ধর্মচর্চায় করোনাভাইরাসের প্রভাব

দুবাইয়ে রমজানের সময় জুম্মার দিনে মসজিদের বাইরে নামাজ আদায় করছেন এক মুসলমান। ছবি: এএফপি
দুবাইয়ে রমজানের সময় জুম্মার দিনে মসজিদের বাইরে নামাজ আদায় করছেন এক মুসলমান। ছবি: এএফপি

করোনা-তাণ্ডবের মাঝামাঝি সময়ের ঘটনা। লেবাননের এয়ারপোর্টে পাদরি রেভারেন্ড মাজদি আলাবিকে করোনা পরীক্ষারত এক সেনাসদস্য সসম্মানে জিজ্ঞেস করেছিলেন—আপনার কি মাস্ক এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার আছে? তিনি বলেছিলেন, ‘যিশুই আমার সুরক্ষা। চার্চই আমার হ্যান্ড স্যানিটাইজার।’

এই বছরে ২২ মার্চের নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ভিভিয়ান লি এই ঘটনাসহ করোনার বিকাশকালে অন্যান্য ধর্মের এক শ্রেণির ধর্মবেত্তাদের করোনা-প্রতিক্রিয়ারও এ রকম কয়েকটি উদাহরণ টেনেছেন। বিশ্বের অনেক দেশেই ধর্মাচারীদের বিশ্বাস ও প্রত্যাশা ছিল যে করোনা ধার্মিকদের ক্ষতি করবে না। টেক্সাসের যাজক কেনেথ কোপল্যান্ড মার্কিন মুল্লুকের একজন টেলিভিশন চ্যানেল-নির্ভর খ্রিষ্ট ধর্মপ্রচারক। তিনি রীতিমতো টেলিভিশনের মাধ্যমেই করোনামুক্তির চিকিৎসা চালু করে দিয়েছিলেন। বিশেষ আশীর্বাদপদ্ধতি ও ধর্ম শ্লোক পাঠের মাধ্যমে নিরাময়ের নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন। ভারতে গোমূত্র ও বিষ্ঠা ব্যবহারই শুধু নয়, গঙ্গার জলও করোনা সারাবে—এ রকম বিশ্বাসও চাউর হয়েছিল। মিয়ানমারের বৌদ্ধদের এক বড় অংশ বিশ্বাস করেছিলেন, তাঁদের শীর্ষ বৌদ্ধ পুরোহিতের ধর্মাশ্রয়ী ব্যবস্থাপত্র—এক টুকরো লেবু ও তিনটি তালের শাঁস-আঁটিই হবে করোনার মূল চিকিৎসা। ইরানে ইমাম হাসান ও হোসেনের মাজার জিহ্বায় চেটে পরিষ্কার করে দিলে করোনা সারবে বিশ্বাসে কেউ কেউ সেই কাণ্ডও শুরু করেছিলেন।

তবে এই সব ধর্মাচারকে কোনো ধর্মেরই মূলধারা বা প্রাতিষ্ঠানিক আচরণ মনে করার সুযোগ নেই। এই সব আচরণের মূলে থাকে লোকবিশ্বাস এবং ধর্মের দর্শনহীন অগভীর পাঠ। নয়তো এই সব ধর্মাচারের মধ্যেই সব ধর্মের বিজ্ঞ পণ্ডিত ও শীর্ষ ধর্মবেত্তারা দ্রুতই বিজ্ঞানসম্মত ও রাষ্ট্র-নির্দেশিত পথকেই সঠিক পথ ঘোষণা দিতে পারতেন না। পোপ ফ্রান্সিস সাপ্তাহিক প্রার্থনাসভাগুলোকে অনলাইন প্রার্থনায় বদলে নিয়েছেন দ্রুত। এমনকি অনুতপ্ত হয়ে পাপ স্বীকারের জন্যও বিকল্প ব্যবস্থা নিয়েছেন। ব্যবস্থাটির নাম ‘ড্রাইভ-থ্রু কনফেশন’। চার্চ পেরোনোর সময় গাড়ি থামিয়েও পাপ স্খলনের প্রার্থনা করা যাবে। একজন যাজক চার্চের বাইরের রাস্তায় চেয়ার টেনে বসা থাকবেন। প্রার্থনাকারী দুই মিটার দূরে থাকবে। গাড়ি থেকে না বেরোলেও চলবে। তাতে যাজকের হাতে হাত রেখে অনুতাপ প্রকাশের বাধ্যবাধকতা থাকল না। চূড়ান্ত সনাতনপন্থী ইহুদিরাও সিনাগগের বাইরের দেয়ালে মুখ করে ছোয়াছুঁয়ি না করে দুই মিটার দূরত্ব মেনে প্রার্থনা করতে পারবেন বলে ফতোয়া হয়েছে। থাইল্যান্ডে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা হেলমেটের মতো দেখতে জীবাণু প্রতিরোধী ফেস প্রটেকশন ব্যবহার করছেন।

