন করেছি, সব সময়। পরিণত বয়সে ১৯৭১-এ সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনালে বিচারকের আসনে বসে মুক্তিযোদ্ধাদের বক্তব্য শুনেছি। সত্যটা জেনেছি। জেনেছি নিরস্ত্র বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রতি পাকিস্তানি দখলদার সেনাবাহিনী ও তাদের এ-দেশীয় দোসরদের বর্বর আক্রমণ ও হত্যাযজ্ঞের কত শত ঘটনা।

নিরপেক্ষ বিচারিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নিজ শপথে দৃঢ় থেকে এ বিচারকাজ করতে গিয়ে আমাদের কাছে মনে হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বিশেষ করে রণাঙ্গনের যুদ্ধ নিয়ে জহুরুল হক মুন্সীরা বা মুক্তিযোদ্ধারা কখনো অসত্য বা বাহুল্য বলেননি। যেখানে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা হেরে গেছেন বা পিছু হটেছেন, সেটিও তাঁরা নির্দ্বিধায় সাক্ষ্যদানকালে বলেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা সব সময়ই সত্যের কাছে থেকেছেন।

ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্যদানকালে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব ঘটনা ও অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন, সেটিই তাঁরা জাতির সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন মাত্র। দেশমাতৃকার মুক্তির লক্ষ্যে নির্ভীক অবিচল মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন সাহসী দেশপ্রেমিক। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধটি ছিল একটি পবিত্র কর্তব্য। এই সত্যটি সবাইকে জানতে হবে। সত্যের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাবে কত সীমাহীন আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। এই বার্তাটি বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার অভিলাষেই আজকের লেখা। প্রত্যাশা করছি, তারা সত্য জানতে সদা উদগ্রীব থাকবে।

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান: হাইকোর্টের বিচারপতি