বিপর্যয়ের ছয় দশকেও দাবি ছাড়েনি ফিলিস্তিন

১৫ মে। ফিলিস্তিনিদের জাতীয় বিপর্যয় দিবস। ফিলিস্তিনি উপনিবেশবাদবিরোধী মুক্তিকামীরা ছয় দশক ধরে এই বিপর্যয় দিবস পালন করে আসছেন। ১৯৪৮ সালের এই দিনে পশ্চিমাদের বিশেষ করে ব্রিটিশদের প্রত্যক্ষ মদদে মূলত ইউরোপ থেকে বিতাড়িত ইহুদিবাদীরা ফিলিস্তিনের মাটিতে ইসরায়েলি রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করে। যার দরুন লাখ লাখ ফিলিস্তিনির পূর্বপুরুষের ভিটে–মাটি থেকে উৎখাত হতে হয়। জীবন বাঁচাতে ফিলিস্তিনিরা আশ্রয় নিয়েছিলেন পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে। শরণার্থী শিবিরে অর্ধাহারে, বেকারত্বে এবং শীতের প্রকোপে মানবেতর জীবনযাপন করেছেন অনেক ফিলিস্তিনি শরণার্থী। যাঁরা পালাতে পারেননি, তাঁরা বন্দি হয়েছিলেন দখলদারদের উন্মুক্ত জেলখানায় অথবা নিষ্পেষিত হয়েছে ইসরায়েলি সেনাদের অভিযানে। গত ছয় দশকে দুনিয়ার ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হলেও ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার অবসান হয়নি। স্বজাতির এই দুর্দশার চিত্র ফুটে উঠেছে ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি মাহমুদ দারবিশের কণ্ঠে,

সেই মানুষের কী-ই বা দাম—যার কোনো স্বদেশভূমি নেই,
নেই কোনো পতাকা, কোনো ঠিকানা—এরকম মানুষের কী দাম, বলো?

আরবি শব্দ ‘নাকবা’র আক্ষরিক অর্থ দুর্যোগ, বিপর্যয়, আকস্মিক দুর্দশা। ফিলিস্তিন আন্দোলনের প্রবাদপুরুষ ইয়াসির আরাফাত ১৯৯৮ সালে যখন ইসরায়েল রাষ্ট্র তার দখলদারত্বের ৫০ বছর পূর্তি উদ্‌যাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন ১৫ মেকে নাকবা ডে অর্থাৎ ফিলিস্তিনিদের দুর্যোগের দিন হিসেবে ঘোষণা করেন। ইহুদিবাদীরা ফিলিস্তিনি ভূমির প্রায় ৮০ ভাগ দখল, প্রায় ৮ লাখ বাসিন্দাকে উচ্ছেদ এবং হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি গ্রাম ধ্বংস করে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠন করেছিল। আরাফাতের পক্ষে এই ঘোষণা দেওয়া সহজ ছিল না। ভগ্ন স্বাস্থ্য আর বন্দি অবস্থার মধ্যে ইসরায়েলের ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনকে জোরদার করতে আরাফাত এই ঘোষণা দিয়েছিলেন। নির্বাসিত ফিলিস্তিনিদের প্রতি মর্মবেদনা জানাতে প্রতিবছর পৃথিবীর নানা প্রান্তে সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদবিরোধী মানুষ এই দিবসকে উদ্‌যাপন করে।

