সারা বছর ভুলে থাকা দুর্যোগ প্রস্তুতি

বালুর বস্তা দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামতের চেষ্টা করছেন এলাকাবাসী। গতকাল সকালে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরায়। ছবি সাইফুল ইসলাম, প্রথম আলো।
বালুর বস্তা দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামতের চেষ্টা করছেন এলাকাবাসী। গতকাল সকালে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরায়। ছবি সাইফুল ইসলাম, প্রথম আলো।

ঝড় শুরু হওয়ার আগে মানুষকে সাইক্লোনের খবর আর আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার কথা জানাতে গিয়ে পানিতে ডুবে মারা যান এক টিম লিডার। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমরা নিজেদের রোল মডেল দাবি করি, কিন্তু কোন দেশে লাইভ জ্যাকেট ছাড়া কোনো স্বেচ্ছাসেবী থাকতে পারে? জলে কাদায় যাঁদের কাজ করতে হয় কোনো রকম সম্মানী ছাড়াই, যাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েন, তাঁদের ন্যূনতম সুরক্ষা কে দেখবে? কলাপাড়া উপজেলার সিপিপির (ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি) ৬ নম্বর ইউনিট টিম লিডার সৈয়দ শাহ আলম ঘূর্ণিঝড়ের কবল থেকে মানুষকে বাঁচানোর জন্য খেয়া নৌকায় উঠলেন। নৌকা উল্টে যায়। সঙ্গে থাকা তাঁর ছেলে কোনো রকমে তীরে ওঠেন। লিডার শাহ আলম ডুবে যান। সারা দিন খোঁজাখুঁজির পর সন্ধ্যার দিকে ডুবুরি লাশ উদ্ধার করে। জন্ম-মৃত্যু আল্লার হাতে, কিন্তু তাঁর একটা জ্যাকেট থাকলে আফসোস কম হতো। এসব স্বেচ্ছাসেবীকে উজ্জীবিত রাখার জন্য, প্রস্তুত রাখার জন্য ব্যক্তিগত সুরক্ষা ও অপেশাদারত্ব নিশ্চিত করার জন্য ৪১টি উপকূলীয় উপজেলায় একজন করে সিপিপি কর্মকর্তা থাকার কথা। আছেন সাকল্যে ১২ জন। ২০০৫-এর পর এই প্রতিষ্ঠানে কোনো নিয়োগ নেই। দুর্যোগসংক্রান্ত পৃথিবীর তাবৎ সভায় রোল মডেল দেশের আইকন প্রোগ্রাম হিসেবে সিপিপিকে তুলে ধরা হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির এই দুর্দশার অবস্থা কে ঘুচাবে? আমাদের সাইক্লোন প্রস্তুতির ধারাপাত শুরুই হয় বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ শুরু হওয়ার পর।

সংবাদ প্রচারে তথ্য বিভ্রাট
ম্যানিলা থেকে প্রথমে ফোন, পরে ই-মেইল করেন বাংলাদেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করা এক বিশেষজ্ঞ। অনেক দিন তিনি সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন ব্যাংককের এশিয়ান ডিজাস্টার প্রিপিয়ারডনেস সেন্টারে। তাঁর কথা ছিল, খেপেছ নাকি? মাথার ঘিলু কি সব পানি হয়ে গেছে? কোথায় বাঁকখালি আর কোথায় হাতিয়া? ‘তোমরা কীভাবে বলছ সন্ধ্যা নাগাদ আম্পান হাতিয়া আর দিঘায় আঘাত হানবে?’ বাংলাদেশি একটি অনলাইন পত্রিকায় কলকাতার আলীপুর আবহাওয়া দপ্তরের উপমহাপরিচালক (পূর্বাঞ্চল ) সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের বরাতে বলা হয়, ‘বিকেলের দিকে আম্পান পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপূরের দীঘা ও বাংলাদেশের হাতিয়া দ্বীপের মাঝে সুন্দরবন অঞ্চলে প্রচণ্ড আঘাত হানতে পারে।’ ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির প্রতিবেদনের সূত্রের কথা বলে এই তথ্য কিছু কিছু বাংলাদেশি অনলাইন গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়।

করোনাভাইরাসের গন্ধ পাওয়ার পর আমাদের কর্তারাও যেভাবে একের পর এক মনগড়া যুক্তিহীন বক্তব্য দিয়েছিলেন, তার আছর বোধকরি আবহাওয়া অধিদপ্তরও এড়াতে পারেনি। অধিদপ্তরের একেক কর্মকর্তার নামে একেক সংবাদমাধ্যমে একেক ধরনের বক্তব্য এসেছে। যেমন ডেইলি স্টার-এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে আবহাওয়া অধিদপ্তরে কর্মরত আবহাওয়াবিদ রাশেদুজ্জামান বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় আম্পানের কেন্দ্র বাংলাদেশে প্রবেশের কোনো আশঙ্কা নেই।’ আবার আরিফ হোসেন জানিয়েছিলেন, ‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঝড়টি শক্তি হারিয়ে দেশে প্রবেশ করবে।’ ০৭: ০১ অপরাহ্ণ, মে ২০, ২০২০ / সর্বশেষ সংশোধিত: ০৭: ০৫ অপরাহ্ণ, মে ২০, ২০২০। অন্যদিকে প্রথম আলোকে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক সামছুদ্দীন আহমেদ বলেছিলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় আম্পান বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম শুরু করে দিয়েছে।...বিকেল চারটা থেকে রাত আটটার মধ্যে আম্পান বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, খুলনা অঞ্চল অতিক্রম করবে।’ (২০ মে ২০২০, ১৬: ৫৭ আপডেট: ২০ মে ২০২০,) আবহাওয়া অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে সবচেয়ে মজার তথ্যটি দিয়েছিল অন্য একটি সংবাদমাধ্যম, তারা জানিয়েছিল, ‘রাতে আম্পানের দ্বিতীয় আঘাত হতে পারে ভয়ংকর’। এই তথ্য শুনে এটা মনে হওয়া খুবই স্বাভাবিক যে আম্পান আবার সমুদ্রে ফিরে গিয়ে দ্বিতীয়বার আঘাত করতে আসবে!

