অবকাঠামো না বদলালে গরিবের সঙ্গে অন্যরাও মরবে

ওয়াহিদুল ইসলাম বাংলাদেশের ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার ডালভাঙ্গা গ্রামের দিনমজুর। চার সন্তান ও স্ত্রীসহ ছয়জনের পরিবার। প্রায় দেড় মাস ধরে কর্মহীন, ঘরে অন্ন নেই। চেয়েচিন্তে যে টাকা জোগাড় করেছিলেন তার সব শেষ, সে টাকা ফেরত দেবেন তার উপায় নেই। পাওনাদারের জ্বালায় পালিয়ে পালিয়ে কত দিন থাকবেন! উপায় না দেখে নিজের বাড়িতেই ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন।

সারফাস মসিহ পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের মেহমুদাবাদের পেট্রল পাম্পের কর্মচারী। দুই মেয়ের পিতা, স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। লকডাউনের ফলে পেট্রল পাম্প বন্ধ, মালিক কাজ থেকে বিদায় করে দিয়েছে। কোথায় যাবে, কার কাছে হাত পাতবে, উপরন্তু করোনা সংক্রমণের ভয়। বাঁচার পথ হিসেবে আত্মহত্যা বেছে নেয়।

রাজেশ জয়াসালেম ভারত থেকে লন্ডনে অভিবাসী হয়েছেন প্রায় এক দশক আগে। লন্ডনে উবার ড্রাইভার, ভাড়া একটি রুমে থাকেন। তাঁর মাধ্যমে করোনা ছড়াতে পরে, এই ভয়ে মার্চে বাড়িওয়ালা তাঁকে বের করে দেয়। দিন কয়েক নিজের গাড়িতে দিন-রাত কাটান। পরে এক বন্ধুর সাহায্যে আরেকটি ভাড়া ঘর নেন। এই সময় করোনায় আক্রান্ত হন। জানাজানি হলে তাঁকে ওই ঘরটিও ছাড়তে হবে, এই ভেবে তিনি দিনের পর দিন নিজের ঘরেই আটকে থাকেন। ঘরে খাবার নেই, কিন্তু ভয়ে বাইরে যেতে পারেন না। এভাবে যখন মর–মর অবস্থা, তখন কাছের হাসপাতালে যান, সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। করোনায় নয়, অনাহারের ফলেই।

ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের হরপ্রসাদ দিনমজুর হিসেবে কাজ করতেন বেঙ্গালুরুতে। লকডাউন শুরু হলে নিজের গ্রামে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। যানবাহন নেই, হেঁটেই রওনা হন। প্রায় ১০০ কিলোমিটার হাঁটার পরে ক্ষুধায়, ক্লান্তিতে পথেই লুটিয়ে পড়েন, বাড়ি পৌঁছাতে পারেননি।

করোনাভাইরাসের কারণে সারা পৃথিবীতেই মানুষ মরছে, তাদের মধ্যে সব শ্রেণির মানুষই আছে, কিন্তু বেশি মারা যাচ্ছে দরিদ্র মানুষেরা। তাদের মৃত্যুর কারণ ভাইরাস নয়, ক্ষুধা। ওপরের ঘটনাগুলো জেনেছি গত কয়েক দিনের পত্রিকা থেকে। এ রকম আরও শত শত মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশ আমেরিকা, সেখানেও করোনার সময়ে মৃত অধিকাংশ মানুষ হয় কালো, নয় বাদামি। তাদের সবার একটা অভিন্ন পরিচয়—সবাই গরিব, ভীষণ গরিব। কোনো কোনো শহরে মৃতদের ৬০ শতাংশ নিম্ন আয়ের আফ্রিকান-আমেরিকান ও দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আসা উদ্বাস্তু শ্রমিক। দরিদ্র হওয়ার কারণে এদের অধিকাংশের রয়েছে নানাবিধ রোগব্যাধি। স্বাস্থ্যবিমা নেই, ফলে নিয়মমাফিক চিকিৎসার সুযোগ নেই। কোভিড-১৯ সবার আগে এদেরই ধরেছে।

তাদের মধ্যে অভিবাসী বাংলাদেশিরাও রয়েছে। অনুমান করা হয়, গত তিন মাসে শুধু নিউইয়র্ক শহরেই প্রায় আড়াই শ বাংলাদেশি করোনায় মারা গেছে। তাদের অধিকাংশই ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বাস করে, অনেক লোকজন নিয়ে ছোট ছোট অ্যাপার্টমেন্টে থাকে। ফলে একজন আক্রান্ত হলে তাকে অন্যদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হয় না। রোগীকে হাসপাতালে নিতেও ভয়, মারা গেলে নিকটজনকে শেষ দেখা পর্যন্ত হয় না। অনেকে ঘরেই মারা গেছে বিনা চিকিৎসায়।