মোটাদাগে ১৯৪৫ সালে ইসরায়েলের উচ্ছেদ অভিযান শুরুর পর থেকে নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিরা জীবনের তাগিদে বিশ্বের নানান দেশে নির্বাসিত জীবন শুরু করেন। শরণার্থীশিবিরে নির্বাসিত জীবন, অনাহার, বঞ্চনা মাতৃভূমি ফিলিস্তিনকে তাঁদের মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি। প্রাচ্যবিদ্যা আর উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী কণ্ঠস্বর এডওয়ার্ড সাইদ, যিনি নিজে একজন ফিলিস্তিনি শরণার্থী ছিলেন, ‘Reflection on Exile and Other Essays’ গ্রন্থে তাঁর স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা এবং ইসরায়েল কর্তৃক উচ্ছেদিত ফিলিস্তিনিদের মর্মবেদনা তুলে ধরেছেন। মোটাদাগে সাইদ স্বদেশ হারানো ফিলিস্তিনিদের মর্মবেদনা তুলে ধরার যে প্রয়াস দেখিয়েছেন, তা পূর্ণতা পেয়েছে আরেক জগৎখ্যাত নৃবিজ্ঞানি লীলা আবু লুগদের ‘Nakba: Palestine, 1948, and the Claims of Memory’ গ্রন্থে। এই গ্রন্থে আবু লুগদ কথ্য ইতিহাস (Oral History) পদ্ধতির ব্যবহার করে নির্বাসিত ফিলিস্তিনিদের ফেলে আশা মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা ও স্মৃতিচারণাকে তুলে এনেছেন। তুলে এনেছেন স্বাধীন ফিলিস্তিনের একখণ্ড চিত্র। সাইদ ও লুগদের পদচারণ অনুসরণ করে বিখ্যাত ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ ইলান পেপে তাঁর ‘The Ethnic Cleansing of Palestine’ গ্রন্থে ইসরায়েলি সৈন্যদের হত্যা, লুণ্ঠন আর নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন। পেপে একসময় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন। আরবদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ যুদ্ধের অভিজ্ঞতাও রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। কিন্তু ইসরায়েল রাষ্ট্রের অনবরত অত্যাচার-নির্যাতন তাঁকে স্বরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছে। এডওয়ার্ড সাইদ পরবর্তী বিশ্বমঞ্চে তিনি ফিলিস্তিনিদের কণ্ঠ হয়েছেন। দুর্বৃত্তায়নের দুনিয়ায় ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের পক্ষে ওকালতি করে চলেছেন।

জাতিসংঘের তথ্যমতে, মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর নানান দেশের প্রায় কয়েক শ শরণার্থীশিবিরে ৮০ থেকে ৯০ লাখ ফিলিস্তিনি বসবাস করছেন। তবে জাতিসংঘের সংস্থা UNRWA শরণার্থীর সংখ্যা সীমাবদ্ধ করেছে ৬০ থেকে ৭০ লাখের মধ্যে। সিরিয়া, লেবানন, মিসর ও জর্ডানে ফিলিস্তিনিদের ভিড় বেশি। মধ্যপ্রাচ্য ছাড়িয়ে লাতিন আমেরিকাতেও ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের একটি বিশাল অংশের বসবাস। শুধু চিলিতেই বসবাস করছে পাঁচ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনি শরণার্থী। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে পশ্চিমাদের সহায়তায় ইসরায়েলি সরকার ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের চিরতরে বাড়ি ফেরার পথ বন্ধ করেছে। জাতিসংঘও পশ্চিমাদের ব্যবহার করে শরণার্থীদের জীবনমান উন্নত করার ক্রমাগত তাগিদ দিয়েছে। যার সুযোগ নিয়ে পশ্চিমাদের সুদৃষ্টির আশায় আরব দেশগুলোকে ফিলিস্তিনিদের নাগরিকত্ব প্রদান করেছে। দ্বিতীয়ত, মার্কিনদের তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের সঙ্গী হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধাবস্থা জিইয়ে রাখায়। আদতে এই দুই নীতি ইসরায়েল রাষ্ট্রের উপনিবেশবাদকে বৈধতা অর্জনের পথকেও সুগম করেছে।