মুসলমানদের পবিত্রতম নগরী মক্কায় ঈদের দিনগুলোর জন্য কারফিউ জারি করার পর মুসলমানদের তরফে আপত্তি ওঠেনি। এর আগে এক দফায় মক্কা-মদিনায় তীর্থযাত্রীদের গমনাগমন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ইসলামের ধর্মতত্ত্ব বিশারদ বিজ্ঞ ফক্কিহরা কোরআন-হাদিসের আলোকে সময়োপযোগী ব্যাখ্যা হাজির করেছেন। যেসব ধর্মীয় বিধানের কথা আগে শোনা যায়নি বা আলোচিত হয়নি, সেগুলোই এখন আলোচনায়। ধর্মবিশারদেরা সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, প্রয়োজনে মসজিদ বন্ধ রাখা যাবে, নামাজের জামাতেও সংস্পর্শ-দূরত্বের নিয়ম মানা যাবে, জমায়েত বন্ধ রাখা যাবে। এমনকি জুমা এবং ঈদ জমায়েত বন্ধ রাখায়ও দোষের কিছু নেই। এসবের পক্ষে ধর্মীয় দৃষ্টান্তই তাঁরা হাজির করেছেন।

নতুন পরিস্থিতিতে ধর্ম পালনের নতুন নিয়মের এই সব অভিযোজন থেকে ধারণা করা যায় যে করোনা ধর্মচর্চার বাঁক আরও বদলে দিতে পারে। ঈদসহ সব ধর্মের সব অনুষ্ঠান-উৎসব, পালা-পার্বণের উদ্দেশ্য একই—সমাজ–সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা। উম্মাহ বলি, ব্রাদারহুড বলি বা ভ্রাতৃত্ববোধ বলি—এই সম্পর্ককে সমুন্নত রাখাই ধর্মের লক্ষ্য। সব ধর্মেরই মূল কাজ দুই রকম। সামাজিক ও আধ্যাত্মিক। ধর্মের সামাজিক ভূমিকা যে কতটা শক্তিশালী এবং ধর্ম যে কত বড় প্রভাবক ও সংযোগ সাধনকারী, তা এই করোনার কালে ধর্মানুরাগীরাই সবচেয়ে ভালো বলতে পারবেন। ধর্মস্থানে আসা-যাওয়ার মাধ্যমে ধর্মানুরাগীদের মধ্যে ধর্মভিত্তিক সামাজিক সংঘবদ্ধতার জন্ম হয়। করোনা সেই সংঘ-সম্পর্কে বড় ধরনের ছেদ টেনে দিয়েছে।

অন্যদিকে অনুষ্ঠানগুলো ধর্ম পালনকারী ও অপালনকারী নির্বিশেষে সবার মধ্যেই সামাজিক সংহতির বীজ বুনে দেয়। এই সব বাস্তবতাকে আমলে নিলে বলতে হয়, ধর্মবেত্তাদের নতুন ভাবনা ভাবতেই হবে। তাঁরা ভাববেন যেন দুর্যোগ-দুর্বিপাকেও ধর্ম স্বাভাবিক সময়ের মতো সমান উপকারী ও উপযোগী থাকে। যেন শিশু, বৃদ্ধ, নারী, প্রাপ্তবয়স্ক সবার জন্যই সমান আনন্দের উৎস হয়ে টিকে থাকতে পারে। ধর্মবেত্তাদের সহযোগী হবেন সমাজবিজ্ঞানীরা। তাঁরা উপায় খুঁজবেন, কীভাবে ধর্মগ্রন্থের বাণী এবং ধর্মীয় অনুশাসনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না করেও ধর্মকে মহামারি ও দুর্যোগকালীন সময়ে সামাজিক চাহিদার উপযোগী রাখা যাবে।

