'অসুস্থ হবার টাইম এটা না'

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

শিরোনামটি সদ্য প্রয়াত সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব সা’দত হুসাইনের পুত্র সাহজেব সা’দতের ফেসবুক স্ট্যাটাসের প্রথম লাইন। স্ট্যাটাসটিতে তিনি একই সঙ্গে বাবা ও মা উভয়ের অসুস্থ হওয়ার পর বিভিন্ন হাসপাতালে নিজের অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়ে অন্যদের সতর্ক করেছেন। উল্লেখ্য, তাঁর মা–ও গত মঙ্গলবার পরলোকগমন করেছেন।

সাহজেব সা’দতের কথা

তদবির না করলে আইইডিসিআর থেকে সহজে নমুনা সংগ্রহ করতে কেউ আসে না। নমুনা পরীক্ষার ফল না আসা পর্যন্ত সব হাসপাতালের ডাক্তাররা রোগীকে করোনা রোগী মনে করেন। ফলে মূল রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা বিলম্বিত হয়। কোভিড ছাড়া অন্য কোনো কারণে রোগীর শ্বাসকষ্ট হলে বেসরকারি হাসপাতালগুলো তাঁকে ভর্তি করাতে গড়িমসি করে। তাঁর মায়ের ক্ষেত্রে এটা ঘটেছিল। এ ছাড়া পিপিই ও অন্যান্য অযাচিত খরচের ধাক্কা, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অনুপস্থিতি ও অন্যান্য বিষয় উল্লেখ করে তিনি সবাইকে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে, হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের কাছ থেকে এ সময় শত হস্ত দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।

ডা. সুস্মিতা আইচের আক্ষেপ

সুস্মিতার বাবা সরকারের অতিরিক্ত সচিব গৌতম আইচের কিডনির সমস্যা ছিল। ল্যাবএইডে ডায়ালাইসিসের সময় সমস্যা দেখা দিলে তারা রোগীকে আইসিইউ সাপোর্ট দিতে পারবে না জানিয়ে ভর্তি করতে অস্বীকৃতি জানায়। সুস্মিতা তাঁর বাবাকে নিয়ে নানা সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ঘুরে ভর্তি করাতে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করান। শুক্রবার সন্ধ্যা সাতটা থেকে তাঁর বাবার অক্সিজেনের ঘাটতি শুরু হয়। তাঁর বেডের কাছে কোনো ডাক্তার যাননি। তাঁরা সুস্মিতাকে ওষুধ বুঝিয়ে দেন, মেয়ে বাবাকে ওষুধ খাওয়ান; সুস্মিতার ভাই অক্সিজেন দেন। সুস্মিতার অভিযোগ, বারবার বলা সত্ত্বেও তাঁর বাবার কোভিড-১৯ পরীক্ষা করা হয়নি, এমনকি রোগী মারা যাওয়ার পরও। তিনি আইসিইউ সাপোর্টও পাননি।

চিকিৎসকের বাবা শুধু নয়, কয়েকজন চিকিৎসকও রোগাক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা পাননি। সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক মো. মঈন উদ্দিন কোভিডে আক্রান্ত হয়ে নিজের হাসপাতালেই চিকিৎসা পাননি বলে অভিযোগ আছে। তাঁকে ঢাকায় আনার পরও তিনি যথাসময়ে চিকিৎসাসেবা না পেয়ে মারা গেছেন। মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল ফরেনসিক মেডিসিনের প্রফেসর ম আনিসুর রহমানও আইসিইউ পাননি।

ক্ষুব্ধ জিয়া হায়দার

বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তা জিয়া হায়দারের অভিযোগ, তাঁর মা অসুস্থ হলে কোভিড টেস্ট সার্টিফিকেট না থাকায় হাসপাতালগুলো চিকিৎসা দেয়নি। একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভেন্টিলেটরে চিকিৎসাধীন থাকাকালে কোভিড টেস্ট পজিটিভ হওয়ায় তাঁকে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানেও চিকিৎসা না পেয়ে অবশেষে তিনি মারা যান। কোভিড টেস্ট পরীক্ষায় তাঁর মায়ের প্রথমে নেগেটিভ, পরে পজিটিভ ও আবার নেগেটিভ রিপোর্ট পাওয়া যায়। জিয়া হায়দার প্রধানমন্ত্রীর কাছে হাসপাতালটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চিঠি ও হাসপাতালকে উকিল নোটিশ পাঠিয়েছেন।

চিকিৎসকদের কথা

এখন চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউ প্রধান ডা. শাহজাদ হোসাইন মাসুম জবাবে লিখেছেন, ‘প্রতিটি মৃত্যুই চিকিৎসকের পরাজয়, একটি পারিবারিক, মানবিক বিপর্যয়।—আমার কাছে মনে হয় চলমান এই বিপর্যয়কে ঠেকানোর জন্য আমাদের একটা জিনিসের প্রয়োজন ছিল, একটি শক্তিশালী স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, যা তৈরির দায়িত্ব ডাক্তারদের হাতে কখনোই ছিল না। আজও পর্যন্ত সাসপেক্টেড রোগীদের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যবস্থা হয়নি। আপনারা দোষ ডাক্তারদের দিয়েই যাচ্ছেন। সমস্যাটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।’

