করোনা সংকট মোকাবিলায় নাগরিক ভাবনা

করোনার প্রাদুর্ভাবের পর থেকে গত আড়াই মাসে সরকার যে ত্রাণসামগ্রী বরাদ্দ করেছে, পরিমাণের দিক থেকে তা কম নয়, কিন্তু বণ্টনের দিক থেকে তা কতটা সুষ্ঠু হয়েছে, সে সম্পর্কে মানুষের প্রশ্ন রয়েছে। বাংলাদেশে ত্রাণ বিতরণ কখনো যে সুষ্ঠু হয়েছে, তেমন প্রমাণ নেই। ত্রাণ বিতরণে দুর্নীতি হবেই এবং সত্যিকারের হতদরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিতদের থেকে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে সুবিধাভোগীরা তা বেশি পায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও বাংলা ১৩৫০ সনের দুর্ভিক্ষের সময় থেকে যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে, তাতে ত্রাণ বিতরণ সুষ্ঠু হবে আশা করাই বোকামি।

দরিদ্রে নিষ্পেষিত একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে ত্রাণনির্ভরতার ওপর বাঁচিয়ে রাখা বাংলাদেশের মতো একটি দেশের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন। তাতে সরকারের অন্যান্য উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত হবে। অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব হবে দীর্ঘস্থায়ী। অতি বৃদ্ধ ও শারীরিকভাবে অসমর্থ ছাড়া সবাই যাতে কোনো না কোনো উৎপাদনশীল কাজ করতে পারে, সেই ব্যবস্থা করাই সরকারের প্রধান কর্তব্য হওয়া উচিত।

কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের শান্তি-সমৃদ্ধির পেছনে শত শত বছর যাবৎ গ্রামীণ অর্থনীতির ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। এ দেশের মানুষ চিরকাল সব রকম প্রাকৃতিক ও দৈব-দুর্বিপাকের মধ্যে বসবাস করতে অভ্যস্ত। তবে আজ থেকে ১০০ বছর আগের অবস্থা আর এখনকার অবস্থা এক নয়। তখন পূর্ববঙ্গ বা বর্তমান বাংলাদেশে জনসংখ্যা ছিল দুই কোটির কিছু বেশি, এখন ঢাকা সিটি করপোরেশনেই জনসংখ্যা দুই কোটির বেশি।

কোনো পরিসংখ্যান ছাড়াই বলা যায় যে সারা বাংলাদেশে অভাবী মানুষের সংখ্যা পাঁচ কোটির কম নয়। স্বাভাবিক অবস্থাতেই তিন কোটি মানুষের করার মতো তেমন কাজ নেই। তারা অন্যের অনুগ্রহে বেঁচে আছে। সেই অবস্থায় করোনা পরিস্থিতির কারণে যদি আরও চার-পাঁচ কোটি মানুষ উপার্জনহীন হয়ে পড়ে, যা হবে রাষ্ট্রের ওপর বিরাট বোঝা। সে বোঝা বহন করার সামর্থ্য সরকারের আছে, তেমনটি মনে করার কারণ নেই।

গ্রামীণ কুটিরশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রণোদনা দেওয়ার কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন। খুবই বাস্তবসম্মত ও সময়োপযোগী উদ্যোগ। এর মধ্যেই তাঁতশিল্পসহ অনেক গ্রামীণ কুটিরশিল্প মারাত্মক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। ১৬ কোটি মানুষের নিত্যব্যবহার্য শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় না আমাদের তাঁতশিল্পের কারিগরদের জন্য। বর্তমানে ৯০ ভাগ কারিগরের হাতে কোনো কাজ নেই। ভাতের সঙ্গে কাপড়ের কথা আমরা বলে থাকি। কিন্তু ধান উৎপাদনে যত জোর দেওয়া হয়, তুলা উৎপাদনে তত উৎসাহ নেই। তুলা আমদানি করতে হয়। সে জন্য দরকার পুঁজির।

গ্রামীণ দারিদ্র্য ও বেকারত্ব দূর করতে পল্লির পেশাজীবীদের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। ভূমিহীন কৃষিশ্রমিক, নদী শিকস্তি মানুষকে কাজের ব্যবস্থা করে দেওয়া সাময়িক ত্রাণ দেওয়ার চেয়ে বেশি জরুরি। দেশের কত জায়গায় কত শত রকমের কুটিরশিল্প নন ফরমাল অর্থনীতিতে অবদান রাখছে, তাতে কয়েক কোটি শ্রমিক কাজ করেন, তা মাননীয় অর্থমন্ত্রী অবগত কি না, জানি না। সিলেট অঞ্চলের শীতলপাটির ব্যবসায়ী ও শ্রমিক, দক্ষিণ বাংলায় যাঁরা ফুলের ঝাড়ু তৈরি করেন, তাঁদের খোঁজ অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা যাঁরা তৈরি করেন, তাঁরা সম্ভবত রাখেন না। জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ, বিনিদ্র রাতযাপন করে, বড় অঙ্কের বাজেট নিয়ে বগল বাজিয়ে অনাগত অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে না।

পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ আর মুক্তবাজার অর্থনীতির লোকদের সলাপরামর্শকে অগ্রাহ্য করা আমাদের মতো দেশের সরকারের পক্ষে কঠিন। তাদের মূল লক্ষ্য শোষণ ও মুনাফা। সরকারের পক্ষে শ্যাম এবং কুল দুটো রক্ষা করা অসম্ভব। জনগণের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিলে শ্যামেরা অপ্রসন্ন হবে। আমাদের উন্নয়নে নানা রকম ঝামেলা তৈরি করবে। তার থেকে বাঁচার উপায় জনগণের ঐক্য ও সমর্থন।

করোনা যে শুধু মানুষের জীবনের ওপর আঘাত হানছে তাই নয়, অনেক প্রচলিত ব্যবস্থাকে অকার্যকর প্রমাণ করেছে। করোনা নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের রোজগার যেমন বন্ধ করেছে, তেমনি আমাদের দেশের সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিদেশ সফর বন্ধ করেছে। এই যে তিন মাস যাবৎ তাঁরা বিদেশে যাচ্ছেন না, তাতে দেশ চমৎকার চলছে। করোনা প্রমাণ করল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মাঝেমধ্যে দল বেঁধে বিদেশ ভ্রমণ না করলেও দেশ চলে। পুকুর খনন করা শেখাসহ বিভিন্ন ছুতোয় সদলবলে বিদেশ সফরে গত ২০ বছরে রাষ্ট্রের যে টাকা নষ্ট হয়েছে, সেই টাকা থাকলে এক বছর চার-পাঁচ কোটি মানুষকে বসিয়ে খাওয়ানো যেত।

পৃথিবী থেকে এই ভাইরাস কবে বিদায় নেবে না নেবে, আদৌ নেবে কি না, তা তার মর্জির ওপর নির্ভর করে। তাতে কোনো সুপারপাওয়ার বা ডেপুটি সুপারপাওয়ারের হাত নেই। এ ব্যাপারে তাদের বিজ্ঞানীরাও নাচার। মানুষ শুধু প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে, প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে পারে। যদি অল্প সময়ের মধ্যে চলে যায় তো গেল, যদি করোনা মনে করে যে দুনিয়ায় আরও কিছুদিন থাকবে, তাহলে পরিস্থিতি জটিলতর আকার ধারণ করবে।

করোনা এমন এক জীবাণু, যা বিদায় নিলে সব দেশ থেকেই নিতে হবে। যদি কোনো কোনো দেশে থেকে যায়, তা অন্যান্য দেশের জন্যও ঝুঁকি, যদি আমরা মনে করি কোনো রকমে বাংলাদেশ থেকে তো করোনা পালিয়েছে, অন্যেরা মরে মরুক, তা খুব ভুল চিন্তা। যেসব দেশের ব্যাংকে আমাদের ভাগ্যবানেরা টাকা পাচার করেছেন, যদি সেসব দেশে করোনা থেকে যায়, আমাদের ব্যবসায়ী ও কালোটাকার মালিকদের জন্য তা কোনো সুসংবাদ নয়। সুইজারল্যান্ডে আজ পর্যন্ত মারা গেছেন ১ হাজার ৮৮০ জনের বেশি। 

পৃথিবীতে এখন যাঁরা মোড়লের ভূমিকা পালন করছেন, বুদ্ধিবৃত্তির দিক থেকে তাঁরা যেমন অসামান্য নন, উঁচু মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষও নন নিম্ন মাঝারি বা তার চেয়েও নিচের স্তরের মানুষ। তাঁদের নেই কোনো মানবতাবাদী জীবনদর্শন ও নৈতিক মূল্যবোধ। মানবজাতির ভবিষ্যতের প্রতি তাঁদের কোনো অঙ্গীকার নেই। সুতরাং করোনার প্রকোপ প্রশমিত হলেও পৃথিবীর পুনর্গঠনে তাদের ভূমিকা থাকবে, তা আশা করা যায় না।

শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্ব নয়, পশ্চিমে এখন নোয়াম চমস্কি ছাড়া সাহসী ও প্রভাবশালী চিন্তাবিদ নেই বললেই চলে। যাঁরা আছেন তাঁরা বইপত্র লেখেন, ওই পর্যন্তই, তার বাইরে তাঁদের কোনো ভূমিকা নেই। গত শতাব্দীতে বার্ট্রান্ড রাসেল, জাঁ-পল সার্ত্রে এবং তাঁদের সহযোগীরা ছিলেন।

অতীতের মতো এবার আর পুঁজিবাদী ব্লক আর সমাজবাদী শিবির বলে কিছু থাকবে না যে তার একটিতে ভিড়ে যাওয়া যাবে। আমাদের ভাগ্য আমাদেরই গড়ে নিতে হবে। জাতির প্রাণশক্তি বাড়াতে হবে। হতাশাগ্রস্ত মানুষের যেমন রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায়, নৈরাশ্যপীড়িত জাতির পক্ষেও একটি স্থায়িত্বশীল অর্থনীতি ও সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।

সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক ও গবেষক