কৃষিতেই আশা

করোনাকালের মহাবিপর্যয়ের মধ্যে মার্কিন কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ) পূর্বাভাসে বাংলাদেশের জন্য একটি আশার বাণী শুনিয়েছে। ধারাবাহিকভাবে ধান উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ তৃতীয় বৃহত্তম ধান উৎপাদনকারী দেশ হতে যাচ্ছে। এত দিন চীন ও ভারতের পরই তৃতীয় স্থানে ছিল ইন্দোনেশিয়া। ইউএসডিএর প্রতিবেদনমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে সারা বিশ্বে ধানের উৎপাদন ৫০ কোটি ২০ লাখ টন ছাড়াতে পারে। এর মধ্যে চীনে ১৪ কোটি ৯০ লাখ টন, ভারতে ১১ কোটি ৮০ লাখ টন এবং বাংলাদেশে ৩ কোটি ৬০ লাখ টন ধান উৎপাদন হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণ।

এসব তথ্য আমাদের জন্য স্বস্তিদায়ক। কিন্তু এর পাশাপাশি অস্বস্তির খবর হলো বাংলাদেশে ধানসহ কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়লেও কৃষকের দুরবস্থা কাটেনি। বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে যেমন তঁারা বিপদে পড়েন, তেমনি সময়মতো ধান কাটতে না পারা, বাজারে ন্যায্য দাম না পাওয়ার কারণেও ক্ষতিগ্রস্ত হন।

চলতি বছর করোনা সংকটের কারণ হাওরের ধান কাটা নিয়ে যে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল, সেটি মোটামুটি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যাচ্ছে, বোরো ধানের ৬৫ শতাংশ কাটা হয়েছে। বাকি ৩৫ শতাংশ এখনো খেতে রয়ে গেছে। ঘূর্ণিঝড় আম্পান আজ বুধবার সন্ধ্যায় বা রাতে আঘাত হানতে পারে। এটি যে মাত্রার ঘূর্ণিঝড়, তাতে ব্যাপক ফসলহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে জরুরি ভিত্তিতে ধান কাটা ও কীভাবে সংরক্ষণ করতে হবে, সে ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এই কাজ ঠিকমতো করা না গেলে ও আম্পানের আঘাত ভয়াবহ হলে বোরো ধানের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বাধাগ্রস্ত এবং সামগ্রিকভাবে সব ধরনের ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

বাংলাদেশের কৃষকেরা বরাবরই তাঁদের উৎপাদিত ফসল বাজারজাত করার ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়েন। তা ধান, টমেটো, পেঁয়াজ, আলু বা তরমুজ যা–ই হোক না কেন। ধানের মৌসুমের শুরুতে সরকার কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কিনলে কৃষকের ন্যায্য দাম পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অন্যথায় আড়তদার ও চালকলমালিকেরাই লাভের গুড় খেয়ে নেয়। এবার কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনার ওপর জোর দিতে হবে।

ন্যায্য দাম না পাওয়ায় কৃষক গত তিন বছর লোকসান দিয়েছেন। তারপরও তাঁরা চাষ অব্যাহত রেখেছেন এবং ধান উৎপাদনে বাংলাদেশকে তৃতীয় স্থানে নিয়ে এসেছেন। আমরা বিশ্বাস করি, কৃষক প্রয়োজনীয় সমর্থন ও সহযোগিতা পেলে ধানের উৎপাদন আরও বাড়াতে সক্ষম হবেন। এ জন্য কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করাসহ কৃষিপণ্যের পরিবহন ও বাজারজাতকরণ প্রতিটি স্তরে নজরদারি বাড়াতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সময় কৃষি এবং কৃষকই প্রধান ভরসা। করোনা সংকটের প্রেক্ষাপটে বিশ্ব খাদ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকটের আশঙ্কা করছে। বাংলাদেশ যদি সেই সংকট থেকে দূরে থাকতে পারে, তবে সেটা হবে আমাদের বিরাট সাফল্য।

উন্নয়ন নীতি-পরিকল্পনায় কৃষিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রয়োজনে কৃষিতে ভর্তুকির মাত্রা বাড়িয়ে উৎপাদন বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। গত শনিবার কৃষি মন্ত্রণালয়ে মৌসুমি ফল ও কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণে অনলাইনে (জুম প্ল্যাটফর্ম) যে মতবিনিময় করা হয়, তাতে নীতিনির্ধারকেরা কৃষিপণ্যের পরিবহন নির্বিঘ্ন করার ওপর জোর দিয়েছেন। প্রয়োজনে কৃষিপণ্য পরিবহনে ব্যবহৃত জ্বালানিতে ভর্তুকি দেওয়ার কথাও বলেছেন কেউ কেউ। আশা করি, উদ্যোগটি সেমিনারের মধ্যেই সীমিত থাকবে না।