আমলাদের দোষারোপ

আমলাদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আছে: আমলারাই স্বাস্থ্য খাতের বারোটা বাজিয়েছেন। কিন্তু অনেকে জানেন না, ১৯৯৬ সাল থেকে মন্ত্রীরা মন্ত্রণালয় বা বিভাগের প্রধান নির্বাহী, সচিবেরা নন। স্বাস্থ্য খাতের দায়িত্বে আগে চিকিৎসকেরা ছিলেন। কিন্তু তখন কি এ খাতের অবস্থা ভিন্ন ছিল? আমলারা সহজ টার্গেট, কেননা সিদ্ধান্তগুলো তাঁদের স্বাক্ষরে প্রচারিত হয়।

 তবে আমলাদেরও দোষ আছে। আজকাল রাজনীতিবিদেরা আমলাদের দলীয় আনুগত্য ও দুর্নীতিতে সহযোগিতা চান। তাই ব্যাচের সেরা কর্মকর্তাটি এখন আর সচিব হন না। আইন ও বিধি মেনে চলা নীতিমান কর্মকর্তাটি ছিটকে পড়েন। অনিয়মের প্রতিবাদ করলেই ওএসডি, বদলি, বিরোধী দলের সমর্থকের তকমা। ওপরে উঠে যাচ্ছেন জি-হুজুর টাইপ, দুষ্কর্মের সহযোগী কর্মকর্তারা। তাই এখন আর সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্ত হয় না।

স্বাস্থ্য খাতের নেতৃত্ব

একজন চিকিৎসক কিংবা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এ খাতের নেতৃত্ব দিতে পারেন, তবে তা অপরিহার্য নয়। করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে সফল দেশ নিউজিল্যান্ডের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডেভিড ক্লার্ক দর্শন ও ধর্মতত্ত্বে পিএইচডি। আরেক সফল দেশ ভিয়েতনামের ভারপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইংরেজি পড়েছেন। ভারতের কেরালা রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী স্কুলশিক্ষক ছিলেন। চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বা অন্য যে কেউই এ বিভাগের নেতৃত্বে থাকবেন, তাঁর জনস্বাস্থ্য ও মানুষের জীবনের প্রতি গভীর মমত্ববোধ থাকতে হবে।

আরেকটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের দায়িত্বে যিনি যখন ছিলেন, তখন তাঁর পরিবারের সদস্যদের এ খাতে ব্যবসা, নিয়োগ, পদায়নের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে। এ ধরনের ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য খাতের নেতৃত্বে থাকা উচিত নয়।

স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ

২০০১-০২ অর্থবছর থেকে জিডিপির প্রায় ১ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ হয়ে আসছিল। কিন্তু পাঁচ-ছয় বছর এ খাতের বাজেট বরাদ্দ কমেছে। গত ২০ অর্থবছরের অধিকাংশ বছরেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তার বরাদ্দ পুরোটা ব্যবহার করতে পারেনি। গড়ে প্রায় ১০ শতাংশ বাজেট অব্যবহৃত থেকেছে, যার পরিমাণ প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। জিডিপির অনুপাতে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় অবশ্যই বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে সরকারি ব্যয়ের গুণগত মান বাড়ানোর উদ্যোগ বিশেষভাবে জরুরি। শুধু হাসপাতালের শয্যা বাড়ানো নয়, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম সংগ্রহ, নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ করতে হবে। সংগৃহীত সরঞ্জাম যাতে কাজ করে, তা নিশ্চিত করতে হবে। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবীদের আবাস, যাতায়াত, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।

 স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মেডিকেল এডুকেশন শাখার হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. আবজাল হোসেনের দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অর্থসম্পদ অর্জনের কথা আমরা দুদক থেকে জেনেছি। এমন দুর্নীতিবাজ ও তাঁদের মুরব্বিদের বহাল তবিয়তে রেখে শুধু অর্থ বরাদ্দ বাড়ালে তা
ফলপ্রসূ হবে না।

 নেতা-নেত্রীরা সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন। সরকারি কোষাগার থেকে বিদেশে চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। স্বাচিপ ও ড্যাব স্বেচ্ছায় নিজেদের বিলুপ্তি ঘোষণা করতে পারে। সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের নন-প্র্যাকটিসিং অ্যালাউন্স বা হাসপাতালে প্র্যাকটিস করার সুযোগ দিতে হবে। নামী চিকিৎসকদের হয় বেসরকারি ক্লিনিকে প্র্যাকটিস অথবা সরকারি চাকরি—এ দুইয়ের একটি বেছে নিতে হবে।

 প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো মহামারি মোকাবিলার জন্য সার্বক্ষণিক প্রস্তুতি ও আর্থিক বরাদ্দ রাখতে হবে। এ ধরনের জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় সরকারি, বেসরকারি ও এনজিও খাতের কাজের সমন্বয় করতে হবে। টিকাদান কর্মসূচির পাশাপাশি দরিদ্র মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।

 মোট কথা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর সময় এটা।

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: সাবেক সচিব