করোনা-পরবর্তী স্বাস্থ্যব্যবস্থা সর্বজনীন করতে হবে

বলা হয়, প্রতি সংকটেরই একটা ইতিবাচক দিক থাকে। ১৯৭১ সালের সশস্ত্র সংগ্রামের ফসল স্বাধীনতা, বাঙালির নতুন করে এগিয়ে যাওয়া। ২০২০ সালে আমরা এক নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মতো করোনাভাইরাস আমাদের জাঁকিয়ে বসেছে। প্রতিদিনই অনেক লোক সংক্রমিত হচ্ছে; মৃত্যুর ঘটনাও বাড়ছে। স্বস্তির কথা হলো ইউরোপ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এ মহামারি অনেকাংশে স্তিমিত হয়ে এসেছে। আমাদের দেশেও তাই হবে, তবে সেটা কবে শুরু হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। 

কোভিড-১৯ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে তছনছ করে দিয়েছে। যেসব দেশ তাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে গর্বিত ছিল, তারাও এখন এর দুর্বলতা দেখে অনেকটা অস্বস্তিতে আছে। আর আমাদের মতো দেশের কথা তো বলাই বাহুল্য। করোনা আমাদের দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিভিন্ন ত্রুটি আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে যাচ্ছে। এগুলোর মধ্যে আছে নতুন রোগের প্রাদুর্ভাব শনাক্তকরণে দুর্বলতা, চিকিৎসক ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর স্বল্পতা, অতি প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি ও ওষুধপথ্যের অপ্রতুলতা ইত্যাদি। বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ, কিন্তু আমরা সেসব দুর্যোগ বারবার সফলভাবে কাটিয়ে পৃথিবীতে একটি রোল মডেল হিসেবে পরিচিত হয়েছি। কিন্তু করোনার ব্যাপারটি পুরোপুরিই আলাদা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে যারপরনাই বেগ পেতে হচ্ছে। আমরাও এর থেকে আলাদা নই। অনেক দেশের তুলনায় আমরা একটু দেরিতে শুরু করলেও প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আমরা এটা মোকাবিলার দিকে ধীরভাবে এগিয়ে যাচ্ছি। করোনার বর্তমান উপদ্রব কমে আসবে বলে আমাদের বিশ্বাস। যদিও বিশ শতকের প্রথম দিকের স্প্যানিশ ফ্লুর মতো করোনা আবারও ফিরে আসতে পারে, হয়তো আরও ভয়ংকর কোনো রূপ পরিগ্রহ করে।

এমডিজিতে বাংলাদেশের অর্জন অনেক, অনেকের ঈর্ষার কারণ। বলা বাহুল্য, করোনা পরিস্থিতি আমাদের আরও এগিয়ে যাওয়ার গতিকে বাধাগ্রস্ত করবে। আমাদের সামনে রয়েছে এসডিজি, যা ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জন করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

করোনা পরিস্থিতি বাংলাদেশকে তার স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে নতুন করে সাজিয়ে তোলার একটা সুযোগ এনে দিয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় তিন-চার কোটি লোক দরিদ্র পর্যায়ে পড়ে। করোনা সংকট এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে। মনে করা হচ্ছে আগামী দুই-তিন বছরে দেশের গরিব জনগণের সংখ্যা প্রায় পাঁচ কোটিতে গিয়ে ঠেকবে। এসডিজি তথা ২০৪১ সালের মধ্যে যদি আমরা উন্নত দেশের পর্যায়ে পৌঁছাতে চাই, তাহলে এদের সবাই তথা দেশের প্রত্যেকের জন্য সহজলভ্য উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে এটা শুধু জনগণের সরকারই নিশ্চিত করতে পারে। বাংলাদেশে যে স্বাস্থ্যব্যবস্থা আমরা তৈরি করেছি, তা সব মানুষের কাছে সমানভাবে অভিগম্য নয়। বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যজনিত আঘাত বা শক বছরে প্রায় তিরিশ লাখ লোককে গরিবের কাতারে ঠেলে দিচ্ছে। করোনার ফলে এই সংখ্যা আরও বেড়ে যাওয়ারই কথা। আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ‘সর্বজনীন’ বলা হলেও স্বাস্থ্যসংক্রান্ত খরচে সাধারণ মানুষকে প্রায় ৭৪ শতাংশ নিজের পকেট থেকে গুনতে হয়। এটা তো ‘সর্বজনীন’ স্বাস্থ্যব্যবস্থা হলো না। তাই করোনা-পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে এবং সেটাকে প্রকৃত অর্থেই সর্বজনীন করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে, দেশের সব নাগরিক যেন নিখরচায় সব ধরনের স্বাস্থ্যসেবা সহজেই পেতে পারে। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সময়ই সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বা ইউনিভার্সেল হেলথ কভারেজের (ইউএইচসি) একজন প্রবক্তা। ২০১২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ইউএইচসি–সংক্রান্ত প্রস্তাবে বাংলাদেশ স্বাক্ষরদাতা। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে নিউইয়র্কে উচ্চপর্যায়ের সভায় ইউএইচসির পক্ষে প্রধানমন্ত্রী স্বাক্ষর দেন। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতি রক্ষায় সরকারের কিছুটা গড়িমসি লক্ষ করা যায়। করোনা পরিস্থিতির কারণে সরকারের প্রতিশ্রুতি আবারও নতুন করে উচ্চারিত হচ্ছে।

