আম্পান মোকাবিলার জরুরি চ্যালেঞ্জগুলো

হঠাৎ করেই করোনাকে ২ নম্বরে ফেলে মিডিয়ার মনোযোগের দখল নিয়েছে আম্পান। থাই ভাষায় নাকি ‘উম-পুন’। নাম যা–ই হোক, এই মুহূর্তে (বেলা একটা, ১৯ মে) আম্পান ওড়িশার পারাদ্বীপ থেকে মাত্র ৪৮০ কিলোমিটার দূরে। পশ্চিম বাংলার দিঘা থেকে ৬৩০ কিলোমিটার আর আমাদের খেপুপাড়া আবহাওয়া অফিস থেকে ৭৫০ কিলোমিটার দূর থেকে এগিয়ে আসছে। এখন ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৯০ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা গতিবেগ সর্বোচ্চ ২২৫ কিলোমিটার, যা ঝোড়ো হাওয়ার বেগে ২৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে শেষ পর্যন্ত মাটিতে নামার সময় আম্পানের গতি থাকতে পারে প্রতি ঘণ্টায় ১৫৫ থেকে ৬৫ কিলোমিটার। মাঝেমধ্যে দমকার সময় এটা ১৮০ কিলোমিটারও ছাড়িয়ে যেতে পারে।

আম্পান বর্ণচোরা করোনার মতো ইতিমধ্যেই কয়েকবার সে তার রূপ বদলেছে। এখন পর্যন্ত প্রায় সাতবার সে নানাভাবে মোচড় দিয়ে তার গতিপথ এদিক–ওদিক করেছে। নিম্নচাপ থেকে বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়ার পর আম্পানের গতিমুখ ছিল উত্তর-পশ্চিম দিকে। এখন তা বাঁক নিয়ে সরাসরি অবিভক্ত সুন্দরবনের দিকে এগিয়ে আসছে। সোমবার আম্পান শক্তি বাড়িয়ে ‘সুপার সাইক্লোনে’ পরিণত হয়েছিল। আজ কিছুটা শক্তি হারিয়ে, এখন ‘খুবই মারাত্মক ঘূর্ণিঝড়ে’ (এক্সট্রিমলি সিভিয়ার সাইক্লোন) রূপ নিয়েছে। ফলে সমুদ্র থেকে যখন স্থলভাগে আম্পান নামতে থাকবে, তখন তার প্রবল গতি নানা ক্ষতির কারণ ঘটাতে পারে। যদিও এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না, ঠিক কোথায় আম্পান তার মরণ ছোবলটা দেবে। তবে পশ্চিমবঙ্গ লাগোয়া আমাদের সুন্দরবন জেলা সাতক্ষীরা আর বাগেরহাটে সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে।

জবরদস্ত প্রস্তুতির কথা আমরা জেনেছি। সরকার তার সাধ্যমতো চেষ্টা আগেও করেছে এবারও করবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। করোনা মোকাবিলাতেও সরকারের সদিচ্ছার কোনো ঘাটতি আছে বলে মনে হয় না। যেটার ঘাটতি সেটা হচ্ছে, যেটা যখন করা দরকার সেটা তখন করতে না পারা। পরিস্থিতি যথাযথ মূল্যায়ন না করে একটা কর্মকৌশল ঠিক না করে ‘আমি সব জানি সব পারি’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রবণতা।

আম্পান মোকাবিলার চ্যালেঞ্জগুলো কী?
সময়টা করোনার। এক এক উপকূলীয় জেলার পরিস্থিতি একেক রকম। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা জেলা সাতক্ষীরায় করোনা সামাজিক সংক্রমণের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। আলামত দেখে সন্দেহ হওয়ায় যতজনকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল, তাঁদের প্রায় সবাই করোনা আক্রান্ত ছিলেন বলে দেখা গেছে। এর মধ্যে ২৩ জনই দেবহাটা উপজেলার বাসিন্দা।

নতুন আক্রান্তরা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরফেরত ইটভাটা ও গার্মেন্টসে কাজ করতেন। তাঁদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। এরপর তাঁদেরও নমুনা পরীক্ষা করা হবে। এসবই সামাজিক সংক্রমণের আলামত। আমাদের সাইক্লোন সুরক্ষার সোনালি চাবি একটাই: মানুষকে জোরজবরদস্তি করে এক–দেড় দিন আগে সাইক্লোন শেল্টারে তুলে দেওয়া। এই মুহূর্তে হয়তো আর কোনো উপায়ও নেই। তবে একটা পদক্ষেপ নেওয়া যেতেই পারে। আমরা মানুষকে শেল্টার–ভর্তি করার সময়টা অন্তত কমিয়ে আনতে পারি। ৩৬ ঘণ্টা আগে তাঁদের না এনে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা আগে আনার ব্যবস্থা করা যায়। অর্থাৎ গাদাগাদি করে থাকার সময়টা কমিয়ে আনা যায়। তাতে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি কমতে পারে।