জেরুজালেমসহ ফিলিস্তিনিদের ভূমির প্রায় ৮০ শতাংশ দখল করে নিয়েছে ইসরায়েল। দুনিয়ার শক্তিশালী দেশগুলো, মার্কিন থেকে ব্রিটিশরা সবাই ইসরায়েলের দখলদারত্বের নীরব সহযোগী। তবে পাশ্চাত্যের নিরবচ্ছিন্ন সমর্থন ইসরায়েলের ভয়কে দমন করতে পারেনি। তাই ইসরায়েল ক্রমাগত আরবদের রাজনৈতিক স্বীকৃতি আদায়ের পেছনে ছুটছে। ইসরায়েলের স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টার পেছনে রয়েছে আরবদের এক সাংস্কৃতিক রীতির চর্চা। মোটাদাগে যাঁরা আরব সংস্কৃতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, তাঁরা জানেন যে আরবদের মধ্যে লিখিত ইতিহাসের পাশাপাশি কথ্য ইতিহাসের বহুল চর্চা রয়েছে। সেই চর্চার জায়গা থেকেই ভিটে–মাটি হারানো আরবরা তাঁদের বাড়ির চাবি সংরক্ষণ করে চলছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে, নিজ মহল্লা, গ্রাম আর শহরের নামে নাম রেখে চলছেন নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের। এবং একই সঙ্গে বর্তমান আবাসস্থল, শরণার্থীশিবির অথবা কোনো অঞ্চল মৌখিকভাবে তার নামকরণও করেছেন ফিলিস্তিনে ছেড়ে আসা গ্রামের নামে। বংশতালিকা হেফাজত করছেন কয়েক শ বছর ধরে।

অন্যান্য দেশে বসবাস করলেও ফিলিস্তিনিরা এখনো নিজেদের ফিলিস্তিনি বলে পরিচয় দেন। ইসরায়েল অস্ত্র দিয়ে ফিলিস্তিনিদের উৎখাতে সফল হলেও অনুভূতি ও ইতিহাসচর্চায় ফিলিস্তিনিদের দমাতে পারেনি। ফিলিস্তিনিদের স্বদেশের প্রতি এই অনমনীয় ভালোবাসা এবং ইতিহাসচর্চাতেই ইসরায়েলের যত ভয়। তাই ইসরায়েল রাষ্ট্রের কর্তারা মনে করেন ফিলিস্তিনিদের মাতৃভূমির প্রতি এই অগাদ ভালোবাসা আবার ফিলিস্তিনিদের ফিলিস্তিনে নিয়ে আসতে পারে। হুমকিতে ফেলে দিতে পারে দখলদারত্ব আর ইসরায়েল রাষ্ট্রের বৈধতার।

ফিলিস্তিনিদের মর্মবেদনা দূর করতে মার্কিনরা দুই রাষ্ট্রের সমাধানের খিস্তিখেউড় করেছে। কিন্তু যখনই ফিলিস্তিনিরা আলোচনার টেবিলে বসেছেন, তখনি ইসরায়েলিরা নতুন ভূমি দখল করে নিয়েছে। দখল আর সন্ত্রাসের ব্যবহার বোঝার জন্য ফিলিস্তিন-ইসরায়েল নৃবিজ্ঞানের একটি অর্থপূর্ণ কেস স্টাডি হতে পারে। ইউরোপে যে ইহুদিরা গণহত্যার শিকার ও সামাজিকভাবে বয়কটের শিকার হয়েছে, তারাই আবার স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ফিলিস্তিনিদের সন্ত্রাসী উপায়ে মাতৃভূমি থেকে উৎখাত করল। অত্যাচারিত কীভাবে অত্যাচারী হয়ে ওঠে, ইসরায়েল তার প্রমাণ দিয়েছে ফিলিস্তিনে। অত্যাচারের ক্যাম্পগুলো এখনো রয়ে গেছে, বদল হয়েছে কেবল নির্যাতিত গোষ্ঠীর পরিচয়ের। ইহুদিদের বদলে এসেছে ফিলিস্তিনিরা। ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের নিয়ে স্পিলবার্গ সিনেমা নির্মাণ করেননি, পশ্চিমের বড় বড় শহরে চিত্র প্রদর্শিত হয়নি, কিন্তু বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদ, জাতিবাদ ও মৌলবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামরত হাজার বিপ্লবীর মনে ও সংগ্রামে ফিলিস্তিনিরা বেঁচে থাকবেন।

রাহুল আনজুম: গবেষক