পরিবর্তিত সমাজের সঙ্গে খাপ খাইয়ে ধর্মাচরণ পরিবর্তন ইতিহাসের আনকোরা নতুন কোনো ঘটনাও নয়। প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মের বিকাশের ইতিহাস এবং সমাজ পরিবর্তনে তার ভূমিকা আলোচনা করে সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ভেবার বিখ্যাত হয়ে আছেন। তিনি দেখালেন যে ধর্মের একটি কম আধ্যাত্মিক এবং বেশি বাস্তবিক ও দুনিয়াবি বাঁকবদল ঘটেছিল প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মে। এই বাঁকবদলের প্রভাব এতটাই সুদূরপ্রসারী হয়েছিল যে এগুলোর প্রভাবে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। ভারতবর্ষেও ধর্মের বাঁকবদল ঘটেছে। ফলে সতীদাহ উচ্ছেদ হয়েছে। বিধবা বিবাহ চালু হয়েছে। ব্রাহ্ম আন্দোলন, ফরায়েজি আন্দোলন ইত্যাদি সমাজসংস্কার বা সোশ্যাল রিফর্মেশনও ঘটেছে। এভাবে আসলে ধর্মসংস্কারই হয়েছে বেশি।

উল্লেখিত ঐতিহাসিক সংস্কারগুলোর পর করোনা এবার ধর্মীয় আচার-আচরণে যে প্রভাব ফেলেছে, গত এক শ-দেড় শ বছরে কোনো ধর্মের ওপরই তেমনটি আর হয়নি। এবারের করোনার আঘাতের বিশেষত্ব এই যে সব ধর্মানুসারীই সমানভাবে ভুক্তভোগী হয়েছে। সব ধর্মের গায়েই যেহেতু বৈশ্বিক ও সর্বজনীন ঝাঁকুনিটি লেগেছে—সব ধর্মের অনুসারীদের একসঙ্গে বসে ধর্মচিন্তার একটি সুযোগও তৈরি হয়েছে।

গত কয়েক দশকে দেশে দেশে অত্যন্ত স্বল্প পরিসরে ‘মাল্টি ফেইথ ডায়ালগ’ বা ‘বহু ধর্মের সংলাপ’ নামে একটি ধর্মসংস্কার প্রচেষ্টা চালু আছে। মাল্টি ফেইথ ডায়ালগের নিয়ম অনুযায়ী বিভিন্ন ধর্মের বিশারদেরা কোনো একটি বিষয় সম্পর্কে নিজেদের যাঁর যাঁর ধর্মের অবস্থান ব্যাখ্যা করার জন্য একসঙ্গে বসেন। যেমন বিষয় করোনা। তাঁরা বসে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যগুলো নির্ণয় করেন। তারপর স্ব স্ব ধর্মের অনুশাসনকে ঠিক রেখেই পার্থক্যগুলো ঘুচিয়ে আনেন। এভাবে ধর্মগুলো এক ধরনের সহমতপূর্ণ অবস্থানে আসার চেষ্টা করে। তাতে করে ধর্মের সামাজিক দায়িত্বেও দারুণ সমন্বয় আসে। উন্নত দেশগুলো থেকে অসংখ্য মাল্টি ফেইথ ডায়ালগের খবর আসছে। ইন্টারনেটের কল্যাণে লাইভ স্ট্রিমেই ধর্মসংস্কারের সংলাপগুলোর আয়োজন বাড়ছে। এটি এখন মোটামুটি নিশ্চিত যে করোনা মাল্টি ফেইথ ডায়ালগকে আরও বৃহৎ পরিসরে নিয়ে আসবে এবং ধর্মচর্চায় একাধিক নতুন নতুন বাঁক তৈরি করবে।

হেলাল মহিউদ্দীন: অধ্যাপক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোসিওলজি; নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।