আবার সেই বাঁধের কিসসা
প্রস্তুতির ঢোল প্রথম ফুটো হয়ে যায় ২০ মে সকাল ১০টা নাগাদ। তখনো আম্পান অনেক দূরে। শরণখোলার বগী বন্দরের বাঁধ ভেঙে যায়। সাগর উত্তাল থাকায় রাতের জোয়ারের পানি সাগরে ফেরত যেতে পারেনি, তারপর সকালের পানির চাপ। মানুষ নিজের গরজে ছুটে যায় মেরামতের জন্য। পারেনি। আম্পান আসার আগেই লোনা পানিতে মাঠঘাট, ঘরবাড়ি ভেসে যায়।

সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক নিশ্চিত করেছেন, তাঁর জেলার কমপক্ষে চারটি উপজেলার ২৩টি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানি প্রবেশ করে বহু চিংড়িঘের ও বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চল তলিয়ে গেছে। সাতক্ষীরায় এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত চারটি উপজেলা হচ্ছে শ্যামনগর, আশাশুনি, কালীগঞ্জ ও সাতক্ষীরা সদর। খুলনার কয়রা উপজেলার হরিহরপুর, কাশীর হাটখোলা, গাব্বুনিয়া, কাটকাটাসহ পুরা বেদকাশী নদীভাঙনে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে!

এসব এলাকাকে লোনা পানি মুক্ত করে আমন ধানের জন্য প্রস্তুত করাটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। মানুষ প্রথমেই চাইবে বেড়িবাঁধগুলোর মেরামত। শুকনার সময় কাজটা যত সহজ ছিল, এখন সেটা ততই কঠিন। ঘূর্ণিঝড়ের মৌসুম শুরুর আগেই বাঁধগুলোর স্বাভাবিক রক্ষণাবেক্ষণ মেরামতি করলে এই পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব ছিল। আমাদের সাইক্লোন প্রস্তুতির ধারাপাত শুরুই হয় বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ শুরু হওয়ার পর। সেখানে থাকে সাইক্লোন শেল্টারের গান, মানুষকে শেল্টারে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার কুচকাওয়াজ। বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণ, বাঁধের ওপর জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠাই সমাধান। বাঁধ রক্ষায় সবসময় তাদেরই দৌড়ে যেতে দেখা যায়। অথচ বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণে পরিকল্পনা থেকে তাদের রাখা হয় দূরে।

শারীরিক দূরত্ব মেনে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা?
বলার জন্য বলা অনেকটা সোনার পাথরবাটির মতো। শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর এলাকার এক সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নিয়েছিলেন সাড়ে তিন শর বেশি মানুষ। তখন সন্ধ্যা সাতটা। চার কক্ষের দোতলা এই ভবনে তখন মানুষের আসা বন্ধ হয়নি। এই পরিস্থিতিতে দূরত্ব বজায় রেখে বসতে বলা হাস্যকর। কারও মাস্ক ছিল না কিন্তু গামছা-রুমাল-শাড়ির আঁচল দিয়ে বা ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে মুখোমুখি না বসে উল্টো দিকে মুখ করে বসানো সম্ভব ছিল। সম্ভব ছিল সাবান-পানির ব্যবস্থা রাখার। সেটা করা হয়নি।

অ-উপকূলীয় জেলার কী হবে
ক্ষতির সব হিসাব এখনো হাতে আসেনি। তবে যশোর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, পাবনা, রাজশাহীর মানুষ ধান, আম, পান, লিচু, কলা হারিয়ে যে সর্বস্বান্ত হওয়ার পথে, তা প্রাথমিক আলামতে বোঝা যাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়ের ত্রাণ বরাদ্দের তালিকায় এই জেলাগুলোর নাম থাকে না। এবারও নেই। কৃষি পুনর্বাসনে গৃহনির্মাণে এই জেলাগুলোর কথা আলাদা করে মাথায় রাখতে হবে।

মনে রাখতে হবে, দুর্যোগের প্রস্তুতি সারা বছরের কাজ। মানুষকে সম্পৃক্ত করে মানুষের মালিকানা ছাড়া দুর্যোগ মোকাবিলা বা উন্নয়নের সঠিক চাবি ঘোরানো কোনোটাই সম্ভব নয়।

লেখক: গবেষক
nayeem 5508 @gmail, com