বাংলাদেশে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সরকারের বিনিয়োগ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবমতে সর্বনিম্ন, পৃথিবীর পরিমণ্ডলে সবচেয়ে কম। এই যখন অবস্থা, তখন আমরা আর কতটুকুই আশা করতে পারি। আমরা যদি আরও সামনে এগিয়ে যেতে চাই, তাহলে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়াতেই হবে। করোনা সংকট আমাদের দেখিয়েছে যে সরকার চাইলে স্বাস্থ্য খাতের জন্য বাড়তি জোগান দেওয়া সম্ভব। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি যেসব প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন, তা আমাদের জিডিপির প্রায় ৩ দশমিক ২ শতাংশ। সরকার চাইলে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বর্তমান বিনিয়োগ শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ থেকে পর্যায়ক্রমে ২ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত করতে পারে। কিন্তু অর্থায়নে এই পরিবর্তন আনতে সরকারের সর্বোচ্চ আগ্রহ ও অঙ্গীকার প্রয়োজন। 

করোনা যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে তা থেকে উত্তরণে এবং ভবিষ্যতে এগিয়ে চলতে এই অঙ্গীকারের কোনো বিকল্প নেই। দেশ এখন এই পরিবর্তনের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত—অর্থনৈতিকভাবেও। প্রয়োজন শুধু সরকারের সদিচ্ছা। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বা ইউএইচসি বাস্তবায়নের মূল চাবিকাঠি হলো কীভাবে স্বাস্থ্যব্যবস্থা অর্থায়িত হবে। বর্তমানের অবস্থা অনেকটা জগাখিচুড়ির মতো। জনগণ স্বাস্থ্যসেবা পেতে নানাভাবে অর্থ প্রদান করে, যা সব সময়ই গরিব জনগোষ্ঠীর স্বার্থের বিপরীতে যায়। ইউএইচসি হয়ে গেলে সরকারই হবে সব (বা
বেশির ভাগ) খরচের জোগানদাতা। এই ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া পৃথিবীর সব উন্নত দেশে রয়েছে। বাংলাদেশ যে এই নতুন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে তার প্রমাণ মেলে অনেক দেশের দৃষ্টান্ত থেকে। অর্থনৈতিকভাবে সমগোত্রীয় শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম ও মরক্কো ইউএইচসি বাস্তবায়ন করেছে। থাইল্যান্ড ২০০২ সালে যখন ইউএইচসি বাস্তবায়ন করে, তখন তাদের জাতীয় আয় ছিল বর্তমান বাংলাদেশের সমান। বাংলাদেশ ইউএইচসি বাস্তবায়নে তাই পুরোপুরি উপযুক্ত এবং অর্থনৈতিকভাবে প্রস্তুত। ২০২০ সালে করোনার কারণে বেশ কিছু দেশ ইউএইচসি বাস্তবায়নে তৎপর হচ্ছে, যার মধ্যে আছে আয়ারল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকা। বাংলাদেশও এই তালিকায় আসতে পারে। 

বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনেকটা একক নেতৃত্বে এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা চলছে। দেশকে উত্তরোত্তর উন্নয়নের পথে নিয়ে যেতে তাঁর অঙ্গীকার এবং বলিষ্ঠ নেতৃত্বের সঙ্গে সবাই পরিচিত। ২০৪১ সালে যখন আমরা উন্নয়নের পরম পর্যায় তথা উন্নত দেশগুলোর কাতারে নাম লেখাব, তখন স্বাস্থ্যব্যবস্থা একটি নিয়ামক হিসেবে চিহ্নিত হবে। আর এর জন্য প্রস্তুতি দরকার এখনই। করোনা-পরবর্তী এই রূপান্তরকে এগিয়ে নিতে প্রয়োজন বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর মতো একটি দূরদর্শী ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব। বৈশ্বিক অবস্থাদৃষ্টে এটা নিশ্চিত বলা যায় যে পরবর্তী ২০ বছরে বাংলাদেশে ইউএইচসি বাস্তবায়িত হবে। যেহেতু দেশ এখনই এই রূপান্তরের জন্য প্রস্তুত, তাই আর অপেক্ষা কেন। ইতিহাসে ‘ইউএইচসি হিরো’ হিসেবে নাম লেখাতে তাই এখনই শেখ হাসিনার দৃঢ়ভাবে এগিয়ে আসা উচিত হবে। বাংলাদেশে এখন আমরা মুজিব বর্ষ উদ্‌যাপন করছি। আগামী বছর ২০২১ সাল আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। তাই আর দেরি না করে এখনই ইউএইচসি বাস্তবায়ন শুরু করা সমীচীন হবে। জাতির পিতার স্মৃতি এবং স্বাধীনতার বিশেষ পূর্তিকে স্মৃতিবহ করতে এই উদ্যোগের নাম হতে পারে বঙ্গবন্ধুসেবা বা সুবর্ণসেবা। এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। 

মোশতাক চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও ব্র্যাক স্কুল অব পাবলিক হেলথের প্রতিষ্ঠাতা ডিন
রবার্ট ইয়েটস যুক্তরাজ্যভিত্তিক চেথাম হাউসের নির্বাহী পরিচালক, ইউনিভার্সেল হেলথ কেয়ার