করোনা সংকট থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়েছে। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই, বিশেষত যেখানে স্বাস্থ্যসেবার জাতীয়করণ হয়নি, সেখানে স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থা যত আধুনিক হোক না কেন, দরিদ্র মানুষের পক্ষে তা পাওয়া সম্ভব নয়। স্বাস্থ্যসেবাকাঠামো এমনভাবে গড়ে উঠেছে যে শুধু বিত্তবান মানুষেরাই তা থেকে উপকার পায়। কোনো দেশেই ভবিষ্যৎ বিপর্যয় মাথায় রেখে কোনো আপৎকালীন প্রস্তুতি নেই। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ, অথচ এখানে করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেবায় নিয়োজিত ডাক্তার ও নার্সদের বিক্ষোভে নামতে হয়েছে সামান্য কয়েক টাকার মাস্ক ও হ্যান্ড গ্লাভসের জন্য। এ প্রায় অবিশ্বাস্য ঘটনা।

করোনায় দরিদ্রদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণ, সম্পদের অসম বণ্টন ও অব্যাহত বৈষম্য। অর্থনীতি স্থবির হলে সবার সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা। কিন্তু অর্থবানদের পর্যাপ্ত সঞ্চয় রয়েছে, বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু দরিদ্রদের সঞ্চয় নেই, তারা দিন এনে দিন খায়, বিপদের সময়ে বাড়তি খরচ করতে তাদের ঘর বন্ধক রাখতে হয়। যাদের ঘর নেই, তাদের দিতে হয় গলায় দড়ি।

করোনার মতো ব্যাধি গরিবকেই আগে ধরে। কারণ, পুষ্টির অভাবে তার রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম। তার খাদ্যাভ্যাস খারাপ। নিজেকে রক্ষার জন্য যে জ্ঞান দরকার, তা তার নেই। আমেরিকায় প্রতি পাঁচজন মানুষের একজন স্বাস্থ্যবিমা না থাকায় নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে পারে না। অনেক সময় নিজের সংক্রমণের কথা গোপন রেখে কাজে যেতে হয়, অন্য কোনো বিকল্প তাদের নেই। অসুস্থ জানা গেলেই কাজ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে, ক্ষতিপূরণের কোনো আশাই নেই। ফলে তাদের অনেকেই বিপদ ঘাড়ে নিয়ে কাজ করে যায়। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয়, পর্যাপ্ত সুরক্ষাব্যবস্থা নেই। ফলে খুব সহজেই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। টেক্সাস ও সাউথ ডাকোটার একাধিক মাংস প্যাকেটজাত করার কারখানায় এমনটাই ঘটেছে।

অন্য কথায়, অসাম্য যদি হয় দারিদ্র্যের কারণ, তো দারিদ্র্য করোনার মতো ব্যাধির বিস্তৃতির অন্যতম কারণ। সংকটের সময় ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান আরও স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। বিজ্ঞানীরা অঙ্ক কষে জানিয়েছেন, দারিদ্র্যসীমার নিচের মানুষের করোনার সংক্রমণের আশঙ্কা অন্তত দশ গুণ বেশি।

গরিবের করোনা হলে ধনীদের তা নিয়ে মাথাব্যথার কারণ নেই। তাই আমেরিকার অধিকাংশ রাজ্যে লকডাউন তুলে নেওয়ার দাবি উঠেছে। উইসকনসিনের সর্বোচ্চ আদালত এক রায়ে রাজ্যের গভর্নর লকডাউনের যে নির্দেশ দিয়েছেন, তা বেআইনি বলে রায় দিয়েছেন। সওয়াল-জবাবের সময় রাজ্য সরকারের উকিল জানিয়েছিলেন, মিট প্যাকিং প্ল্যান্টে যেখানে দুই সপ্তাহ আগে মাত্র ৬০ জন সংক্রমিত মানুষ ছিল, তা এখন বেড়ে হয়েছে ৮০০। এর জবাবে প্রধান বিচারপতি মন্তব্য করেন, ওরা তো আর ‘সবার মতো’ (‘রেগুলার’) মানুষ নয়, এতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কী আছে!

আছে, প্রধান বিচারপতি সাহেব হয়তো জানেন না, এই সংক্রমিত মানুষগুলো থেকেই এই ব্যাধি সারা শহরে, সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। হোয়াইট হাউস পর্যন্ত সে সংক্রমণ থেকে রেহাই পায়নি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের একজন ব্যক্তিগত সহকারী ও ভাইস প্রেসিডেন্ট পেন্সের প্রেস সেক্রেটারি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। ভারতে পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১৬ সালে দিল্লিতে ইনফ্লুয়েঞ্জার যে ব্যাপক প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল, তার ৫০ শতাংশের উৎস ছিল শহরটির বস্তিগুলো।

করোনা হানা দেওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা স্বাস্থ্যব্যবস্থার বৈষম্য নিয়ে ভাবিনি। সম্পদ বণ্টনের বৈষম্য নিয়ে ভাবার তো প্রশ্নই ওঠে না। ঠেলায় না পড়লে কবে আবার আমরা ‘রেগুলার’ নয় এমন মানুষকে নিয়ে ভাবি! এবার হয়তো ভাবব, করোনার ফলে শুধু গরিবেরাই নয়, বিত্তবানেরাও গাড্ডায় পড়বে। এ শুধু সময়ের ব্যাপার।

হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক