মরিবার সাধ হলে, রুধিবে কে?

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে ফেরিতে ঠাসাঠাসি করে গ্রামে ছুটছে মানুষ। ছবিটি বুধবার দৌলতদিয়া ঘাট এলাকা থেকে তোলা। ছবি: প্রথম আলো
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে ফেরিতে ঠাসাঠাসি করে গ্রামে ছুটছে মানুষ। ছবিটি বুধবার দৌলতদিয়া ঘাট এলাকা থেকে তোলা। ছবি: প্রথম আলো

প্রাসঙ্গিক বলে শৈশব স্মৃতি দিয়েই শুরু করি। গারো পাহাড় লাগোয়া, ভারত সীমান্তের গা ঘেঁষা নানা বাড়িতে আমার জন্ম। জন্মের পর থেকে পাহাড়চূড়াই দেখেছি। আর সীমান্ত গ্রাম বলে পেছানোর পথ নেই। পেছালেই ভিনদেশ। কাজেই পাহাড়ের চূড়ায় ওঠা আর কেবলই সামনের দিকে এগোনো আমার জন্ম থেকেই নির্ধারিত নিয়তি।

ছোটবেলাতেই দেখতাম নানা বাড়িতে একজনকে। নুরু তার নাম। পুরো নাম কোনো দিন শুনিনি। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী কিন্তু তার নিজস্ব বুদ্ধিমত্তায় সে খুশি। সেই নুরুর গায়ে অমিত শক্তি। যেকোনো কাজ করতে শুধু নির্দেশের অপেক্ষা। জীবনে একটাই বিনোদন, তা হচ্ছে পেট পুরে খাওয়া।

তো সেই নুরু গেছে ঈদের চাঁদ দেখতে। খোলা মাঠ থেকে ফিরলে জিজ্ঞাসা: ‘নুরু মিয়া চাঁদ দেখেছো।’
নুরুর জবাব, ‘চাছা (চাচা) দেখছি কিন্তু লক্ষ করি নাই।’
‘দেখা’ আর ‘লক্ষ’ করার মধ্যে পার্থক্য কি বা কেমন, তাই নিয়ে পণ্ডিতেরা গবেষণা করুন।
বাইরে অঝোর বৃষ্টি। এর মধ্যেই ছাতা ছাড়াই নুরু বাড়িতে যাওয়ার পথ ধরেছে। সবাই বলছে, নুরু ভিজে যাবে তো।
নুরুর সোজা জবাব, ‘ভিজতাম না, বিষ্টির ফোডার (বৃষ্টির ফোটা) মধ্যে মধ্যে ফাঁক আছে না, ওই ফাঁকে ফাঁকেই যামুগা!’ এর জবাব কী? এই হলো নুরু।
বহুকাল গত হয়েছে। কিন্তু নুরু মিয়ার স্মৃতি কড়া নাড়ল ঈদে বাড়িতে যেতে ফেরিঘাটে অগুনতি মানুষের মাথা দেখে। ধারণা করি, এরা সবাই তো বটেই আমরাও সবাই হয়তো নুরু মিয়ার মতোই ভাবছি, করোনাভাইরাসের ফাঁক গলিয়ে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে যাব! সব মহান মানুষ নাকি এক রকমই ভাবেন ।

২.
ঠিক কত লোক ঈদের ছুটির সময় বাড়ি যায়, এই বিষয়ে কোনো সঠিক তথ্য নেই।

প্রায় দুই কোটি মানুষের এই ঢাকা থেকে স্বাভাবিক সময়ে ৮০-৮৫ লাখ মানুষ ঈদে মহানগর ছাড়ে, এমনটি ধারণা করা হয়। এর সঙ্গে দেশের অন্যান্য স্থান থেকে ঈদের ছুটিতে যাতায়াতকারী মিলে এই সংখ্যা এক থেকে সোয়া কোটি হতে পারে। এবার করোনা পরিস্থিতির কারণে এই সংখ্যা কম হবে সন্দেহ নেই। নগরবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম মনে করেন, উৎসব আয়োজনে নগরবাসীর গ্রামমুখী হওয়ার নানা কারণ আছে। এখনো ঢাকার ৬০ ভাগ পরিবারপ্রধানের জন্ম গ্রামে। আবার ঢাকায় যাঁরা মাইগ্র্যান্ট, তাঁদের অধিকাংশের শহরে বাড়ি নেই। তাঁদের পরিবারের একটি অংশ নিজ গ্রামে বা অন্য এলাকায় কাজের জন্য থাকেন। কেউ আছেন, যিনি শুধু নিজেই ঢাকায় থাকেন, পরিবারের সদস্যরা গ্রামে থাকে। এসব কারণে উৎসব আয়োজনে তাঁরা গ্রামে যান। মধ্যবিত্তের একটি অংশ আছে যাদের গ্রাম ও শহর উভয় জায়গায় বাড়ি আছে। তাঁরাও গ্রামে পরিবার নিয়ে যান গ্রাম দেখাতে। কিন্তু যাঁদের গ্রামে বা শহরে কোথাও বাড়ি নেই, তাঁরা আসলে যান না, এঁরা নিম্নবিত্ত মানুষ। তাঁরা ঢাকায় হয়তো বস্তিতে থাকেন। গ্রামে কোনো আশ্রয় নেই। সে কারণেই শহরে এসেছেন। তাঁর ধারণা, ঢাকার ৪০-৫০ ভাগ মানুষ ঈদে গ্রামে যায়, তবে কোনো জরিপ নেই।

যাত্রীকল্যাণ সমিতির মতে, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ঈদের সময় সারা দেশে কমপক্ষে দ্বিগুণ মানুষ যানবাহনে চলাচল করে। ঢাকা থেকে যাওয়া এই সংখ্যা প্রায় ১ কোটি। আর অন্যান্য এলাকা থেকে সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি।

কিন্তু সমস্যাটি সংখ্যা নিয়ে নয়। অন্যবার উদ্বেগ থাকে আগাম টিকিট, যাত্রা পথের দুর্ভোগ, দুর্ঘটনা, নৌডুবি এসব নিয়ে। কিন্তু এবারের উৎকণ্ঠা করোনার সংক্রমণ নিয়ে। কারণ, শুরুর দিকে করোনাভাইরাস এসেছিল বিদেশ থেকে। এখন এটি ঠিকানা করে নিয়েছে স্থানীয়ভাবেই। সামাজিক সংক্রমণ হচ্ছে, বলছেন বিশেষজ্ঞরা। বিষয়টি সংখ্যার নয়, সংক্রমণের। মৃত্যুর শতকরা হিসাব যা-ই বলুক, একটি পরিবারের একজনের মৃত্যু মানে তাদের জন্য ক্ষতি শতভাগ। পরিবারে একজন মারা গেলে শতকরা সংখ্যার হিসাবে তা পরিমাপ করা যাবে না।

মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে সব সংখ্যাই বাড়ছে। মৃত্যুর সংখ্যা এখন ডবল ডিজিটে, প্রতিদিনই ওপরের দিকে। আক্রান্তের সংখ্যাও তা-ই । বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক সংক্রমণ পুরো নকশাই বদলে দিচ্ছে। ঢাকা বা বড় শহর থেকে যাঁরা গ্রামে যাচ্ছেন, তাঁরাই এখন সন্দেহভাজন করোনাভাইরাসের বাহক। কি ঢাকা, কি নারায়ণগঞ্জ, কি চট্টগ্রাম থেকে যাঁরাই বিভিন্ন অঞ্চলে যাবেন, তাঁরাই গন্তব্যের জন্য ঝুঁকি নিয়ে যাবেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা সামাজিক সংক্রমণের ভয়াবহতা নিয়ে স্থানীয়ভাবে চিন্তা করতে পারি।

৩.
শুরুর দিককার কথা বলছি। সামাজিক সংক্রমণের চেহারাটি দেখেই করোনা ভাইরাসের দ্রুত বিস্তার নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের কয়েকটি দেশ চীন থেকে আগত ঠেকাতে সীমানা বন্ধ করে দেয় কঠোরভাবে। যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া ঘোষণা দেয়: চীনে সফরে গেছেন, এমন বিদেশিদের তারা নিজ দেশে প্রবেশ করতে দেবে না। রাশিয়া, জাপান, পাকিস্তান, ইতালিসহ কয়েকটি দেশও একই ধরনের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেছিল। এমনকি খোদ চীনও তাদের সবচেয়ে বড় উৎসব নববর্ষের সব আয়োজন বাতিল করে। উহানকে তো বিচ্ছিন্ন করা হয়ই, দেশের মধ্যেই অন্যান্য শহরের মধ্যেও যাতায়াত সীমিত করা হয় কঠোরভাবে।

এ সময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সীমান্ত পারাপারের আনুষ্ঠানিক স্থানগুলোতে স্ক্রিনিং ব্যবস্থা চালুর পরামর্শ দেয়। সে সময় এই সংস্থার পরামর্শ ছিল: সীমান্ত বন্ধ করে দিলে যাত্রীরা অনানুষ্ঠানিকভাবে বা অবৈধভাবে বিভিন্ন দেশে প্রবেশের মাধ্যমে ভাইরাসের বিস্তার আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাসের প্রথম রোগী শনাক্ত হয় ২০ জানুয়ারি। এর পরই লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি। বেড়েছে মৃতের সংখ্যাও। এখন তো মৃত্যুর হিসাবে তারা এক নম্বরে। চীনে জানুয়ারির শেষের দিকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যখন বাড়ছিল, তখনই ট্রাম্প প্রশাসনকে সতর্ক করেছিল দেশটির রোগনিয়ন্ত্রণ সংস্থা সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)। মার্কিনদের চীন ভ্রমণে সতর্ক করার কথাও তারা বলেছিল। কিন্তু সরকার অনেক দিন সময় পেয়েও শুরুর দিকে এসব উদ্যোগ নেয়নি। পরীক্ষার দায়িত্বও অনেক দিন সিডিসির বাইরে কারও হাতে দেওয়া হয়নি। দক্ষিণ কোরিয়াতেও করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের মতো একই দিনে। কিন্তু সেই একই সময়ে তারা প্রায় ৮ হাজার পরীক্ষা করিয়েছিল, যা তাদের দেশের জনসংখ্যার অনুপাতে প্রতি ১০ লাখে ১৫৪ জন।

এর পরের সপ্তাহগুলোতে পরিষ্কার হয়ে যায় যে বিভিন্ন দেশে সংক্রমণ স্থানীয়ভাবে ছড়াতে শুরু করেছে। দিনে দিনে রোগী বেড়েছে, বাড়ানো হয়েছে সতর্কতা। একপর্যায়ে নিষেধাজ্ঞা। একে একে সবকিছু বন্ধ, লকডাউন। কিন্তু তত দিনে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। পর্যবেক্ষণ বলছে, চীনের সাড়ে চার লাখ পর্যটকের ভ্রমণই যুক্তরাষ্ট্রের সর্বনাশ ডেকে আনে। মার্কিন মুলুকে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরও বিভিন্ন দেশের অন্তত ৪০ হাজার পর্যটক ঢুকে পড়েন। তাঁরা সাধারণ মার্কিনের সঙ্গে মিশে যান। চীনের চেয়ে আরও বেশি করোনাপীড়িত ইতালি, স্পেন ছাড়াও আরও কয়েকটি দেশের লাখ লাখ পর্যটক যুক্তরাষ্ট্রে বিপদ ছড়ান। আন্তর্জাতিক ট্রাভেল ডেটা অনুসারে, করোনার দাপটের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছেন ৩০ লাখ ভ্রমণকারী। করোনার ক্রান্তিকাল ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি—এই তিন মাসে এই বিশালসংখ্যক পর্যটক প্রবেশ করলেও তাঁদের কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষাই করা হয়নি। মার্কিন স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা কল্পনাই করতে পারেননি, গোপনে করোনা বহনকারী বিদেশ থেকে আসা এসব নাগরিকই তাঁদের সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়াবেন।

ইতালির খবর: চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ১৯ ফেব্রুয়ারি আটলান্টা ও ভ্যালেন্সিয়া ম্যাচে বিপুল জনসমাবেশ হয়েছিল। ওই দিন মিলানের সানসিরো স্টেডিয়ামে হাজির ছিলেন ৪০ হাজারের বেশি দর্শক। বার্গামো থেকে দলে দলে মানুষ যান খেলা দেখতে। পরে দেখা যাচ্ছে, করোনাভাইরাসে ইতালিতে সবচেয়ে আক্রান্ত শহর এই বার্গামোই। ইতালির চিকিৎসকদের এখন মনে হচ্ছে, এই বিপুল জনসমাবেশ থেকেই দ্রুত ছড়িয়ে থাকতে পারে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। ইতালির ক্লাবের জয় দেখে সে দিন উৎফুল্ল জনতা একে অপরকে জড়িয়ে ধরেছিল, হাতে হাত মিলিয়ে উৎসব করছিল। তাতেই সর্বনাশ হয়ে থাকতে পারে বলে শঙ্কা। ওই ম্যাচে ৪০ হাজার মানুষ গা ঠ্যাসাঠেসি করে, একে অন্যের থেকে এক সেন্টিমিটারের থেকেও কম দূরত্বে বসেছিলেন। জ্বর বা সর্দি-কাশি থাকলেও ম্যাচ দেখতে যাওয়া বাতিল করতে চাননি কেউ। ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথম তাঁরা বুঝতে পারেন করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে রোগী আসা শুরু হয়েছে। রাত ৮টা নাগাদ প্রথম মোবাইল বার্তা আসে; কিন্তু তখনো পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারার মতো কিছু ঘটেনি। সবকিছু বদলে যায় ১ মার্চ। হাসপাতালে যে দিকে চোখ যায়, শুধু নিউমোনিয়া-আক্রান্ত রোগী। সব ঘর তো উপচে পড়ছেই, এমনকি করিডরও ভর্তি। সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একের পর এক স্ট্রেচার। সবার শ্বাসকষ্ট। আতঙ্ক।

চিকিৎসকেরা এখন বলছেন, ওই সময় এত বড় ফুটবল জমায়েত না হলে হয়তোবা ইতালি, স্পেনে এভাবে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পেত না। শেষে তো ইতালির পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, মৃত মানুষকে সমাহিত করার জায়গার সংকট দেখা দেয়। যাঁদের সমাহিত করা যাচ্ছিল না, সেই সব কফিন তুলে নিয়ে যাচ্ছে সেনাবাহিনীর ট্রাক।

৪.
এই চিত্রগুলো যে সহজ সমীকরণটি তুলে ধরে তা হচ্ছে, বড় জমায়েত, অবারিত চলাফেরা করোনা ঝুঁকির অন্যতম কারণ। সামাজিক সংক্রমণের বড় উৎস এই দুটিই । আমাদের দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতির দিকে যদি তাকাই দেখব, প্রতিদিন আক্রান্ত আর মৃত্যুর দিক বিবেচনায় রেকর্ড ভাঙছে করোনা। সামনের দিনগুলোতে বিপজ্জনক পরিস্থিতির আভাস দিচ্ছেন স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যেই অনিয়ন্ত্রিত জমায়েত এবং অবারিত যাওয়া-আসা দুটোই ঘটছে সবার চোখের সামনে।

দীর্ঘ সময় পার হয়েছে। কিন্তু আনুষ্ঠানিক লকডাউন, যানবাহন ও মানুষ চলাচল নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থান নেওয়া যায়নি। বরং নানা গোষ্ঠীর সঙ্গে আপস করে নানা ছাড় দিতে হয়েছে। অনেক স্থানে নিষেধাজ্ঞা শিথিল বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তুলে নেওয়ায় সংকটের মাত্রাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে রোগী ও মৃত্যু। বিশেষ করে ১০ মে থেকে মার্কেট, শপিংমল ও দোকান খোলার ঘোষণার মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।

পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া বা কাঁঠালবাড়ী-শিমুলিয়া ঘাটে একবার ঢাকামুখী মানুষের স্রোত এবং এখন ঢাকা থেকে বাড়িমুখী মানুষের উদ্বেগজনক উপচেপড়া ভিড়। সড়ক মহাসড়কে চলছে যানবাহন বেপরোয়াভাবে। পণ্যবাহী পরিবহন দিয়ে মানুষ আনা-নেওয়া হচ্ছে। স্বাভাবিক চরিত্রে ফিরেছে রাজধানী ঢাকা। বাস ছাড়া চলছে সব ধরনের যানবাহন। যাত্রীকল্যাণ সংস্থা ঈদের আগে ১০ দিন ও পরে ১০ দিন সারা দেশে কারফিউ দিতে বলেছে, গাজীপুরে দুই সপ্তাহের কারফিউ চান মেয়র, মালিকদের শঠতার চিত্র তুলে ধরেন গাজীপুরের এসপি, কিন্তু কার কথা কে শোনে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে কলকারখানা এবং দোকানপাট খুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে যে শৈথিল্য দেখা গেছে সে কারণে সংক্রমণের হার বেড়েছে। এখনই আরও সতর্ক হতে হবে, আমরা ঈদের নামে যেন কোনো শৈথিল্য না দেখাই।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, প্রতিদিন যাতে ১৫ হাজার টেস্ট করা যায়, সে লক্ষ্য নিয়ে তারা কাজ করছে। এ মাসের মধ্যেই প্রতিদিন ১০ হাজার টেস্টের লক্ষ্য পূরণ করতে চায় তারা। কিন্তু তার পরও জনসংখ্যার তুলনায় টেস্টের এ সংখ্যা নগণ্য। প্রায় আড়াই মাসেও দিনে ১০ হাজার পরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি। পরিস্থিতি যেকোনো সময় বেশ জটিল হয়ে উঠতে পারে। সবাই একই কথা বলছেন, সবকিছু মিলিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য আরও কঠোর হওয়ার বিকল্প নেই।

৫.
অনেক সময় পেয়েও আমরা কেন ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে পারলাম না। লাখ লাখ প্রবাসী এসে সবার সঙ্গে কীভাবে মিশে গেলেন? নারায়ণগঞ্জ কীভাবে পৌঁছাল দিনাজপুরে? শিবগঞ্জ কীভাবে পৌঁছাল চাঁদপুরে? গাজীপুর কীভাবে গেল টাঙ্গাইলে? এসব প্রশ্নের জবাব মেলে না। শেষ পর্যন্ত সামাজিক সংক্রমণ শুরু হলো। কোনটা সাধারণ ছুটি, কোনটা লকডাউন, কোনটা ‘স্বাস্থ্যবিধি’ মেনে খোলা, আর কোনটা না, কারখানা খোলা, না কারখানা বন্ধ, হাসপাতাল আছে হাসপাতাল নাই, ডাক্তার আছে পিপিই নাই, টেস্ট বাড়ানো দরকার কিন্তু হচ্ছে না—এসব করতে করতে আমাদের পার হল দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী। এর মধ্যেই সবার চোখের সামনে হয়ে গেল ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর। এখন আমাদের সবার চোখ শুধু ফেরিঘাটের দিকে।

৬.
কেন জানি মনে হচ্ছে: আমাদের অবস্থাটা আমার শৈশব স্মৃতির নুরুর মতোই। নুরু দৃশ্যমান বৃষ্টির ফোটার ফাঁক দিয়ে শরীর না ভিজিয়ে বাড়ি ফিরতে চেয়েছিল। আর আমরা? কি ফেরির যাত্রী, কি ফুটপাত বা মার্কেটের ক্রেতা, কি নীতি নির্ধারক, কি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপক, কি প্রণোদনা প্রাপক বা প্রণোদনা প্রত্যাশী, কি রাজনৈতিক নেতা ও হাতা, কি ব্যবসায়ী সংঘের বড় নেতা—সবাই ভেবেছি ও ভাবছি , চারপাশে ছড়িয়ে থাকা অদৃশ্য করোনা ভাইরাসের ফাঁক গলে আমরা কোনোমতে বিপদ পাড়ি দেব। কোনোমতে হয়তো বেঁচেই যাব!

সংক্রমণের সব পথ খোলা রেখে আমরা সুস্থ হয়ে ওঠার লড়াই বা বড়াই করছি। মৃত্যুর সব আয়োজন নিশ্চিত করে, আমরা গাইতে চাইছি জীবনের জয়গান।

সব দেখেশুনে জীবনানন্দ দাশের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলি : সবাই মিলে আমাদের ‘মরিবার সাধ’ হলে, কে আমাদের রোধ করবে? কে আমাদের রক্ষা করবে?