সাইক্লোন শেল্টার ছাড়াও আর অনেক ব্যক্তিগত দালান, বিদ্যালয়, মসজিদ এবার ব্যবহার করতে হবে। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসন ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যেমন সাতক্ষীরা জেলার ১৪৭টি সাইক্লোন শেল্টারের সঙ্গে আরও ১ হাজার ৭০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রস্তুত করার কথা বলা হয়েছে। এই প্রস্তুত মানে কি শুধু তালা খুলে দেওয়া? না করোনার কথা মাথায় রেখে কোনো বিশেষ ব্যবস্থার আয়োজন করা। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মসজিদ আছে, যার ওপরে ওঠার সিঁড়ি নেই। এখনই বাঁশ দিয়ে সেসব জায়গায় অস্থায়ী সিঁড়ি তৈরি করা প্রয়োজন।

করোনার জন্য কী সেই বিশেষ ব্যবস্থা?
প্রত্যেকের জন্য মাস্ক বা বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে নাক–মুখ ঢাকার জন্য রুমাল, টুকরা গামছার ব্যবস্থা করতে হবে। রোজার সময় বারবার কফ–থুতু ফেলে নিজেকে শুদ্ধ রাখার একটা মজ্জাগত বদভ্যাস আমাদের আছে। এ বিষয়ে যথেষ্ট সাবধান করার পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রত্যেকের জন্য সাবান–পানির ব্যবস্থা করতে হবে। আধা লিটারের একটা ব্যবহৃত পানির বোতলে এক চা–চামচ পরিমাণ গুঁড়া সাবান দিয়েই এই দ্রবণটি তৈরি করা যায়।

সময়টা রাত আর মরা চাঁদের জোয়ারের
মে মাসের ২০ তারিখে জোয়ার লাগবে রাত ৯টা ২১ মিনিটে। এই সময় জোয়ারের স্বাভাবিক উচ্চতা হওয়ার কথা ৯.৬৫ ফুট বা ২.৯৪ মিটার। পণ্ডিতেরা আলামত বিশ্লেষণ করে বলছেন, আম্পান যদি জোয়ারের সময় তসরিফ রাখে, তাহলে পানির উচ্চতা আরও তিন মিটার বেড়ে যেতে পারে অর্থাৎ প্রায় দোতলাসমান পানি হবে। তার কী প্রস্তুতি হবে?

খাবারের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত কী?
করোনা পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে শেল্টারে খাবার বিতরণের চিন্তা বাদ দিতে হবে। ৫ থেকে ৭ ঘণ্টা না খেয়ে কেউ মারা যায় না। খাবার বিতরণ, পানির চাহিদা বাড়িয়ে দেয় আর সংক্রমণের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। মানুষ খাবারের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রে আসে না। গত ৫ থেকে ৬ বছরে খাবার দেওয়ার রেওয়াজ চালু করা হয়েছে। এতে অপচয়, চুরি আর অপশাসনের সুযোগ তৈরি হয়েছে।

সর্বশেষ আলামত বলছে, বুধবার অর্থাৎ শবে কদরের সকাল থেকেই প্রবল ঝোড়ো হাওয়া বইতে শুরু করবে। ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হবে তার গতি। সাতক্ষীরা, সুন্দরবন, বাগেরহাট জেলায় ঝড়ের গতিবেগ সাধারণত ঘণ্টায় ১৬৫ থেকে ১৭৫ কিমি থাকতে পারে। তবে সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১৮৫ কিলোমিটার পর্যন্তও হতে পারে কখনো কখনো। আশপাশের জেলাগুলোতে ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার বেগে ঝড় বয়ে যেতে পারে। বৃষ্টি হবে প্রচুর। আগের সাইক্লোনগুলোর মতো গাছ চাপা পড়ে বেশি মানুষের আহত–নিহত হওয়ার শঙ্কা এবারও থেকে যাবে। নষ্ট হবে গবাদি প্রাণী।

সাইক্লোন শেল্টার যে আমাদের সমস্যার সমাধান নয়, সেটা আরেকবার প্রমাণের জন্যই বোধ হয় করোনায় কাবুদের ওপর সাইক্লোনের ঘা দিতেই আম্পান আসছে। এক সাইক্লোন শেল্টারের টাকায় যখন ৩৫টি সাইক্লোন সহনীয় বাড়ি করে এক সাইক্লোন শেল্টারের দ্বিগুণ মানুষের প্রাণ আর সম্পদ রক্ষা করা সম্ভব। সেটা আমরা করি না কেন। ভিয়েতনাম পারলে আমরা কেন পারি না?

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক গবেষক
[email protected]